সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আসলে কেমন হওয়া উচিত?

হাসান হামিদ

দেশের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে এ লেখাটি শুরু করার আগে আমি প্রকল্পটির পরিচালক এবং বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব সিদ্দিকুর রহমানের সাথে ফোনে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলি। লেখালেখির প্রয়োজনে এর আগেও আমাকে সরকারের অনেক সচিব কিংবা মন্ত্রীর সাথে আলাপ করতে হয়েছে। রাত বারোটার পরেও আমি তোফায়েল আহমেদ সাহেবকে কল করেছিলাম একদিন, তিনি তখন সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রী। আমার মনে আছে, প্রথম রিং বাজতেই তিনি আমার কল রিসিভ করে কথা বলেছেন। আমি অভিভূত হয়েছি। অবশ্য এ রকম দায়িত্বশীল সবার সাথে কথা বলে, জেনে সবসময় তৃপ্তি পেয়েছি তা নয়। অনেক সময় কারও কারও মন্তব্যে হতাশ হয়েছি। দুয়েক জনের সাথে ভুল বুঝাবুঝিও হয়েছে। পরে ব্যক্তিগতভাবে হয়তো স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি, কিন্তু কিছু বিষয় অমসৃণ থেকে গেছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বর্তমান পরিচালকের মন্তব্যে অনেক আশাবাদী হওয়ার মতো ব্যাপার লক্ষ করেছি আমি। তবে এ প্রকল্প নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ইতিহাস নতুন নয়। আজ থেকে অনেক দিন আগে যখন রাষ্ট্র ছিল না, সমাজ ছিল; তখনও মানুষের কল্যাণে এ রকম কর্মসূচি চালু ছিল ভিন্ন আদলে। ইতিহাস বলে, শিল্পবিপ্লবের পরে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায়। আমরা জানি, ইংল্যান্ডে দরিদ্র জনগণের সহায়তার জন্য ১৫৩১ ও ১৬০১ সালে দরিদ্র আইন তৈরি হয়েছিল। আজ থেকে প্রায় একশো চল্লিশ বছর আগে ১৮৮৩ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর অটোভন বিসমার্ক আধুনিক রাষ্ট্রের সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভাবেন। রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পর সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডি. রুজভেল্ট ১৯৩৫ সালে সামাজিক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেন। পরে ১৯৪২ সালে যুক্তরাজ্যে লর্ড উইলিয়াম বিভারেজ কর্তৃক প্রণীত রিপোর্টের ভিত্তিতে সামাজিক নিরাপত্তা আইন ও কর্মসূচি তৈরি হয়। লর্ড উইলিয়াম বিভারেজ এর বর্ণনায় সামাজিক নিরাপত্তা হচ্ছে, “A job when you can earn and an income when you cannot.” বর্তমান বিশ্বে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বিভিন্ন বীমা ও সাহায্যভাতার প্রচলন দেখা যায়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জন্মের পর যে সংবিধান রচিত হয় তাতে সামাজিক নিরাপত্তা মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এই সংবিধানে (পঞ্চদশ সংশোধন ২০১১ অনুচ্ছেদ ১৫ (ঘ) মৌলিক প্রয়োজন ব্যবস্থা) সামাজিক নিরাপত্তার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে- “সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্বাতীত কারণে অভাবগ্রস্থতার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্যলাভের অধিকার।” আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক উদ্যোগে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বয়স্কভাতা এবং ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে বিধবা, স্বামী নিগৃহীতা মহিলাভাতা, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানীসহ নানা ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করা হয়। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র, প্রতিবন্ধী শিক্ষা, উপবৃত্তি, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, জন্মগত হৃদরোগ, স্ট্রোক ও থ্যালাসেমিয়া রোগীদের আর্থিক সহায়তা, প্রতিবন্ধী মোবাইল থেরাপি ভ্যান চালুসহ নানাবিধ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। বর্তমান সরকারের সময় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা এবং উপকারভোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জানতে পেরেছি, দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ১২৫টি কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয় পেনশন, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ও বিধবা ভাতা, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং বা ভিজিএফে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির এই ব্যাপারগুলোতে চোখ বুলিয়ে বোঝা যায়, এই কর্মসূচির আওতায় সরকার শহর ও গ্রামের দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারা সমুন্নত রাখার চেষ্টা করে। এর মানে হলো উদ্দেশ্যটি অত্যন্ত মহৎ। তবে আমরা হতাশ হই যখন এই কর্মসূচি থেকে দুস্থ ও গরিব মানুষের বাদ পড়ার ঘটনা ঘটে। আবার কখনো যদি এই কর্মসূচিতে বরাদ্দের পরিমাণ কমে। এ দুটি কারণে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, তা প্রায় নিশ্চিত বলা যায়।

২০২১ সালের শুরুর দিকে পত্রিকায় পড়েছিলাম সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যে মাসিক ভাতা দেওয়া হচ্ছে, সেই তালিকায় নয়ছয়ের একাধিক খবর। সমাজের দুস্থ, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধ মানুষকে সহায়তা করার জন্য সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যে মাসিক ভাতা চালু করেছিল, তা প্রশংসিত হয় সবার কাছে। কিন্তু সরকারি আরও অনেক কর্মসূচির মতো এ ক্ষেত্রেও তালিকায় যোগ্য অনেকে বাদ পড়ে যায়। দেখা যায়, যারা ভাতা পাচ্ছে, তারা কোনোভাবেই যোগ্য নয়। এ বছরের ৩০ জানুয়ারি সরকারি প্রতিবেদনের বরাতে দৈনিক প্রথম আলোর খবরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির যেসব তথ্য উঠে আসে তা আসলেই উদ্বেগজনক। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের মধ্যবর্তী উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, যোগ্য না হয়েও ভাতা নিচ্ছেন ৪৬ শতাংশ। আর বয়স্ক ভাতায় শর্ত পূরণ করেননি ৫৯ শতাংশ। বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতায় অনিয়ম ধরা পড়েছে ২৩ শতাংশ। ভিজিডির ক্ষেত্রে ভূমিহীন বা সামান্য ভূমির অধিকারী হওয়ার শর্ত পূরণ করে না ৪৭ শতাংশ, ভিজিএফের ক্ষেত্রে ৫৪ শতাংশ। দরিদ্র না হয়েও ৫৮ শতাংশের ত্রাণসামগ্রী না পাওয়ারও কোনো সদুত্তর নেই। খবরটির প্রতিবেদক উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন, পাকা বাড়ি ও কিন্ডারগার্টেনের মালিক, দুই ছেলে বিদেশে চাকরি করেন, এমন সচ্ছল ব্যক্তিও দুস্থ ভাতা পাচ্ছেন। আমরা জানি, এসব তালিকা তৈরি করে থাকেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতি আমাদের একেবারে জানা কথা। তাহলে সেক্ষেত্রে আরও যাচাই বাছাইয়ের বিষয় যুক্ত করা দরকার। তাদের প্রাথমিক তালিকার সত্যতা পরীক্ষার ব্যবস্থা না করলে এ কর্মসূচি ভন্ডুল হবে এটা সহজেই ধারণা করতে পারি।

খবরের কাগজে পড়লাম, এ বছরের শুরুতে টিআর, কাবিখাসহ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে খাদ্যশস্য বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ৩১ লাখ ৩৭ হাজার টন নির্ধারণ করা হলেও সম্প্রতি সংশোধিত বাজেটে তা ২৪ লাখ ৫৫ হাজার টনে নামিয়ে আনা হয়েছে। আমরা জানি, করোনার কারণে মানুষ কাজ হারিয়েছে, হারাচ্ছে। তাহলে বরাদ্দ কমালে কীভাবে হবে? আরেকটি ব্যাপার হল, সাধারণত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নগর–দরিদ্রদের লক্ষ্য করে প্রণীত হয় না, এর প্রধান লক্ষ্য হলো গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তাকৌশলে বলা হচ্ছে, বিদ্যমান কর্মসূচিতে নগরের দরিদ্ররা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। তবে তাদের জন্যও পৃথক কর্মসূচি থাকা দরকার। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রণীত হয় শুধু দরিদ্রদের কথা মাথায় রেখে। অরক্ষিত মানুষদের কথা বিবেচনা করা হয় না। মহামারির মতো দুর্যোগের বিষয়টিও বিবেচনা করা হয় না। অথচ আমাদের দেশে বর্তমান অবস্থায় শহরের দরিদ্র, অরক্ষিত ও দারিদ্র্যসীমার ওপরে বাস করা মানুষের আয়ও ছিল না। পরিসংখ্যান কী বলে জানি না, তবে অনুমান করতে পারি, করোনার প্রভাবে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। কাজ হারানোর কারণে যেসব মানুষ কোনোরকমে দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকত, তাদের একটি অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে ৭৪ শতাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে।

শহরের অরক্ষিত মানুষোগুলোর ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার সমস্যা হিসেবে কেউ কেউ বলেন, এরা এক জায়গায় থাকে না। তাহলে ভাসমান দরিদ্রদের জন্য অনলাইন সিস্টেমে কার্ড চালু করা যায়। কারণ এ কর্মসূচির সুফল সমাজে দেখতে হলে এর পরিধি শহরাঞ্চলে বাড়াতে হবে। বস্তি এলাকার দরিদ্র পরিবার, বিশেষ করে শিশুদের এর আওতায় আনতে হবে। এ জন্য বিশেষ কর্মসূচির দরকার। সরকারের বিভিন্ন ভাতায় বস্তিবাসী ও ভাসমান জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি, যা এই মুহূর্তে অনুপস্থিত বলে জেনেছি।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের খাদ্য পায়, আশ্রয় পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।’ আমরা জানি, এদেশে নিত্যপণ্যের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে এখানকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর টিকে থাকা এখন অনেকটাই কঠিন। এ অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে সরকারি খাদ্যশস্য বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা না কমিয়ে বরং আরও বাড়ানো উচিত। পাশাপাশি এই কর্মসূচিকে উৎপাদনমুখী ও মানবসম্পদ উন্নয়নমুখী করা দরকার। কাউকে প্রতি মাসে সাহায্য করার চেয়ে দক্ষতা বাড়ানোর বন্দোবস্ত করা গেলে ভাল হত। নানা ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে সমাজের দরিদ্র শ্রেণিকে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা যায়। এভাবে কাজ করলে একদিন দেখা যাবে যে, তাদের আর সাহায্যের দরকার হবে না। আর এভাবেই একদিন গড়ে উঠবে সামাজিক নিরাপত্তার সঠিক বেষ্টনী, সুন্দর আর দুর্দান্ত এক বাংলাদেশ।

প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক মানবকণ্ঠ, ১১ মে, ২০২১; দৈনিক যুগান্তর, ১ জুন, ২০২১

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আসলে কেমন হওয়া উচিত?

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top