সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা; কতোখানি বৈধ?

হাসান হামিদ

লেখার শুরুতে একটি গল্প বলে নিই; ঠিক গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। একবার নিজের ছেলেকে সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত করার জন্য এক মহিলা  যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের কাছে গিয়ে বললেন, ‘এটা আমার দাবি, এ পদটা আমার ছেলের প্রাপ্য। আমার দাদা কেসিংটনে যুদ্ধ করেছেন, আমার চাচা ব্লাডেনসবার্গ যুদ্ধের মাঠ থেকে পালিয়ে যাননি, আমার দাদা নিউ অরলিয়ান্সে যুদ্ধ করেছেন আর আমার স্বামী তো মন্টেরিরি যুদ্ধে মারাই গেলেন।’ ভদ্রমহিলার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে লিংকন বললেন, ‘ম্যাডাম, আমার ধারণা আপনার পুরো পরিবার দেশের জন্য অনেক করেছে। এবার অন্যদের একটু সুযোগ দেওয়া উচিত’।

পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশই যুদ্ধ আর সংগ্রামের পর স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সেসব দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান নিশ্চয়ই দেওয়া হয়। তাদের ভাতা প্রদান ও অন্য অনেক সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু কোথাও সন্তান আর নাতি-নাতনিদের চাকরি দেওয়ার ব্যাপারটি নেই। থাকা উচিতও নয়। অথচ আমাদের দেশে এই পদ্ধতির কারণে যোগ্য আর মেধাবীরা বাদ পড়ছে অনেক ক্ষেত্রেই। এটার ভয়াবহতা আজকেই পাওয়া যাবে না। যাবে যেদিন, ততোদিনে যা হবার হয়ে যাবে। সন্তান পর্যন্ত তাও যদি থাকতো; এটা নাতি-নাতনির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি মূর্খতা, কারণ এ চক্রে কোনো স্বাধীনতা বিরোধীর নাতি-নাতনিও এ কোটার সুবিধা পেতে পারে আত্মীয়তার বন্ধনের কারণে। এর চেয়ে বড় কথা, দেশের অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা যদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গাগুলোতে থাকে, তাহলে দেশের যে ক্ষতিটা হবে তা মানা যায় না। 

আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, উপজাতি কোটা রয়েছে ৫ শতাংশ। এতে মোট ৫৫ শতাংশ নিয়োগ হয় কোটায়। ফলে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যরা চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। এটা মারাত্মক এক বৈষম্য, আর তাই বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে প্রণীত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে আমরা এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান লক্ষ করি। ১৯৭২ সালের সংবিধানে অন্তত ছয়টি বিধানে সমতা ও বৈষম্যহীনতা প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা আছে। এবার দেখি সংবিধানে এ ব্যাপারে সরাসরি কী বলা হয়েছে-

সংবিধানের ১৯ নং অনুচ্ছেদে আছে, সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন৷ সরকারি চাকরিতে তা কেমন মানা হচ্ছে তা আমরা দেখছি। সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদে আছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। কোটা আমাদের কি চাকরির ক্ষেত্রে সমান অধিকার দিচ্ছে? যদি আমরা এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরকারের বিরুদ্ধে রিট করতে চাই, আমার ধারনা, অন্তত মুক্তিযোদ্ধার কোটার কোন আইনগত ভিত্তি থাকবে না। সংবিধানের ২৮ নং অনুচ্ছেদে আছে, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।  কিন্ত সরকারি চাকরিতে জন্ম পরিচয়ের জন্য কেউ ৩০% কোটা পাচ্ছে! সংবিধানের ২৯ নং অনুচ্ছেদে আছে, (১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।  (২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।

আমি মনে করি সরকারি চাকরিতে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে সংবিধানের এই একটা অনুচ্ছেদই যথেষ্ট।  যদিও এই অনুচ্ছেদেই ৩টি বিশেষ ক্ষেত্র বলা হয়েছে, (৩)(ক) নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে,  (খ) কোন ধর্মীয় বা উপ-সমপ্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ-সমপ্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান-সংবলিত যে কোন আইন কার্যকর করা হইতে,  (গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোন শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে  রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না। প্রথম অংশ দিয়ে জেলা কোটা, তৃতীয় অংশ দিয়ে নারী কোটা কোন ভাবে সমর্থন কড়া গেলেও সব চেয়ে বড় কোটা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা কোন ভাবেই সাংবিধানিক ভিত্তি দেয়া সম্ভব না।  আমি মনে করি, প্রতিবন্ধী ছাড়া কোন কোটাই থাকা উচিত  না।

১৯৭২ সালের সংবিধান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবচেয়ে অকাট্য দলিল। এই দলিল অনুসারে, নারী কিংবা  সমাজের অনগ্রসর শ্রেণী হিসেবে উপজাতিদের জন্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় কোটা থাকতে পারে। কিন্তু সেটি তত দিনই থাকা সংগত, যত দিন সরকারি চাকরিতে তাঁদের ‘উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব’ নিশ্চিত না হয়। আবার সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ নাগরিকদের অনগ্রসর অংশের জন্য চাকরিতে বিশেষ কোটা প্রদান অনুমোদন করেছে, অনগ্রসর অঞ্চলের জন্য নয়। ফলে জেলা কোটার সাংবিধানিক ভিত্তি সন্দেহজনক।

আরো একটি ব্যাপার আছে। আমরা জানি, ১৯৮৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকা অনুসারে  মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন, একই বছরে আরেকটি তালিকায় এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার কথা বলা হয়। পরে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে একটি তালিকায় দুই লাখ দুই হাজার ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশিত হয়। তাঁদের মধ্যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন এই মর্মে আপত্তি দাখিল হয় ৬২ হাজারটি। এসব আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে কি না বা পরবর্তী সময়ে আরও যাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে, তারা আদৌ মুক্তিযোদ্ধা কি না, এই সংশয় কখনো দূর হয়নি। তাই ন্যায়পরায়ণতা ও বাস্তবতার স্বার্থে তাই কোটাব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। বিদ্যমান কোটাব্যবস্থায় শুধু যে বেসামরিক প্রশাসনের মান খর্ব হচ্ছে, তা-ই নয়। এতে সমাজে চরম বৈষম্য ও অবিচার সৃষ্টি হচ্ছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। এটি পরিবর্তন করে, যুদ্ধাহত ও নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে শুধু তাঁদের সন্তানদের জন্য সমানুপাতিক কোটা রাখলে তা যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য হবে।

মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের ভালোবাসা ও সম্মানের পাত্র। কিন্তু সরকার এই মুক্তিযুদ্ধকে আমাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের বৈষম্য করার একটা মাধ্যম বানিয়ে ফেলেছে। যেখানে সরকারি চাকরিতে দেশের সবচেয়ে মেধাবীদের থাকার কথা, সেখানে অনেক অযোগ্য লোকেরাও ঢুকে যাচ্ছে এই কোটা আর রাজনৈতিক বিবেচনায়। এসব অযোগ্য লোকেরা আগামী ৩০ বছর যেই সেবা দেবে, তার চেয়ে অনেক যোগ্য লোকেরা কি আরও ভাল সেবা দেশকে দিতে পারত না? আমরা সরকারি আমলাদের অযোগ্যতার অনেক সমালোচনা করি, কিন্তু তাদের নিয়োগ দেবার সময় যোগ্যতা কতোখানি প্রাধান্য পায়, সেটা নিয়ে কথা খুব কমই বলি আমরা। সব চেয়ে বড় কথা এত কোটা ব্যবস্থার কোন সাংবিধানিক ভিত্তি নেই, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা কোটার তো একেবারেই নেই! আমরা আশা করি, দ্রুত এ ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। সত্যি, মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে ভাবনার সময় হয়েছে।

প্রকাশিত পত্রিকা-

দৈনিক দেশকাল ১০/০৫/২০১৭

দৈনিক সিলেটের সংবাদ ১০/০৫/২০১৭

সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা; কতোখানি বৈধ?
Scroll to top