সর্বজনীন পেনশন স্কিম দ্রুত বাস্তবায়ন হোক : হাসান হামিদ

অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণদের আর্থিক নিরাপত্তার লক্ষ্যে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পেনশন কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশে পেনশন ব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যও তা-ই। যে সময় এখনকার ব্যবস্থাটি চালু হয়, সেই সময়ের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ একরকম নয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জনসংখ্যা, অর্থনীতি, শ্রমবাজার ও মানুষের জীবনপদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু দেশের পেনশন ব্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে এই পদ্ধতি বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে বেশ অসংগতিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ যারা তাদের কর্মজীবনে দেশের অর্থনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, তাদের শেষ জীবনের আর্থিক নিরাপত্তা বিধান বা সহায়তা প্রদান যদি পেনশন ব্যবস্থার লক্ষ্য হয়, তবে সেই লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশের পেনশন ব্যবস্থা সামান্যই সক্ষম। এই পেনশন ব্যবস্থা একটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হলেও তা অত্যন্ত সংকীর্ণ, বৈষম্যপূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ। এটা সংকীর্ণ এই কারণে যে এই ব্যবস্থায় কেবল সরকারি কর্মচারী ও স্বায়ত্তশাসিত সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরাই অন্তর্ভুক্ত।

সরকারি হিসাবে বর্তমানে পেনশনভোগীর সংখ্যা কম-বেশি ছয় লাখের মতো; যারা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মজীবনের সমাপ্তির পর অবসরে আছেন। কিন্তু দেশের কর্মজীবী মানুষের একটি ক্ষুদ্র অংশই সরকারি খাতে নিয়োজিত, বরং অধিকাংশই বেসরকারি আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি খাতে নিয়োজিত লোকজনের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। অথচ তারা দেশের পেনশন ব্যবস্থার আওতায় পড়েন না। তাই বিদ্যমান এ পেনশন ব্যবস্থা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। আর যেসব মানুষের চাকরিকালীন অবদানের কারণে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে বা ক্রমেই বিকশিত হয়, বার্ধক্যকালে তাদের আর্থিকভাবে অনিরাপদ রাখা রীতিমতো অন্যায়ও বটে। এসব কারণে পেনশন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছিল কিছুদিন ধরেই। বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারেও সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের অঙ্গীকার ছিল। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থ বিভাগকে কাজ শুরু করার নির্দেশ দেন। এখন এই স্কিম পরিচালনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাইরে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। আর আগামী এক বছরের মধ্যে এই ব্যবস্থা প্রাথমিক ভাবে চালুর লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে অর্থ বিভাগ।

কী আছে এই স্কিমে? জানতে পেরেছি, ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি কোনো নাগরিক যদি মাসে ৫০০ টাকা জমা করেন, তাহলে তার বয়স ৬০ পার হলেই সরকার তাকে প্রতি মাসে পেনশন দেবে ৩২ হাজার টাকা। এই টাকা প্রদান শুরু করা যাবে ব্যক্তির বয়স ১৮ বছর হলেই। আর পরেও কেউ শুরু করতে পারবেন। শুরুটা আগে পরে হবে আর টাকা জমানোর অংক কম-বেশি হতে পারে বলে এ স্কিমে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বয়সভেদে আর্থিক সুবিধার অঙ্কও কম-বেশি হবে। মানে যাদের মাসে ১ হাজার জমা হবে, তারা পাবেন পেনশন হিসেবে মাসে ৬৪ হাজার টাকা। এই স্কীমের জন্য, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়ে নাগরিকদের একটি পৃথক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। আর সেই অ্যাকাউন্টে পেনশন পাওয়ার আগ পর্যন্ত মানে ৬০ বছর হওয়া অবধি টাকা জমা দিবে। যার যত জমা হবে, তার ওপর ভিত্তি করেই মূলত সে সুবিধাটা পাবে। তাতে থাকবে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ। এখনকার চলমান ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাবে। তাতে করে লাভ হবে সবারই। বেশ ভালো এই খবর, নিঃসন্দেহে বলা যায়!

খবর নিয়ে জেনেছি, বর্তমানে আমাদের দেশে বয়স্কদের আর্থিক নিরাপত্তা প্রদানের জন্য তিনটি কর্মসূচি চলমান আছে। এগুলো হলো অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের জন্য পেনশন ব্যবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা এবং বয়স্ক ভাতা। এখানেও চরম বৈষম্য হচ্ছে বলা যায়। উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকারি কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য পেনশন বাবদ খরচ হয়েছিল প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। আর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী হিসেবে বণ্টন করা হয়েছিল ১ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগ বলছে, ২০১৫-১৬ সালে এই কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার। সর্বোপরি বয়স্ক ভাতার আওতায় একই অর্থবছরে খরচ হয় ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা এবং সুবিধাপ্রাপ্ত লোকের সংখ্যা ছিল ৩০ লাখ। এই তথ্য অনুসারে, উল্লেখিত তিনটি কর্মসূচির মধ্যে প্রত্যেক পেনশনভোগী বছরে গড়ে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা বা মাসে গড়ে প্রায় ১৬ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। প্রত্যেক সুবিধাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা গড়ে মাসে পান প্রায় ৯ হাজার টাকা এবং একজন দরিদ্র বয়স্ক ভাতার সুবিধাভোগী মাসে পান ৪০০ টাকা; অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় আর্থিক নিরাপত্তার অংশ হিসেবে একজন বয়স্ক ভাতার সুবিধাভোগীর চেয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা গড়ে ২২ গুণের চেয়ে বেশি অর্থ এবং একজন পেনশনভোগী ৪০ গুণ বেশি অর্থ পেয়ে থাকেন। যদি বৃদ্ধ বয়সে মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা বিধানই এসব কর্মসূচির উদ্দেশ্য হয়, তবে এই বৈষম্যমূলক বণ্টননীতির কোনো যৌক্তিকতা থাকে না। এখানে উল্লেখ্য, উল্লিখিত তিনটি কর্মসূচিই রাজস্বভিত্তিক। এগুলো কন্ট্রিবিউশননির্ভর নয়। সুতরাং এগুলোকে আরও সাম্যভিত্তিক করলে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।

আগেই বলেছি, এই পেনশন ব্যবস্থা রাজস্বভিত্তিক। তাই পেনশন ব্যবস্থার সম্প্রসারণের কথা বললে অনেকে মনে করেন যে তা জাতীয় বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ ফেলবে। কিন্তু পেনশনের আওতা সম্প্রসারণ করলে বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ আবশ্যিক নয়। এই বিষয়টি যারা বুঝেন না, তারা আসলে জানেন না যে, মৌলিকভাবে পেনশন একটি ইনস্যুরেন্স-ব্যবস্থা, যা বেতনভোগী কর্মজীবীদের কন্ট্রিবিউশনের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। আমার জানা মতে, কোনো কোনো দেশে কর্মচারীদের পাশাপাশি মালিক ও রাষ্ট্রও আংশিকভাবে ট্রিবিউন করে, যা মূল তহবিলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। উন্নত বিশ্বে সাধারণত ‘পে এজ ইয়্যু গো’ পদ্ধতিতে পেনশন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সেখানে একজন কর্মজীবী চাকরিকালীন তার পেনশন প্ল্যানে কন্ট্রিবিউট করেন এবং কর্মজীবন শেষে তার কন্ট্রিবিউশনের আলোকে পেনশন-সুবিধা ভোগ করেন। কর্মজীবনে যারা জাতীয় পেনশন প্ল্যানের অন্তর্ভুক্ত হতে চান না এবং এতে কন্ট্রিবিউট করেন না, তারা পেনশন-সুবিধা পান না। তাই সেখানে জাতীয় পেনশন স্কিম রাজস্বব্যবস্থা থেকে আলাদা।

দেশের ষাটোর্ধ্ব সব নাগরিককে পেনশন সুবিধার আওতায় আনার এই সিদ্ধান্ত বর্তমান সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। গণমাধ্যমে আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান যা বলেছেন, তার অর্থ হলো, এই স্কিম চালানোর মতো আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে বর্তমান বাংলাদেশের। আমরাও চাই পেনশন ব্যবস্থা তার বিদ্যমান সংকীর্ণতা থেকে বের হয়ে আসুক। অনেক উন্নত দেশেই এই ধরনের পেনশম স্কিম বর্তমানে কার্যকর রয়েছে। কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা অনুযায়ী, আমাদের বাংলাদেশও সেই পথে হাঁটার চিন্তা করছে। এটি সত্যিকার অর্থেই সুখের খবর।

সর্বজনীন পেনশন স্কিম দ্রুত বাস্তবায়ন হোক : হাসান হামিদ

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top