হাসান হামিদ
কবীর সুমনের গান আছে না একটা?
‘কেউ যদি বেশি খাও, খাবার হিসেব নাও
কেননা অনেক লোক ভাল করে খায় না;
খাওয়া না খাওয়ার খেলা, যদি চলে সারাবেলা
হঠাৎ কি ঘটে যায় কিচ্ছু বলা যায় না।’
সে যাই হোক, আমরা বাঙালিরা খাওয়া দাওয়াতে কিন্তু বেশ। নিজেরা সাইজে পিঁপড়ের সমান হলেও আমরা হাতি সাইজ পরোটা গিলি গোগ্রাসে। এ বিষয়ে একটি গল্প বলে নিই। তারপর কিছু সুখবর এবং আশার কথা বলবো। এক দেশে ছিল একটি পিঁপড়া। সেই দেশের সীমান্তে দালালের কাজ করতো পিঁপড়ে। একদিন সেখানকার এক হাতি তাকে বলল:
—আমাকে বর্ডারটা পার করিয়ে দাও না!
—ঠিক আছে, আমার সঙ্গে চলো; বলল পিঁপড়ে।
দুজন হাঁটতে শুরু করল সীমান্তের উদ্দেশ্যে। পিঁপড়ে সামনে আর হাতি তার পেছনে। এমন সময় সীমান্তরক্ষী চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল:
—কে? কে যায় ওখানে?
—আমি পিঁপড়ে; পিঁপড়ে বলল।
—তা তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু সঙ্গে ওটা কে?
রীতিমতো রেগে উঠে বলল পিঁপড়ে:
—কে মানে? সঙ্গে করে খাবারও নিতে পারব না নাকি!
এবার আসল কথায় আসি। প্রথমেই সুখবর। ২০১৭ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে (বিশ্ব ক্ষুধাসূচক) দুই ধাপ এগিয়েছে আমাদের বাংলাদেশ। গত বছর ৯০-এ থাকা বাংলাদেশের এবারের অবস্থান ১১৯টি দেশের মধ্যে ৮৮তম। একটি দেশের মানুষ কী পরিমাণ বা কোন মাত্রায় ক্ষুধার্ত থাকে, তার ওপর ভিত্তি করে এই ইনডেক্স তৈরি করা হয়। তবে দুই ধাপ এগোলেও এই সূচকে বাংলাদেশ এখনো নিচের সারিতেই রয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ অবস্থানে রয়েছে প্রতিবেশী ভারত (১০০তম) ও পাকিস্তান (১০৬তম)।. সূচকে দেখা যায়, দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ১৯টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে আফগানিস্তান, পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তান-ভারত এবং উত্তর কোরিয়া। সূচকে সবচেয়ে নিচের সারিতে রয়েছে মধ্য আফ্রিকার দেশ যথাক্রমে সাদ, সিয়েরালিওন, মাদাগাস্কার ও জাম্বিয়া। এ ছাড়া আফ্রিকার দক্ষিণ সুদান, লাইজার, সোমালিয়া ও ইয়েমেনের অবস্থানও তলানিতে। এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট। মূলত, বিশ্ব ক্ষুধা সূচক নির্ধারণের ক্ষেত্রে চারটি মানদণ্ড বেছে নেওয়া হয়। এগুলো হলো- অপুষ্টি, শিশুর উচ্চতার তুলনায় কম ওজন, বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা ও শিশুমৃত্যু হার। এই চারটি বিষয়ের ক্ষেত্রে দেশগুলোর পরিস্থিতি বিচার করে ১০০ পয়েন্টের এই সূচক তৈরি করা হয়।
বাংলাদেশের অবস্থান দুই ধাপ এগিয়েছে। তবে অবস্থানের অগ্রগতি হলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ‘গুরুতর’ ক্ষুধার সমস্যা রয়েছে। আর বাস্তবতা বলছে, এখন আমাদের দেশে খাবার মোটেও সাধারণের নাগালের মধ্যে নেই। ফসল হানি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেক মানুষকে পথে বসিয়েছে। তারা পাকস্থলি অর্ধখালি রেখেই দিন কাটায়। তবে আশার কথা হলো, ক্ষুধা ও দারিদ্র্র্য নিরসনের জন্য সব সরকারই কাজ করেছে এবং এখনো করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও দেশে দেশে ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড় কমছে না। এটা স্বীকৃত যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের যোগসূত্র অত্যন্ত নিবিড়। অর্থাৎ দরিদ্র ব্যক্তিরাই ক্ষুধার্ত। সাধারণ ধারণা অনুযায়ী ক্ষুধার্ত ব্যক্তির সংজ্ঞা হলো যে ব্যক্তি অনাহারে রয়েছে। কারণ খাদ্য ক্রয়ের কোনো সামর্থ্যই তার নেই। সাধারণ ধারণায় ক্ষুধা মানেই আহারের অভাব। অর্থাৎ এ অভাবের জন্যই জনমানুষ ক্ষুধার্ত হয়।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী ক্ষুধার সংজ্ঞায় পুষ্টির অভাব বা অপুষ্টিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ সংজ্ঞায় কোনো ব্যক্তি যদি প্রতিদিন এক হাজার ৮০০ ক্যালরির মানসম্পন্ন খাবার না খেতে পারে, তাহলে সে অপুষ্টির শিকার হবে। অপুষ্টির অর্থ পুষ্টির অভাবও হতে পারে। অর্থাৎ নির্ধারিত পরিমাণের ক্যালরির ঘাটতি। এ সংজ্ঞায় খাদ্য গ্রহণের পরও মানুষ ক্ষুধার্ত হয়। উল্লিখিত প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য হলো অপুষ্টি সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি করা। এ সংস্থা আশা করে, সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। খাদ্য প্রত্যেক মানুষের প্রাথমিক ও প্রধানতম অধিকার। মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পূর্বশর্তই হচ্ছে তার খাদ্যের অধিকার পূরণ করা। সাংবিধানিকভাবে জনগণের খাদ্যেও অধিকার অর্জন এবং পুষ্টিমান উন্নয়নে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিদ্ধ।
আমরা দেখছি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলছে। খাদ্য নিরাপত্তা পরিসংখ্যানে উন্নতি হয়েছে আগেরকার তুলনায়। ক্ষুধা সূচকে (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স) ২০১৭ অনুযায়ী, ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও পুষ্টি দুরীকরণে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু তাতেও আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, যে উন্নত দেশগুলোকে (যেমন আমেরিকা, ইংল্যান্ড ইত্যাদি) এই তালিকায় ধরা হয়নি, এতে আছে শুধু উন্নয়নশীল আর পিছিয়ে থাকা রাষ্ট্রগুলো। তাই এটুকু বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে এই বিশ্ব-ক্ষুধা সূচকে (গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স, সংক্ষেপে জিএইচআই) বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ।
শেষ করবো একটি মজার ঘটনা বলে। ঘটনাটি কোনো বই পুস্তকে নেই। কয়েক দিন আগে ‘মুনীর চৌধুরী সম্মাননা পদক ২০১৭’ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় ফেরদৌসী মজুমদার তাঁর ভাই নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর ব্যক্তিগত গল্প বলেছিলেন। গল্পটি খাদ্য বিষয়ক ছিল এবং এ গল্পই বলে দেয় শ্রদ্ধেয় মুনীর চৌধুরী কতোটা রসিক মানুষ ছিলেন।
একদিন রাতে মুনীর চৌধুরী তাঁর ছোট বোন ফেরদৌসী মজুমদারকে ডাকতে দরোজায় টোকা দিলেন। আর বাসায় ভাই বোনদের সাথে মজা করে সাধু ভাষায় কথা বলতেন। তো তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী করিতেছিস? ভক্ষণ করিতেছি; বললেন ফেরদৌসী মজুমদার। ভক্ষণ তো রাজা উজিররা করেন, আমরা সাধারণেরা খাই আর তোরা গিলিস!
প্রকাশিত পত্রিকা-
দৈনিক দেশকাল ০৫/১২/২০১৭
এইবেলা ০৫/১২/২০১৭