হাসান হামিদ
প্রথমেই একজনের গল্প বলি। ভদ্রলোক ২১ বছর বয়সে ব্যবসায় লোকসান দিয়ে পথে বসে যান। এরপর অনেক চেষ্টা করেও ২২ বছর বয়সে আইনসভার নির্বাচনে পরাজিত হন। ২৪ বছর বয়সে আবারো ব্যবসাতে লস হয় তাঁর। গুদের উপর বিষের ফোড়াঁর মতো এ দূরাবস্থায় ২৬ বছর বয়সে প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারান। পরে ২৭ বছর বয়সে নার্ভাস ব্রেক ডাউনের শিকার হন। ৩৪ বছর বয়সে কংগ্রেস নির্বাচনে পরাজিত হবার পর ৩৭ বছর বয়সে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেও জয়ী হতে পারেননি। পরবর্তীতে ৪৫ বছর বয়সে এবং আবারো ৪৯ বছর বয়সে সিনেট নির্বাচনে পরপর পরাজিত হন তিনি। অবশেষে ৫২ বছর বয়সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিবাচিত হন আগের সমস্ত সময় ধরে ব্যর্থ হয়ে আসা এই লোকটি। ভদ্রলোকের নাম আব্রাহাম লিংকন। গেটিসবার্গে দেওয়া তাঁর বিখ্যাত ভাষণ “ Democracy is by the people, of the people, for the people” কথাটি গণতন্ত্রের এ যাবত কালের সেরা সংজ্ঞা হিসেবে পৃথিবীব্যাপী প্রতিষ্ঠিত।
আসলে সফলতা অনেক বিস্তৃত একটা ব্যাপার, এটা একদিনে অর্জিত হয় না। আর কোন একটা ব্যাপারে অকৃতকার্য হলেই মানুষ ব্যর্থ হয়ে যায় না। বড় হওয়ার তীব্র বাসনাই মানুষকে পরবর্তীতে বড় করে তোলে। কোন একটা পরীক্ষায় একটু খারাপ ফলাফল করলেই আমাদের বাবা মায়েরা মনে করতে থাকেন এই সন্তান অকর্মা হবে। আসলে এটি মোটেই ঠিক ধারনা নয়। শিশু শিক্ষার্থীর মনে কখনোই তাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না এমন কিছু ব্যাপারকে জায়গা করে নিতে দেয়া যাবে না। শিশুটি যেন বিশ্বাস করতে শুরু না করে যে, সে পারবে না। গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বাসের প্রথম প্রভাব পড়ে মনে। মন প্রোগ্রাম পাঠায় মস্তিষ্কে আর মস্তিষ্ক সেটা পাবার ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করে। নোবেলবিজয়ী নিউরো সায়েন্টিস্ট রজার স্পেরি “Mind, Brain & Humanist Values” নিবন্ধে মনকে ৫০ কোটি বছরের বিবর্তনের সর্ব্বোচ্চ অর্জন বলে অভিহিত করেছেন।
আরেক নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী স্যার জন একলস “Evolution of the Brain: Creation of the self” গ্রন্থে মনকে বর্ননা করেছেন আত্মসচেতন, সক্রিয় অনুসন্ধিৎসু স্বতন্ত্র প্রক্রিয়ারূপে। শিশুদের মন যা ভাবে, তার সেই ভাবনাটাই একসময় বিশ্বাস হয়ে যায় এবং তারপর মস্তিষ্কের মাধ্যমে সেটি কর্মফলে দারুণ প্রভাব ফেলে। কানাডার বিখ্যাত নিউরো সার্জন ড. ওয়াইল্ডার পেনফিন্ড তাঁর “The Mystery of the Mind” গ্রন্থে আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, “মস্তিষ্ক হচ্ছে কম্পিউটার, যা মনের প্রোগ্রাম অনুসারে পরিচালিত হয়”। তাই বলা যায়, মন হচ্ছে মস্তিষ্কের আসল পরিচালক। পরিবারের ছোটদের মনে সে কারণে বড় হওয়ার অদম্য ইচ্ছা লালনের জন্য উৎসাহিত করতে হবে, তাদেরকে স্বপ্ন দেখতে শিখাতে হবে। আসলে বড় হবার প্রথম পদক্ষেপটি হচ্ছে স্বপ্ন দেখতে শিখা। আর বড় হওয়ার এই স্বপ্নটি একসময় বিশ্বাসে রূপান্তরিত হবে। মহাত্মা গান্ধী তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, “স্বপ্ন দেখাতেই বড় গৌরব নিহিত, শুধু স্বপ্ন বাস্তবায়িত করায় নয়”।
বড় হবার, দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার দীক্ষাটি দিতে হবে পরিবারের বড়দেরকেই। আর স্বপ্নটি যখন শিশুটির বিশ্বাসের জায়গায় চলে যাবে তখন সেই বিশ্বাসটিই তাকে বড় হবার জন্য তাড়া করে বেড়াবে। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ড. এ পি জে আবুল কালাম তাঁর আত্মজীবনী “Wings of fire”-এ বলেছেন, “মানুষ ঘুমিয়ে যা দেখে তা স্বপ্ন নয়, স্বপ্নহলো সেটা যা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না”। আগস্ট কেফিউল বলেছিলেন, “আগে আমরা স্বপ্ন দেখতে শিখি, তারপর হয়তো আমরা সত্যের সন্ধান পেতেও পারি”। তবে আমাদের দেশে তরুণ শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটাতে কৃপণ হতে লক্ষ করা যায়। বেশিরভাগ তরুণের ক্ষেত্রেই পড়াশোনা শেষ করে কোনরকম খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মতো একটা চাকরিই এদের স্বপ্ন হয়ে উঠে।
একটা শিশু যখন বড় হতে থাকে; প্রথমত তাকে মহৎ হওয়ার বিষয়ে ধারণা দিতে হবে। পৃথিবীটা অনেক বড়। ভাববার মতোন, করবার মতোন অনেক কাজই আছে এখানে। কোন একটা শিশুকে আমরা যখন তার ভবিষ্যতের সীমারেখা একেঁ দিচ্ছি; আমরা তখন ভাবছি না- মুখস্থ করা স্বপ্নের কথা বিশ্বাস করিয়ে দেশের অনেক বড় সম্বাবনাকে আমরা হয়তো হারিয়ে ফেলছি। আমরা ধরেই নিয়েছি, সাফল্য হলো পড়া শেষ করে চাকরি পাওয়া। অথচ সফলতার সংজ্ঞা অন্যরকম, আমরা যদি আমাদের আশেপাশের মানুষগুলোকে স্বার্থহীনভাবে ভালোবাসতে না পারি, তবে নিজেকে সফল মানুষ হিসেবে দাবীও করতে পারি না। শিশুকে শিখাতে হবে মহত্ত্ব, শিখাতে হবে সত্যিকারের বড় হওয়া।
বাবা মায়েরা নিঃসন্দেহে শিশুর ভালো চান। কিন্তু, একটা পরীক্ষায় একটু খারাপ ফলাফল কিংবা পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চার সাথে প্রতিযোগীতা করতে গিয়ে তারা তাদের উল্টো ক্ষতি করে বসেন। তারা ভুলে যান বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সেই বিখ্যাত কথাগুলো, “পৃথিবীতে সকলেই জিনিয়াস, কিন্তু আপনি যদি একটা মাছকে গাছ বেয়ে ওঠার সামর্থ্যের ওপর বিচার করেন, তবে মাছটি সারাজীবন নিজেকে অপদার্থই ভেবে যাবে”।
সুতরাং, বড়রা যেনো ছোটদের একটা পরীক্ষার ফলাফলে অসন্তুষ্ট হয়ে তার মনের বিশ্বাসকে বদলে না দেন। কারণ, হয়তো এ বিশ্বাস বদলে দেবার কারণে বাংলাদেশ হারাবে অনেক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতকে।
প্রকাশিত পত্রিকা-
দৈনিক মানবজমিন ০১/০৩/২০১৭
বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম ০৩/১১/২০১৭
তারুণ্যলোক ম্যাগাজিন ১৭/১০/২০১৮
শিক্ষাবার্তা ১৮/১০/২০১৮