সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না : হাসান হামিদ

দেশের সড়ক-মহাসড়কের সর্বত্রই চলছে মৃত্যুর মহোৎসব। প্রতিদিনই একের পর এক তাজা প্রাণ হারিয়ে যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। এভাবে থমকে যাচ্ছে বহু পরিবার। আর যেসব লোক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন অথবা পঙ্গুত্ব জীবন যাপন করেন তাদের পরিবারের খবর কেউ রাখে না! দেশে কার্যকরী পদক্ষেপ নিলে এসব সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমে আসতো। সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা কিছুতেই কমছে না, বরং দিন দিন বাড়ছে। অবস্থা ‘মহামারী’ আকার ধারণ করেছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। একটি ঘটনার রেশ না কাটতেই ঘটছে আরেকটি ঘটনা। আবার সব ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসছে, তাও কিন্তু নয়। কিন্তু যেগুলো আসছে, তাতেই অবস্থা যে খারাপ সেটি স্পষ্টই বোঝা যায়।

পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৬৪ জন৷ আর এই সংখ্যা বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহতদের সংখ্যার মধ্যে সর্বোচ্চ৷ সেন্টার ফর ইনজ্যুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)-এর জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে৷ আরেকটি পরিসংখ্যান বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বছরে গড়ে বাংলাদেশের জিডিপির শতকরা দেড় ভাগ নষ্ট হয়, যার পরিমাণ অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকা। বিগত ৬ বছরে সারা দেশে ৩১ হাজার ৭৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৯১ হাজার ৩৫৮ জন। এ ছাড়া ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণে বছরব্যাপী লকডাউনে পরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায়ও ৪ হাজার ৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত ও ৮ হাজার ৬০০ জন আহত হয়েছেন। আর ২০২১ সালে সারা দেশে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। (তথ্যসূত্র- বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রকাশিত প্রতিবেদন) সূত্র বলছে, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৩৮ হাজার কোটি টাকা। যা আমাদের জিডিপির দেড় শতাংশ। ২০২০ সালে এই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। আর ২০২১ সালে দুর্ঘটনায় মানবসম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা জিডিপির দশমিক ৩ শতাংশ।

সরকারি ও বেসরকারিভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধের জন্য কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর করা হচ্ছে না। গাড়িচালকের সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকা, দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো, ওভারটেক করাসহ বিভিন্ন কারণে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার বাড়ছে। আর এই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে দেশে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য ১ হাজার ১৩৩ যানবাহন রয়েছে, চীনে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য রয়েছে ১৮ হাজার, ভারতে প্রায় ১৩ হাজার আর পাকিস্তানে প্রায় ৫ হাজার। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি দুজনে একটি করে যানবাহন রয়েছে। অথচ এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা অনেক বেশি।

আমাদের দেশে বিগত কয়েক বছরে সড়কের তুলনায় মোটরযানের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। একই সড়কে চলছে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, রিকশাসহ নানা রকম মিশ্র যানবাহন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এক হিসাব অনুযায়ী দেশে মোট নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৪৫ লাখ ৬৮ হাজার ৮৭৮টি। বেসরকারি হিসাবে-সড়ক-মহাসড়কে নিবন্ধিত গাড়ির বাইরে ফিটনেসবিহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ আরও কয়েক লাখ গাড়ি চলাচল করে। উপরন্তু সড়ক ও মহাসড়কগুলো ত্রুটিপূর্ণ। দেশব্যাপী মহাসড়কের অনেক স্থানেই রয়েছে বিপজ্জনক বাঁক। এসব বাঁকের কারণে প্রায়শই সেসব জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়া অবকাঠামোগত কারণেও দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকি খুব বেশি বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। সম্প্রতি দুর্ঘটনা মহামারীর আকার ধারণ করার জন্য যেসব কারণকে দায়ী করা হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চালকের অসতর্কতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো। এই সমস্যা বার বার চিহ্নিত হলেও এর কোন প্রতিকার নেই।

পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৯০ দশমিক ৬৯ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী অদক্ষ চালক। আর নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) বলছে, সারা দেশে অন্তত ২৪ লাখ লাইসেন্সবিহীন চালক সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা বলছে, ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২৬৬ জন চালক নিহত হয়েছে। যা তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট নিহতের ২৫ শতাংশ। আবার যাত্রী কল্যাণ সমিতির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা ৩০ লাখের মতো। অনেক চালক কথিত ওস্তাদের কাছ থেকে শিখে রাস্তায় নেমেছে। আর পুলিশের অভ্যন্তরীণ পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে ৮৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ চালকের বেপরোয়া গতি। দুর্ঘটনার আরো একটি অন্যতম কারণ হলো ঘুম ঘুম অবস্থায় গাড়ি চালনা। একজন চালকের কোন অবস্থাতেই একটানা ৫ ঘন্টার উপর গাড়ি চালানো নিষেধ। অথচ আমাদের দেশের বাস এবং ট্রাকের চালকরা একটানা ১৫/১৬ ঘন্টা গাড়ি চালাচ্ছে। বিশ্রাম ব্যতিত গাড়ি চালানোর ফলে তাদের চোখে অনেক সময় ঘুম চলে আসে। ফলে ঘটে যায় মারাত্মক দুর্ঘটনা।

বর্তমানে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে যুব সমাজ হেলমেট বিহীন বিশেষ স্টাইলে লুকিং গ্লাস ব্যতীত দ্রুতগতিতে অধিক সিসি যুক্ত মোটর সাইকেল চালাচ্ছে। ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা। অনেক মা-বাবা হারাচ্ছেন তাদের প্রিয় সন্তানদের। বুয়েটের এক গবেষণা বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০ বছরের নিচে তরুণ প্রজন্মের মৃত্যুহার বেশি। কারণ তরুণদের বেশির ভাগই মোটরসাইকেল আরোহী। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার পরিমাণ ২০১৯ সালে ছিল ২০ দশমিক ২ শতাংশ। সেটা এখন ২৩ শতাংশে চলে গেছে। আর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ক্যান্সারের সেলের মতো এই যানের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু মোটরসাইকেল চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। ২০১৬ সালে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল আট লাখ ২০২০ সালে, সেটা ৩২ লাখে দাঁড়িয়েছে। চার বছরে মোটরসাইকেলের সংখ্যা চারগুণ বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মোটরসাইকেল ৪ চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু দেশে গণপরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য না হওয়া এবং যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে। গত বছর সবচেয়ে বেশি হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা।

পরিসংখ্যান বলছে, ৫ হাজার ৩৭১টি দুর্ঘটনার মধ্যে ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ২১৪ জন। যা মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অন্য যানবাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ২১ দশমিক ১২ শতাংশ, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৫ দশমিক ২৭ শতাংশ, মোটরসাইকেলে ভারী যানবাহনের চাপা ও ধাক্কা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪৩ দশমিক ৭ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে শূন্য দশমিক ৫২ শতাংশ।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করতে হলে সরকারের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে গাড়ির চালক, মালিকসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত দেশের মানুষ সচেতন না হবে ততক্ষণ সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা যাবে না। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু শুধু একটি পরিবারে গভীর শোক, ক্ষত সৃষ্টি করে না, ওই পরিবারকে আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে ফেলে। কোনো কোনো দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি প্রাণ হারান। তখন ওই পরিবারের যে কী অবস্থা হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর যারা পঙ্গুত্ববরণ করে তাদের পরিবারের অবস্থা আরও করুণ, আরও শোচনীয়। প্রতিবার দুর্ঘটনার পর পরই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই তদন্ত প্রতিবেদন কোনোদিন আলোর মুখ দেখে না, দোষীদের শাস্তিও হয় না। সমাজের উঁচু স্তর থেকে নিচু শ্রেণির মানুষ- যারাই দুর্ঘটনার শিকার হন না কেন, কোনো একটি ঘটনার বিচার হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত মেলা ভার। আর বিচারহীন, প্রতিকারহীন অবস্থায় কোনো কিছু চলতে থাকলে সেটির পুনরাবৃত্তিও তো ঘটবেই।

সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না : হাসান হামিদ

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top