হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নেপালযাত্রা

হাসান হামিদ

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছিলেন বিখ্যাত বাঙালি ভারততত্ত্ববিদ, সংস্কৃত বিশারদ, পুঁথি সংগ্রাহক, সংরক্ষণবিদ ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা। তার আসল নাম ছিল হরপ্রসাদ ভট্টাচার্য। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের আবিষ্কারক তিনি। ১৯৩১ সালের ১৭ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।
আমরা যখন স্কুলে পড়ি, তখনই এঁর নাম জেনেছি! যদিও কী যে চর্যাপদ, তার কীই-বা মহত্ত্ব এর সেসব ভাবনার বাইরে। এই জিনিস যার হাত ধরে সকলের সামনে আসে, তিনি হরপ্রসাদ। অবশ্য তাঁর প্রথম নাম এটি ছিল না। জন্মের সময় নাম রাখা হয়েছিল শরৎনাথ। ছেলেবেলায় মারাত্মক অসুখ হয়েছিল তাঁর। এতে চিন্তায় পড়ে যান বাবা-মা সকলেই। কিছুতেই রোগ ভালো হচ্ছিল না যে! ঘটনাক্রমে এই রোগ থেকে আরোগ্য লাভের জন্য শিবের কাছে মানত করে নাম বদলে রাখা হয় হরপ্রসাদ।
ইতিহাসে প্রাপ্ত তথ্যমতে, হরপ্রসাদের পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল খুলনা জেলার কুমিরা গ্রামে। তাঁর প্রপিতামহ মাণিক্য তর্কভূষণ এককালে নৈহাটিতে বসতি গড়ে তোলেন। এই মাণিক্য তর্কভূষণ পাণ্ডিত্যের খ্যাতিতে সেই সময়ে গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস এবং এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোন্সের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সে যাই হোক, ১৮৬১ সালে হরপ্রসাদের বাবা মারা গেলেন। এর ঠিক এক বছর পর ১৮৬২ সালে বড়দাদা নন্দকুমারের মৃত্যুতে হরপ্রসাদের পুরো পরিবার বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এ সময় পরিবারটিকে নানা সহায়তা দিয়ে রক্ষা করেন তাঁদের শুভানুধ্যায়ী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। জানা যায়, বিদ্যাসাগরের সহায়তায় ও পরামর্শে হরপ্রসাদ ১৮৬৬ সালে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। কঠোর জীবন-সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে পড়াশুনাও চালিয়ে যান তিনি।
হরপ্রসাদ পড়াশোনা করতেন। পাশাপাশি অল্প লেখালেখিও চলতো। তাঁর প্রথম লেখাটি প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শন পত্রিকায়। সেই সময় তিনি ছিলেন ছাত্র। ভাবা যায়? পরে এক সময় হরপ্রসাদ এই পত্রিকার নিয়মিত লেখকে পরিণত হন এবং নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতে থাকেন। তাঁর এভাবে কিছুটা পরিচিতি আসে। ঘটনাক্রমে একসময় এশিয়াটিক সোসাইটিতে বিশিষ্ট ভারততত্ত্ববিদ রাজেন্দ্রলালের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন হরপ্রসাদ। তখন তাঁকে ভারততত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহী করে তোলেন এই রাজেন্দ্রলাল মিত্র বাবু। রাজেন্দ্রলালের ‘দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার অফ নেপাল’ গ্রন্থে সঙ্কলিত বৌদ্ধ পুরাণগুলির অনুবাদ শুরু করেন হরপ্রসাদ। আর সোসাইটিতে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সাথে পুঁথি সংগ্রহের কাজ শুরু করেন তিনি। বিশেষভাবে পুঁথির সন্ধান এবং সংগ্রহ, এসবের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করা- এসব কাজ চলতে থাকে। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার অফ নেপাল’ গ্রন্থের ভূমিকায় রাজেন্দ্রলাল মিত্র হরপ্রসাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, এ বইয়ের ১৬টি দীর্ঘ অধ্যায় হরপ্রসাদের রচনা। সংস্কৃত পুঁথি নিয়ে চর্চা করতে করতেই হরপ্রসাদ বাংলা পুঁথির বিষয়েও আগ্রহী হয়ে ওঠেন ধীরে ধীরে।
এইসব কাজে তাঁরা যখন খুব ব্যস্ত এর মাঝে ১৮৯১ সালে ভয়ানক অঘটন ঘটে। হঠাৎ করেই রাজেন্দ্রলালের মৃত্যু হয়। সব যেন কেমন থেমে যায়। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর হরপ্রসাদ এশিয়াটিক সোসাইটির সংস্কৃত পুঁথি অন্বেষণ বিভাগের পরিচালক পদে যোগ দেন। তাঁর দায়িত্ব এবং কাজ অনেক বেড়ে যায়। তিনি তখন নেমে পড়েন কাজে। এই সময় চৌদ্দ খণ্ডে সোসাইটির সংগ্রহের দশ হাজার পুঁথির এক বিশাল ক্যাটালগ তৈরি করেন হরপ্রসাদ। সহজেই আন্দাজ করা যায়, এ বিপুল পুঁথি-সংগ্রহের সূত্রে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর অনুসন্ধিৎসা ব্যাপ্ত হয়েছিল বাংলার বাইরের জনপদেও। পুঁথি সন্ধানের কাজে যেমন বাংলার বিভিন্ন এলাকা, উড়িষ্যা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানে বারবার গিয়েছেন, তেমনি নেপালেও গিয়েছেন চারবার।
প্রথমবার হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের মাটিতে পা রাখলেন ১৮৯৭ সালে। ততদিনে পুঁথি সংক্রান্ত গবেষণাও কিছুটা এগিয়েছে। নেপালে ঘুরতে ঘুরতে হাজির হলেন কাঠমান্ডুর রাজদরবারের গ্রন্থাগারে। বিশাল তার ভাণ্ডার, বিপুল আয়োজন। হরপ্রসাদ হাতে যেন একেবারে স্বর্গ পেলেন। সেই ঘরেই যেন গন্ধ পেলেন বাংলার প্রাচীন সময়ের। তালপাতার পুঁথিগুলো যে সাক্ষাৎ ইতিহাস, বুঝতে পারলেন তিনি। এর ঠিক পরের বছর, ১৮৯৮ সালে আবার গেলেন নেপালে। রাজদরবারের গ্রন্থাগারে আরও গভীর ডুব দিলেন হরপ্রসাদ। উঠে এল দুটি পুঁথি- ‘সুভাষিত সংগ্রহ’ ও ‘দোঁহাকোষ পঞ্জিকা’। এবার নেপাল ভ্রমণে সঙ্গী ছিলেন অধ্যাপক সিসিল বেন্ডেল; এ সময় তাঁরা সুভাষিত সংগ্রহ এবং দোঁহাকোষ-পঞ্জিকা পুথিদ্বয় নকল করে আনেন। পণ্ডিতমহলে আলোড়ন পড়ে গেল। ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপালযাত্রায় রাজদরবারের পুঁথিখানার অধ্যক্ষ বিষ্ণুপ্রসাদ রাজভাণ্ডারীর কাছ থেকে আরও দুটি পুঁথির সন্ধান পান। এছাড়া আরও সন্ধান পান ‘চৰ্য্যাচর্য্য বিনিশ্চয়’ নামক পুঁথি ও তার সংস্কৃত টীকার। মুনিদত্তের এ টীকাসহ খণ্ডিত পুথির সাড়ে ৪৬টি পদ বা চর্যা সম্পাদন করে দীর্ঘ নয় বছর পর বাকি তিনটি গ্রন্থসহ ‘হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় রচিত বৌদ্ধগান ও দোঁহা’ নামে প্রকাশ করেন। ১৯১৬ সালে লালগোলার রাজা রাও যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় বাহাদুরের সম্পূর্ণ অর্থানুকূল্যে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। রচয়িতা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দীর্ঘদিনের নেপাল যাত্রার ফলাফল প্রকাশিত হয় এই বইতে। হরপ্রসাদ এখানকার চারটি পুঁথিকে প্রাচীন বাংলার লেখা বলে ধারণা করেছিলেন। এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য – ‘আমার বিশ্বাস, যাঁরা এই ভাষা লিখিয়াছেন, তাঁরা বাঙ্গালা ও তন্নিকটবর্তী দেশের লোক। অনেকে যে বাঙ্গালী ছিলেন, তাহার প্রমাণও পাওয়া গিয়াছে। যদিও অনেকের ভাষায় একটু আধটু ব্যাকরণের প্রভেদ আছে, তথাপি সমস্তই বাঙ্গালা বলিয়া বোধ হয়’।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নিরলস গবেষণায় নিশ্চিত হওয়া গেল, এগুলো আসলে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন। সবাই প্রশংসা করতে লাগল। পাশাপাশি তর্ক-বিতর্কও দেখা দিল। যে তালপাতার পুঁথিটি পেয়েছিলেন হরপ্রসাদ, এর অনেকগুলো পাতা নষ্ট হয়েছিল। যাই হোক, এভাবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারে রয়েল লাইব্রেরি থেকে মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ আবিষ্কার করেন। এর মধ্যে চব্বিশ, পঁচিশ এবং আটচল্লিশ নং পদ আর পাওয়া যায়নি। সুতরাং এর মোট পদসংখ্যা পঞ্চাশ। চর্যাপদ, নামান্তরে কখনো কখনো ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ বা ‘চর্যাগীতিকোষ’ এর রচয়িতার নাম ও সংখ্যাও এর বিষয় এবং ভাষার মতোই আলো আঁধারে খেলা করে। চর্যাপদের কবির সংখ্যা তেইশ। কবিদের মধ্যে মীনপা, কুক্করীপা, ঢেণ্ডনপা, সানুপা, চৌরঙ্গীপা, শবরীপা, লুইপা, বিরূপা, ডোম্বীপা, তেলিপা, পরোপা, দারিম্পা, ভুসুকুপা, কাহ্নপা- এদের নাম জানা যায়। এদের মধ্যে প্রাচীনতম কবি লুইপা না সরহপা, এ নিয়েও রয়েছে তর্ক। আর সবচেয়ে বেশি পদ রচনা করেছেন কাহ্নপা।
(তথ্যসূত্র: হরপ্রসাদ শাস্ত্রী– সত্যজিৎ চৌধুরী; সাহিত্য টিকা– সনৎকুমার মিত্র; বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা– ভুদেব চৌধুরী; বাংলা পিডিয়া)

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নেপালযাত্রা

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top