হাসান হামিদ
একবার আইনস্টাইনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এক মা, “আমার ছেলেটাকে বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে কী করতে হবে?” আইনস্টাইন উত্তর দিয়েছিলেন,“ওকে রূপকথা পড়ে শোনান। আর আমার চেয়েও বড় বিজ্ঞানী যদি বানাতে চান, তবে তাকে আরও বেশি করে রূপকথা শোনান!”আমাদের বাংলাদেশ এবং বিদেশের স্কুলে আগে কবিতা বা ছড়া মুখস্থ করার একটা প্রথা ছিল। গত কয়েক দশকে সে প্রথা বাতিল হয়েছে, সম্ভবত কোনো একদল নালায়েক শিক্ষাবিদের পরামর্শে: ‘মুখস্থ করা চলবে না, সবাইকে সৃজনশীল হতে হবে!’ এটা কি ঠিক নয় যে, সৃজনশীলতার সঙ্গে স্মৃতিশক্তির একটা সম্পর্ক থাকাটা সম্ভব! বাচ্চাদের যদি কবিতা বা ছড়া মুখস্থ করানো হয়, তবে তার স্মৃতিশক্তি বাড়বে, কবিতার প্রতি তার একটা ভালোবাসা দাঁড়িয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। তাছাড়া প্রতিটি মানুষ আলাদা। প্রত্যেক শিশুর মেধা আছে, আলাদা আলাদা মেধা। আমাদের দেশে ২০০৯ থেকে মেধাবী প্রজন্ম করার এক বিরাট প্রকল্প চালু করা হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম এদেশে বিজ্ঞানী, লেখক, মেধাবী নেতৃত্ব এর মাধ্যমে তৈরি হবে। কিন্তু উদ্বেগ নিয়ে আমি লক্ষ করেছি, প্রশ্নপত্র যতটুকুই হোক হয়তো একটা সৃজনশীল কাঠামোতে দাঁড় করানো হয়েছে; কিন্তু সৃজনশীল পদ্ধতি সুতরাং প্রশ্ন কমন পড়বে না ভেবে আমাদের অনেক ছেলেমেয়ে বই কম পড়ছে; আর যা তা বানিয়ে লিখে পরীক্ষা দিচ্ছে এটা ভয়াবহ একটা বিষয়, অন্তত মেধাবী প্রজন্ম তৈরিতে। তারচে বড় কথা, গত বছর পাবলিক পরীক্ষায় হুবহু বিভিন্ন প্রচলিত গাইড বই থেকে যখন প্রশ্ন এসেছে, তখন একে আর কি সৃজনশীল পদ্ধতি বলা চলে?
সৃজনশীল প্রশ্নের প্রবর্তক একক ব্যাক্তিকে বলা ভুল হবে। তবুও এর জনক হিসেবে বেঞ্জামিন স্যামুয়েলকে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৫৬ সালে তিনি সর্বপ্রথম এর ধারনা দেন। পরবর্তিকালে এর বিভিন্ন পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটে। বেঞ্জামিন স্যামুয়েল ব্লুমের এ বিষয়ক তত্ত্বটি Bloom Taxonomy হিসেবে পরিচিত। সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির উদ্ভাবনের বা এর প্রচলনের প্রধান কারন মুখস্থনির্ভরতা থেকে ছাত্রছাত্রীদের মুক্তি দেওয়া। সাধারণ পদ্ধতিতে স্টুডেন্টরা কোনো বিষয়ে কেবল একটি স্থির ধারনা পান। এর পরিবর্তনশীলতা, ব্যাখা বিশ্লেষণ ইত্যাদি তাদের কাছে অস্পষ্ট থাকে।
আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা শর্টকাট পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে অনেক আগেই। তারা জানে, ২০১৭ সালের পরীক্ষায় আশা প্রশ্ন বা বিষয় থেকে ২০১৮ সালে আসবে না। সুতরাং এ বিষয়গুলো আনুষ্ঠানিকভাবে বাদ দিয়ে পড়ানো হয়। আমি বুঝি না, কেনো ২০১৭ সালে আসা বিষয় ২০১৮ সালে আসতে পারবে না? দুই বছর তো দুটি ব্যাচ পরীক্ষা দেয়। সিলেবাস ভুল সিস্টেমে ছোট করে দেবার অর্থ কী?
কিন্তু ডিগ্রি বা কাগজের একটা সনদ নয়; বরং শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত মানবশিশুর মেধার স্ফুরণ । হাওয়ার্ড গার্ডনার তাঁর ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত ‘Frames of Mind: The Theory of Multiple Intelligences’ পুস্তকে নয় ধরনের মেধার কথা উল্লেখ করেছেন– ১. প্রকৃতি-মেধা: কোন উপাদানটি বিপজ্জনক আর কোনটি জীবনসহায়ক– আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ কেউ এই পার্থক্য করতে না পারলে মানুষের টিকে থাকা সম্ভব হত না। যাদের মধ্যে এই মেধা আছে তারা হয়তো সহজে বলতে পারে, কোন গাড়িটি, কোন মাংসটুকু বা কোন কোম্পানির ওষ্ঠরঞ্জনী ভালো কিংবা খারাপ; ২.সংগীত-মেধা: এই মেধা যাদের রয়েছে তারা সংগীতের স্বরলিপি-তাল-বিট ইত্যাদি খুব তাড়াতাড়ি বোঝে। এরা সাধারণত শুনে শুনেই গাইতে পারে বা কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শিখে যায়; ৩. যুক্তি-গণিত মেধা: যারা এই মেধার অধিকারী তারা সাধারণত অংকে ভালো হয়। বিভিন্ন সম্ভাবনা বা প্রস্তাবের (লজিক্যাল প্রপোজিশন) মধ্যে তুলনা করে, অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যার আরোহ-অবরোহ পদ্ধতি অবলম্বন করে এরা শার্লক হোমসের মতো দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে পারে। প্রকৃতিতে ও বাস্তবে বিভিন্ন ঘটনা বা বস্তুর বিভিন্ন প্যাটার্ন, ক্যাটাগরিকে আলাদা করতে পারে এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করতে পারে। এদের সাত-পাঁচ চৌদ্দ বোঝানো যায় না। এরা বিজ্ঞানী হয়, গোয়েন্দা হয়, অংকবিদ হয়; ৪. অস্তিত্ব-মেধা: এই মেধা যাদের আছে তারা জীবনের উদ্দেশ্য কী, মৃত্যুর পর কী হবে, এসব নিয়ে প্রশ্ন করে। সুতরাং এরা দার্শনিক, ধর্মপ্রচারক ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে; ৫. আন্তসম্পর্ক মেধা: এই মেধার অধিকারীরা অন্যের মনোভাব, ব্যক্তিত্বের ধরন, মানসিক অবস্থা বুঝে কার্যকর ভাষিক ও ইঙ্গিতনির্ভর যোগাযোগ করতে পারে। এই মেধার অধিকারী ব্যক্তিরা নেতা, শিক্ষক বা উকিল হিসেবে নাম করতে পারে; ৬. শরীর-সঞ্চালন মেধা: মন ও শরীরের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ সাধন করে সঠিক সময়ে শরীরের সঠিক অঙ্গটি সঠিক ভঙ্গিতে এবং সঠিক দিকে চালনা করার দক্ষতা থাকে এই মেধার অধিকারীদের। এরা সার্কাসে, খেলাধুলায় ভালো করে। ভালো ড্রাইভিং করার কথা এদের। এরা ভালো সার্জন হতে পারে; ৭. ভাষাগত মেধা: এই মেধার অধিকারীরা ভাষা ব্যবহারে দক্ষ হয়। এরা পড়তে, লিখতে, গল্প বলায়, তড়িৎ উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাওয়ায় দক্ষ হয়ে থাকে। এদের সাহিত্যিক, লেখক, বক্তা, চলচ্চিত্রকার ইত্যাদি পেশায় ভালো করার কথা; ৮. আত্মজ্ঞান মেধা: ‘আত্মানাম বিদ্ধি’ বা ‘নিজেকে জান’। যারা এই মেধার অধিকারী তারা ভালো করে জানে, কী তাদের দ্বারা করা সম্ভব এবং সম্ভব নয় এবং সেই অনুসারে তারা জীবনে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়। অন্য কারো কাছ থেকে এদের অনুপ্রেরণা পাওয়ার প্রয়োজন নেই। মনস্তত্ত্ববিদ, নবী, দার্শনিক, ধর্মগুরুদের মধ্যে এই মেধা দেখা যায়; ৯. স্থানিক মেধা: নিজের অবস্থান এবং চতুর্পাশের ছবি অথবা মনে আগে থেকে থাকা ছবি দ্রুত বিশ্লেষণ করে যুক্তির ভিত্তিতে এরা পরবর্তী পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যদিও গার্ডনারের এই নবমেধার সঙ্গে সবাই একমত নন এবং অনেক ক্ষেত্রে একটি মেধাকে অন্যটি থেকে ঠিকঠাকমতো আলাদাও করা যায় না; তবুও এটুকু স্বীকার করতে বাধা নেই যে, ‘হোমো সাপিয়েন্স’ মানবের মধ্যে এসব মেধা কমবেশি ছিল বলেই মানবজাতি টিকে থাকতে পেরেছে এবং মানবসমাজ গঠিত হতে পেরেছে ।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়েছিল ছাত্র-ছাত্রীদের সৃজনশীল করে তোলার উদ্দেশ্যে। এর আগে যে ধারা চালু ছিল, তাতে একজন ছাত্র বা ছাত্রী কতটুকু সৃজনশীল তা বোঝার উপায় ছিল না। তারা গতানুগতিক কিছু প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে আসত। মুখস্থ করে কোনো বিষয়ে ভালো ফল অর্জন ওই বিষয়ে পারদর্শিতার মাপকাঠি নয়। সুশিক্ষা মানে পারদর্শী হওয়া, সৃজনশীল হওয়া। কিন্তু সে পদ্ধতি কার্যকরের আগে আমাদের সম্মানিত শিক্ষকদের (সব বিদ্যালয়ের অন্তত ৩০%) প্রশিক্ষণের আওতায় আনা উচিত ছিল।কিন্তু তা হয়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের একাডেমিক পরিদর্শন প্রতিবেদনে এসব অভিযোগের সত্যতাই প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫২.০৫ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এখনো সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না। ৩০.৮৯ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তায় প্রশ্ন তৈরি করেন। আর শিক্ষক সমিতি থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করেন ২১.১৭ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সবচেয়ে পিছিয়ে বরিশাল অঞ্চল। এ বিভাগের ৭৯.২৪ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। সবচেয়ে এগিয়ে কুমিল্লা অঞ্চল। সেখানকার ৭২.৯২ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন। ঢাকার ৫২.৫১ শতাংশ, ময়মনসিংহের ৭৬.৫৫, সিলেটের ২৮.১৪, চট্টগ্রামের ৫০.৯৪, রংপুরের ৫০.৫২, রাজশাহীর ৪৬.৫৬ ও খুলনার ৩৫.১২ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না।
ছাত্র-ছাত্রীদের সৃজনশীল করে তোলার মুখ্য দায়িত্ব শিক্ষকদের। তাঁরা সৃজনশীল পদ্ধতি না বুঝলে সে অনুযায়ী পাঠদান সম্ভব নয়। আর সেটি না হলে ছাত্র-ছাত্রীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ সম্ভব নয়। এ কারণেই কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষাবিদরা, অভিভাবকরা এ কথাই বলে আসছেন। বিষয়টি সুখকর নয়। প্রশিক্ষণের ঘাটতি থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরকে। ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি সারতে হবে। পদ্ধতির সফলতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আর এভাবেই লেখাপড়া ভয়ের নয়, আনন্দের বিষয় হবে এবং এর সঙ্গে প্রকৃতি, সমাজ ও বিশ্বের সার্বক্ষণিক যোগ থাকতে হবে। শুধু সৃজনশীল প্রশ্ন করে প্রজন্মকে মেধাবী করা যাবে না, সাথে সাথে তারা কী লিখছে, তাও খতিয়ে দেখতে হবে।
‘শিক্ষাসমস্যা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের সুপারিশটির কথা বলে আজকে শেষ করবো। তিনি সেখানে বলেছেন, “বালকদিগের হৃদয় যখন নবীন আছে, কৌতুহল যখন সজীব এবং সমুদয় ইন্দ্রিয়শক্তি যখন সতেজ তখনই তাহাদিগকে মেঘ ও রৌদ্রের লীলাভূমি অবারিত আকাশের তলে খেলা করিতে দাও…তরুলতার শাখাপল্লবিত নাট্যশালায় ছয় অঙ্কে ছয় ঋতুর নানারসবিচিত্র গীতিনাট্যাভিনয় তাহাদের সম্মুখে ঘটিতে দাও” কবিগুরুর এ সুপারিশের আলোকে বলা যায়, শুধু একটা কাগজে কিছু সৃজনশীল নামের কিছু প্রশ্ন ছেপে নয়; মেধাবী প্রজন্ম পেতে আমাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেশের প্রকৃতি, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদির পরিচয় ঘটাতে হবে। প্রবাদ আছে: “বিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কহীন জীবন অন্ধ এবং জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন বিদ্যা পঙ্গু।” আর তাই, জীবনের সঙ্গে, প্রকৃতি আর সংস্কৃতির সঙ্গে ছেলেমেয়েদের পরিচয়টা জোরেশোরেই করতে হবে, তাহলে আমরা মাথা উঁচু করে বলার মতো একটা মেধাবী প্রজন্ম পেতে পারি; নয়তো নয়!
প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক যুগান্তর ২২/১১/২০১৭, শিক্ষাবার্তা ২২/১১/২০১৭