শুরু হয়েছে নতুন বছর। নতুন বছর নিয়ে মানুষের নানা প্রত্যাশা যেমন আছে তেমনি হতাশা, অস্বস্তি কিংবা ভয়ও কম নয়। অনেকে ভাবছেন ২০২২ সালে করোনাভাইরাস বিষয়ে কী ঘটতে যাচ্ছে? কারণ বিভিন্ন সময় এর নতুন ধরন এসে হানা দিয়েছে। আর তাতে বদলে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। তবে সম্প্রতি যে তথ্য প্রকাশ হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে, তাতে বলা যায়, ২০২২ সালের মধ্যেই হার মানবে করোনাভাইরাস। এই গ্রহ হবে আবার আগের মতো। নতুন বছরের শুভেচ্ছাবার্তায় এ রকম আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস। তিনি বলেছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশগুলো যদি সত্যিই আন্তরিক হয়, তাহলে ২০২২ সালের মধ্যেই মহামারিকে পরাজিত করা সম্ভব হবে। অবশ্য তিনি সেই বিবৃতিতে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ এবং টিকা মজুদের বিরুদ্ধে বিশ্বকে সতর্ক করে দেন। তার মতে, কিছু দেশের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ এবং টিকা মজুদ করার প্রবণতার কারণে টিকা বিতরণে সমতা ক্ষুন্ন হচ্ছে এবং এতে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। আর এটাই সত্য যে, করোনা মহামারির বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত আমাদের হাতে থাকা সবচেয় কার্যকর হাতিয়ার হলো করোনা টিকা; কিন্তু সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও টিকা মজুত করার প্রবণতার কারণে বিশ্বজুড়ে করোনা টিকা বণ্টনে অসমতা সৃষ্টি হয়েছে এবং এটি দিনকে দিন বাড়ছে।
কয়েক দিন আগে প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসও একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ২০২২ সালে করোনাভাইরাস অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে। যদিও ওমিক্রন আতঙ্ক নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বছর। অয়্যারড-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বিল গেটস বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারিতে লাখো-কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে গেছে; তবে রোগ শনাক্ত, চিকিৎসা পদ্ধতি ও টিকা উদ্ভাবনে যে কাজ চলছে, তা সত্যিই দারুণ। আমি আশাবাদী বিশ্বের জন্য স্বস্তি আসবে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ।’
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে ২০২২ সালে কী আশা করা যায়? প্রথমেই কৃষির কথা ধরা যাক। করোনাকালীন সময়ে ২০২০ সালে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দেশের কৃষি খাত। সেই সময় করোনার প্রভাব ছিল তুমুল। আমরা দেখেছি, বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষি শ্রমিক আনা নেওয়াতে সমস্যা হয়েছিল। সরকারি কর্মকর্তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় তা শেষে লাঘব হয়। এরপর ২০২১ সালে কৃষির আগের সেই লোকসান আর হয়নি। ফলন বেশ ভাল হয়েছে। ফলে এই খাত অনেকটাই ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে বলা যায়। সারাবিশ্বের অর্থনীতি করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর মধ্যে আমাদের জন্য ভাল খবর হলো, বাংলাদেশ সরকারের দ্রুত ও সময়োপযোগী নানা পদক্ষেপে, বিশেষ করে খাতভিত্তিক প্রণোদনা প্রদানের কারণে দেশে এর প্রভাব পড়েছে অনেক কম। শেষদিকে রেমিট্যান্সের গতি মন্থর হলেও ২০২১ সালের শুরুতে রেমিট্যান্স এসেছে রেকর্ড পরিমাণে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পর্যাপ্ত রয়েছে এবং আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে রপ্তানি খাত। ২০২২ সালে তাই আশা করা যায় করোনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ।
২০২২ সালের প্রথম দিনই প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য সুখবর দিয়েছে সরকার। চলতি মাস থেকে রেমিটেন্সে প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ প্রবাসীরা কেউ ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে দুই টাকা ৫০ পয়সা যোগ হয়ে ১০২ টাকা ৫০ পয়সা পাবেন তার স্বজনরা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জনমানুষের সার্বিক জীবনমান উন্নয়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্সের গুরুত্ব বিবেচনায় বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমজীবী মানুষের কষ্টার্জিত বৈদেশিক আয় বৈধ উপায়ে দেশে প্রত্যাবাসন উৎসাহিত করার লক্ষ্যে রেমিটেন্স প্রেরণের বিপরীতে সরকার কর্তৃক ২ শতাংশ প্রণোদনা/নগদ সহায়তা প্রদানের বিদ্যমান হার বাড়িয়ে ২.৫%-এ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বর্ধিত এ হার চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জানুয়ারি থেকেই কার্যকর হবে।
সরকার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়ে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির নিরাপদ বিনিয়োগে চরম আঘাত হেনেছিল ২০২১ সালে। এই কারণে দেশের মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতা। পাশাপাশি আরেকটি বিষয়ে এই দুই শ্রেণি মার খেয়েছে, প্রতারিত হয়েছে। দেশের বাজারে দ্রুত বিকাশমান ই-কমার্স খাতে ২০২১ সালে ঘটেছে চরম বিপর্যয়। বেশ কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতির কারণে বহু মানুষ হয়েছেন সর্বশান্ত। এদের লোভনীয় প্রচারণার ফাঁদে পা দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকা খুইয়েছেন। এর প্রতিকারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃপক্ষ, মন্ত্রণালয় ২০২২ সালে জোরাল ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আশা করি।
এবার দেখা যাক বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে ২০২২ সালে কার কী ভাবনা। নতুন এই বছর নিয়ে জাতিসংঘ একটা সংকটের কথা জানিয়েছে। সংস্থাটির মতে, ২০২১ সালের চেয়ে ১৭% বেশি অর্থাৎ ২৭ কোটি ৪০ লাখ মানুষ কঠিন সংকটে পড়বে ২০২২ সালে। এদের খাদ্য সংকটসহ দৈনন্দিন ন্যূনতম চাহিদা পূরণে এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে ১৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষের অবস্থা হবে খুবই সঙ্গিন। এদের বাঁচানোর জন্যই প্রয়োজন ৪১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে এমন উদ্বেগজনক তথ্যই উপস্থাপন করেছে জাতিসংঘ। প্রতিবেদনে তারা বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা, পরিবেশ দূষণ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিদিনই বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি বৃদ্ধি পাচ্ছে ভিটেমাটি হারিয়ে ভাসমান জনতার তালিকা। আর ৬৩টি দেশেই এমন কঠিন সংকটে পড়া মানুষের সংখ্যা বেশি বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন আরও জানিয়েছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১% বাস্তুচ্যুত হয়েছে ২০২১ সালে। চরম দারিদ্র্য এখন বাড়ছে এবং বাড়বে। অনাহার-অর্ধাহারে দিনাতিপাতকারীর অধিকাংশই নারী এবং শিশু। নারী-পুরুষের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে তথ্য-প্রযুক্তির বিস্তার সত্ত্বেও। ৪৩টি দেশের ৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষে পড়বে ২০২২ সালে। এমন খাদ্য-সংকট থেকে বিরাট জনগোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশগুলোর এগিয়ে আসা জরুরি বলে মন্তব্য করেছে তারা।
মাস্টারকার্ড ইকোনমিকস ইনস্টিটিউটের করা একটি সমীক্ষা বলছে, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়েছিল বলে উল্লেখযোগ্য হারে সেই সময় তাদের ব্যয় কমে যায়। পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয় প্রণোদনা। ফলে মানুষের হাতে নগদ অর্থের সঞ্চয় বেড়েছে। এই সমীক্ষা অনুসারে, এ সঞ্চয় ২০২২ সালে বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অতিরিক্ত ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট অবদান রাখতে পারে। তারা বলছে, যদি এ সঞ্চয়গুলো দ্রুত ব্যবহার করা হয় তবে এ বছর জিডিপিতে ৪ দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্টেরও বেশি যুক্ত হতে পারে। ২০২০ সালে সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবণতা নিয়ে বিশ্লেষণ শুরু করেছিল আর্থিক পরিষেবা সংস্থাটি। চলতি বছর পারিবারিক সঞ্চয়ের হার মহামারীর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ভোক্তারা তাদের সঞ্চয় থেকে কত দ্রুত বা ধীরে ব্যয় করবে তা বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
গ্লোবাল ইকোনমিক আউটলুক-২০২২ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে সঞ্চয় ও ব্যয়, সরবরাহ চেইন, ডিজিটাল রূপান্তর, বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির একটি ক্রমবর্ধমান তালিকা বিশ্ব অর্থনীতিকে রূপ দিতে পারে। তাদের মতে, করোনা মহামারি পণ্য খাতে ভোক্তা ব্যয়ের হার ৩৯ থেকে প্রায় ৪৭ শতাংশে নিয়ে গেছে। যেখানে করোনার কারণে সরবরাহ চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পরিষেবা খাতে ভোক্তা ব্যয় কমে গেছে। পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে ২০২২ সালে দাম ও সরবরাহ চেইনের চাপ কমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে খুচরা বিক্রির ২০ শতাংশ স্থায়ীভাবে ই-কমার্সে স্থানান্তরিত হয়েছে। প্রতিবেদনে তারা বলেছে, ২০২২ সালে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হবে সঞ্চয় ও আর্থিক সহায়তা কমে যাওয়ার পর অনলাইন ব্যয়ের প্রবণতা কেমন হবে। এরই মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে খুচরা খাতে অনলাইন বিক্রির অংশীদারিত্ব কভিডপূর্ব পর্যায়ে পৌঁছেছে।
আর বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি বলেছে, ধনীদেশ ও উদীয়মান দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতির প্রভাব বাড়বে। কোনো কোনো জরিপ অবশ্য বলেছে, বিশ্বপ্রবৃদ্ধির শ্লথগতি ২০২২ সালেও অব্যাহত থাকবে। সরবরাহ ব্যবস্থার সংকটও কাটবে না। এখন আবার গত সপ্তাহ থেকে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন অমিক্রন নিয়ে বিশ্বে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও পাওয়া যাচ্ছে রোগী। করোনার আগের ধরনগুলোর তুলনায় অমিক্রন যে আরও বেশি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, তা মোটামুটি নিশ্চিত। এই অমিক্রন মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারও। করোনায় নানা বিধিনিষেধ আরোপের মানে হলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি প্রভাব পড়া। ২০২২ সালে অমিক্রন কিংবা এরপর আরও কোনো ধরন আসে কিনা। আর তাতে কেমন পরিস্থিতি হয়, সেটিই এখন ভাবনার বিষয়।