হাসান হামিদ
আমার বাবা ছিলেন আমাদের গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার। সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের আবিদনগর নামের নিভৃত এক গ্রামে আমার জন্ম। বাবা মারা গেছেন ১৯৯২ সালে। আমি তখন বেশ ছোট। স্কুলে যাওয়া শুরু হয়নি তখনো আমার। সেই সময়ের কোনো কথাই আমার আসলে এখন আর মনে নেই। আম্মা মাঝে মাঝে বলেন আব্বার গল্প। স্কুল সকাল দশটায় শুরু হলেও আব্বা ঘর থেকে বের হতেন সকাল সাতটায়। গ্রামের এ বাড়ি ও বাড়ি হয়ে, বুঝিয়ে সুজিয়ে ছাত্র নিয়ে স্কুলে হাজির হতেন নয়টা নাগাদ। বড় হয়ে আমি দেখেছি, আব্বার হাতে লেখা অনেক বই। ছড়া আর ছবি আঁকা সেইসব বই, গল্প আর নিজের লেখা গান পাঠ্যপুস্তকের বাইরে আব্বা বাচ্চাদের পড়াতেন। সব সময় প্রায় সকল সুবিধার বাইরে থাকা সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের এখনকার চিত্র হয়তো খানিকটা বদলেছে। অভিভাবকরা কেউ কেউ সচেতন হয়েছেন। কিন্তু সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা উপকরণের অপ্রতুলতা এমন কিছু ব্যাপার পুরোনো পর্দার মতো এখনো সেঁটে আছে ওতপ্রোতভাবে।
জন্মের পর থেকেই আমি দেখেছি হাওরের মানুষের যুদ্ধ। প্রতি বছর নাছোড় বন্যা, প্রায় প্রায় হাওরের বাধ অসময়ে ভেঙে ফসল তলিয়ে যাওয়া, বছরের অর্ধেক সময় কর্মহীন হয়ে থাকা এই মানুষগুলো এখনো কেবল শ্বাস নেয়; শুধুই বেঁচে থাকে। আর হাওরের উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বছরের অর্ধেক সময় চলাচল করতে হয় সেখানকার মানুষদের। ছোটবেলা সেই গ্রামের স্কুলেই আমার পাঠ নেয়া শুরু হয়েছিল অন্য সবার সাথে। সকালে আলুভাজি আর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে, নিজের বইগুলো পলিথিনে ভরে খালি পায়ে আমাদের শিক্ষা নেয়া শুরু হয়। খুব কাছ থেকে আকাশ দেখা হয়, গাছের লতার মতো বেড়ে ওঠা হয়, এ শিক্ষাই হয়তো প্রকৃত শিক্ষাই; কিন্তু অনেকের জুটে না প্রবল তৃষ্ণা থাকার পরও একটা গল্পের বই। দুয়েকটা পরিবারে কেবল বই বা পত্রিকা পড়ার বিষয় থাকতো। বাকিদের জুটতো না কিছু। এর মধ্যে যদি ফসল তলিয়ে যায়, তবে ওই পরিবারের খাবার জুটাতে কোমল বাচ্চাটিকেও হয়তো ধরতে হয় মাছ ধরার জালের রশি, রাতে আলোয়াড়ার হ্যারিকেনের হাতল। পড়া আর কে পড়ে!
হাওরে হেমন্ত আর বর্ষা বলে পুরো বছরকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যাতায়াতের পথসুবিধার বিলিবন্টনে এই দুই সিজনের বাইরে আর কিছু যে আছে, তা অনেকের অজানা। হেমন্ত মানে শুকনোর সিজনে যদিও এ অঞ্চলের ছেলেমেয়েগুলো গৃহস্থালি কাজের বাদেও একটু আধটু স্কুলে যেতে পারে, কিন্তু বর্ষায় বিদ্যালয়ে যাওয়ার একমাত্র পথটি পানিতে ডুবে যায়। তাই সাঁকো দিয়ে, না হয় নৌকা দিয়ে পার হতে হয় তাদের। পার হওয়ার সময় সেইসব বাঁশের সাকোঁ নড়ে ওঠে। ছোট ছোট হাত-পা কেঁপে ওঠে, তখন ভয় করে; আমার এখন মনে হয় আসলে সেখানে কেঁপে ওঠে এদেশেরই একটা অংশ। আর এভাবেই ভয় নিয়ে, শিক্ষা উপকরণের অপ্রতুলতা নিয়ে, ঠিকমতো বই-খাতা না পেয়ে বড় হতে হয় তাদের। শিশু অধিকারের যাবতীয় সনদ এখানে মাথা নিচু করে থাকে। ভাবতে পারি না।
আমার মনে আছে, চির অবহেলিত হাওরাঞ্চলে শিক্ষার হার বাড়ানো ও দরিদ্র পরিবারের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনার জন্য প্রতিটি উপজেলায় একটি করে আবাসিক প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেটা ২০১৬ সালে। এ ঘোষণার প্রায় দুই বছর অতিবাহিত হওয়ার পথে, কিন্তু আলোর মুখ দেখছে না এই প্রকল্পটি। না, এই কাজ করলে এখানকার শিক্ষায়, শিক্ষার ব্যবস্থাপনায় এমন কোনো পরিবর্তন হবে না; এ তো জানা কথা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর আমরা মনে করেছিলাম, তিনি এ নিয়ে ভাবছেন। আরও কিছু হবে, আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু না, কিছু হয়নি।
এবার একটু পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেব। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের ‘বিদ্যালয় সম্পর্কিত তথ্য’ থেকে জানা যায়, জেলায় ১৪৬৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। কিন্তু ভয়াবহ ব্যাপার হলো, ১৬৬টি গ্রামে এখনো কোনো বিদ্যালয়ই নেই। হয়তো এ গ্রামের শিশুরা পাশের গ্রামে পড়তে যায়, অথবা অনেকেই হয়তো যায় না। পত্রিকার খবরে পড়েছি, ঝড়-তুফানে ভেঙে পড়ায় এবং চরম ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় জেলার ৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা খোলা আকাশের নিচে পড়ছে। এখানকার ১৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন পরিত্যক্ত। আর ১২৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন চরম ঝুঁকিপূর্ণ। মৃত্যুকে হাতে নিয়ে শিশুরা পড়তে যায় মধ্যবয়সি এদেশে, ভাবলে ভালো লাগে না। আমাদের ফাইভ জি ইন্টারনেট স্পিড দিয়ে কি হবে, এদের পড়ার জায়গা যদি না থাকে?
এখনো হাওরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুল আর বাড়ির মাঝে পথটি পার হতে হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। এখানে বর্ষায় একমাত্র ভরসা নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো, না হয় কাঠের ছোট নৌকা। আবার নৌকা কেনার সামর্থ নেই অনেকেরই। তাই সড়ক পথের ব্যবস্থা না থাকার কারনেই বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। অবশ্য অনেক গ্রামে স্থানীয়দের উদ্যোগে নির্মিত হয় বাঁশের সাঁকো। আর সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকার ফলে অনেক শিক্ষার্থীরাই বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে। আবার একই কারণে শিক্ষকগণ সময়মতো উপস্থিত হতে পারেন না। জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোতে শিক্ষার প্রসারে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যকর কোনো কিছুই এখানে কেউ করছেন না। অবশ্য পত্রিকায় পড়েছি, ভিন্ন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের এই জলাভূমি অঞ্চলের জন্য স্থানীয় শিক্ষাবিদ ও প্রাথমিক বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা নানা পরামর্শ-পরিকল্পনার দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু যুগ যুগ ধরে সেই গুরুত্বপূর্ণ দাবি অপূর্ণই রয়ে যাচ্ছে।
হাওরের স্কুলগুলোতে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১১.৯৫ ভাগ। আর এখানের শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় অংশ হলো নারী। দুর্গম এই অঞ্চলে কর্মরত শিক্ষকদের যথাসময়ে স্কুলে পৌঁছাতে রীতিমতো প্রতিদিন যুদ্ধ করতে হয়। আর প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা নানা অসুবিধার কারণে প্রায়ই হাওরের দুর্গম এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অনুপস্থিতি বা দেরিতে স্কুলে যাওয়া এজন্য লক্ষ করা যায়। তাছাড়া লোকালয়ের অধিকাংশ বিদ্যালয়ের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই। বর্ষায় দ্বীপগ্রামের এসব বিদ্যালয়ে যেতে চরম বেগ পেতে হয় শিক্ষকদের। বিশেষ করে আফালের কারণে দুর্ঘটনার ভয়ে নৌকা চালকরা নৌকা চালাতে অপরাগতা প্রকাশ করে, প্রতি বছর হাওরে শিক্ষার্থীদের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। প্রায় প্রায় বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে শিক্ষার্থীরা নৌকা উল্টে ডুবে মারা যায় এবং এমন খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এভাবে প্রতি বছরই বর্ষা মওসুমে দুর্ঘটনার শিকার হয় হাওরের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা।
হাওর অঞ্চলে যোগাযোগ অসুবিধার কারণে বাইরের অন্যান্য জেলার শিক্ষক বা শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা এখানে যোগদান করার পর সারাক্ষণ বদলি হওয়ার চিন্তায় অস্থির থাকেন। ফলে এখানে বঞ্ছিতরা চিরকাল না পাওয়াকেই আগলে ধরে এগিয়ে যাওয়ার যুদ্ধ করেন। হাওরের জন্য আলাদা শিক্ষানীতি না করলে এখানকার শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে থাকবে। আর বড় এই সংখ্যাটিকে এড়িয়ে গেলে শিক্ষায় এসডিজি অর্জন সহজে হবে না। এও ঠিক যে, অনেকগুলো সমস্যা এক দিনেই হয়তো সমাধান হবে না। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে যেসব ঘোষণা দেয়া হয়, যেসব প্রতিশ্রুতির কথা আমাদের কানে আসে; তার কিঞ্চিত কি বাস্তবতার সমান্তরালে আসে? সংশ্লিষ্টরা বলবেন, হচ্ছে; বাস্তবে কতোটা হচ্ছে, তা গ্রামে যখন যাই মাঝামাঝে টের পাইতো!
প্রকাশিত পত্রিকা- দেশবার্তা, ১২ জুন, ২০২০