সড়কে আর কত মৃত্যুর মিছিল?

হাসান হামিদ

এবার ঈদে লম্বা ছুটিতে ছিলাম; একটানা বারো দিন। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যাবার যে দীর্ঘ পথ তা অতিক্রমের ক্লান্তির কথা ভেবে নয়, আমি অন্য এক আশংখায় বোধ হয়ে ছিলাম। আর জীবনের কথা ভেবেই আমরা এখন অস্থির থাকি কেমন যেন; কেননা ঠিকঠাক প্রাণ নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোই বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল। দুঃস্বপ্নের প্রতিটা রাতের পর আমাদের দিনগুলো কেটে যায় উৎকণ্ঠা আর দুর্ভাবনায়। এবার ছুটি শেষে প্রথম অফিসে এসে সকালে চায়ে চুমুক দিয়ে যে খবরটি চোখে পড়লো, তাতে সীমাহীন শোক মনের টুটি চেপে ধরলো যেন। খবরটি হলো, গত ৩১ আগস্ট, শুক্রবার, গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলায় বাস ও ট্রাক্টরের মধ্যে সংঘর্ষে মধ্যরাতে শিশুসহ ছয়জন নিহত হয়েছে। এ সময় আহত হয় ১০ জন। শুক্রবার মধ্যরাতে গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী সড়কের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে মহিদপুরের রাইচ মিল এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ পর্যন্ত পড়ে আমি কেঁপে উঠি। শুক্রবার বিকেলে আমিও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। এ ছবিগুলো সেই গাড়িরও হতে পারতো, যে গাড়িতে আমি এসেছি।

নানা কারণেই আমরা ভালো আছি বলতে পারি না আজকাল। প্রায়শই পরিচিত মানুষকে অসময়ে হারানোর বেদনা আমাদের ভালো থাকতে দিচ্ছে না। আমাদের সড়ক-মহাসড়কের সর্বত্রই যেনো চলছে মৃত্যুর মহোৎসব। এতে একের পর এক তাজা প্রাণ যাচ্ছে । এভাবেই কি দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোয় প্রাণনাশের বিভীষিকা চলতে থাকবে? প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে। আর এভাবে থমকে যাচ্ছে বহু পরিবার। এর ভয়াবহ দৃশ্য দেখা যায় পঙ্গু হাসপাতালে গেলে। মন্ত্রী যদিও বলে থাকেন, সড়কের অবস্থা ভালো; আসলে আমরা জানি, সড়কের অবস্থা মোটেও ভালো নয়। সব সড়ক এখন মৃত্যুকূপ।

কিছুদিন আগে(২৯ জুলাই) ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে বেপরোয়া বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে পথে নেমে এসেছিল। আমরা তখন কী কী ঘটেছিল সব দেখেছি। আর এই অভূতপূর্ব আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে তখন বলা হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। তারপর প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেল, কিন্তু সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামল না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি অব্যাহত থেকেছে; আর ঈদুল আজহার আগে ও পরের দিনগুলোয় সড়ক দুর্ঘটনা ও মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনা যেন বেড়েছে।

এবার বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি নামে এক বেসরকারি সংস্থার একটি প্রতিবেদনের দিকে নজর দেব। তাদের হিসাব অনুযায়ী, গত ১৬ থেকে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত ১৩ দিনে সারা দেশে মোট ২৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৫৯ জন মানুষ মারা গেছে, আহত হয়েছে ৯৬০ জন। গত ৩১ আগস্ট, শুক্রবার সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘ঈদুল আজহায় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০১৮’-এ এই তথ্য তুলে ধরে। সংগঠনটির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল প্রতিবেদনটি তৈরি করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছর ঈদকেন্দ্রিক সড়ক দুর্ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এ ছাড়া প্রতিবেদনে ঈদে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রী হয়রানির বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবির আন্দোলনে সারা দেশে ব্যাপক নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। এ অবস্থায় সরকার সড়ক নিরাপত্তায় ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে। পুলিশ, র‌্যাব, বিআরটিএ ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নানামুখী তৎপরতা ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার থাকায় এবারের ঈদযাত্রায় বিগত ঈদুল ফিতরের তুলনায় প্রাণহানি কমেছে ২৩.৫৯ শতাংশ। তবে গত ঈদুল ফিতরের তুলনায় দুর্ঘটনা ১৩.৫০ শতাংশ ও আহত ১১.৬৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী বহন, বিরতিহীন/বিশ্রামহীনভাবে যানবাহন চালানো, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অদক্ষ চালক-হেলপার দ্বারা যানবাহন চালানো, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মহাসড়কে অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, নসিমন-করিমন ও মোটরসাইকেল অবাধে চলাচল, বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো, সড়ক-মহাসড়কে ফুটপাত না থাকা এবং সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে দেখলাম, গত পাঁচ মাসে সড়কে ঝরেছে এক হাজার ৯৯৫টি প্রাণ। এতে করে বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম এবং প্রাণহানিতে এশিয়ায় সপ্তম। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর গড়ে ১২ হাজার প্রাণনাশ ও ৩৫ হাজার মানুষ মারাত্মকভাবে আহত হচ্ছে। বুয়েটের আরেক পরিসংখ্যান মতে, সড়কে দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশই হয়ে থাকে চালকের বেপরোয়া গতি ও মনোভাবের কারণে। চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষ ও অপ্রশিক্ষিত চালক, বিরামহীনভাবে দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, বেহাল রাস্তাঘাট, অদক্ষদের লাইসেন্স প্রদান, ট্রাফিক পুলিশদের উদাসীনতা ও জনসচেতনতার অভাবে এমন মৃত্যুর মিছিল যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় রূপ নিচ্ছে।

আসলে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি ও আহত হওয়ার বিষয়টি শুধু সংখ্যার বিচারে বিবেচনা করলেই চলে না। কেননা প্রতিটি প্রাণ অমূল্য। আর যারা আহত হয়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারায়, কর্মক্ষমতা হারিয়ে পরিবারের বোঝায় পরিণত হয়, তাদের জীবনে যেন অন্ধকার নেমে আসে। যে সমস্ত লোক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে অথবা পঙ্গুত্ব জীবন যাপন করছে তাদের পরিবারের খবর আমরা কয়জন রাখি! সমাজের অনেক সচেতন মানুষ এসব দুর্ঘটনা থেকে পরিত্রানের পথ খোজার চেষ্টা করছে। কিন্তু কার্যকরী পদক্ষেপ সঠিক ভাবে নিলে এসব দুর্ঘটনা আরও কমে আসতো। দুর্ঘটনা কিছুতেই কমছে না, বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। অবস্থা ‘মহামারী’ আকার ধারণ করেছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। একটি ঘটনার রেশ না কাটতেই আরেকটি ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিনই গণমাধ্যমে দুর্ঘটনার খবর থাকছে। এসব ঘটনায় হতাহতের সংখ্যাও অনেক। এর প্রতিকার কতোখানি জরুরি হয়ে পড়েছে তা সবাই বুঝেন; কিন্তু এই সচেতনতা আমাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে না।

প্রতিবার দুর্ঘটনার পর পরই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই তদন্ত প্রতিবেদন কোনদিন আলোর মুখ দেখে না। আর সঙ্গত কারণেই দোষীদের শাস্তিও হয় না। সমাজের উঁচু স্তর থেকে নিচু শ্রেণির মানুষ- যারাই দুর্ঘটনার শিকার হন না কেন, কোন একটি ঘটনার বিচার হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত মেলা ভার। আর বিচারহীন, প্রতিকারহীন অবস্থায় কোন কিছু চলতে থাকলে সেটির পুনরাবৃত্তিও তো ঘটবেই। প্রশ্ন হচ্ছে, কত প্রাণ গেলে, মৃত্যুর মিছিল কত দীর্ঘ হলে তবে থামবে এই হত্যাযজ্ঞ?

আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৪ জন নিহত হয়৷ আর এই সংখ্যা বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহতদের সংখ্যার মধ্যে সর্বোচ্চ৷ সেন্টার ফর ইনজ্যুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)-এর জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে৷ ‘বাংলাদেশ হেলথ ইনজুরি সার্ভে (বিএইচআইএস)’ শিরোনামে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়৷ তাতে দেখা যায়, প্রতি বছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ১৬৬ জন নিহত হন৷ আর তাতে প্রতিদিন গড়ে নিহতের সংখ্যা ৬৪ জন৷ আরও এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বছরে গড়ে বাংলাদেশের জিডিপির শতকরা দেড় ভাগ নষ্ট হয়, যার পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বিগত ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫৫ হাজার মানুষ। আর দুর্ঘটনাজনিত মামলা হয়েছে প্রায় ৭৭ হাজার। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা এখন অন্যতম জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সঙ্গতকারণেই এই সমস্যা থেকে মানুষজনকে মুক্ত রাখার সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি।

ভয়াবহ ব্যাপার হলো, ২০১৫-এর তুলনায় ২০১৬ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছিল ১৮৩ শতাংশ। এর আগে ২০১৫ সালেও পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছিল। সরকারি সংস্থা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রতিবেদনে ঢাকায় দুর্ঘটনা বৃদ্ধির এ চিত্র উঠে এসেছে। ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৪ সালে দেশের সাত বিভাগে মোট ৩ হাজার ৪৩১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮০৬ জন নিহত হন। এর মধ্যে ঢাকায় ৪৭৭টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৩৯ জন। ২০১৫ সালে দেশের সাত বিভাগে মোট ২ হাজার ৩২৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮৮৮ জন নিহত হন। এর মধ্যে ঢাকায় ৪৮৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ২২৯ জন। এ হিসাবে, ২০১৪-এর তুলনায় ২০১৫ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা ১ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এর পরের বছর অর্থাত্ ২০১৬ সালে দেশের সাত বিভাগে মোট ৫ হাজার ৩৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ১৬২ জন নিহত হন। এর মধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৪০১ জন। অর্থাত্ ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা ১৮৩ শতাংশ বেড়ে যায়। একই সঙ্গে দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৭৫ শতাংশ।

আমাদের দেশে এত বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে যে, দুর্ঘটনা রোধে বিশেষ বাহিনী গঠনের দাবি জানানোর সময় হয়েছে। দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি র‍্যাব বাহিনী গঠন করা যায়, দুর্ঘটনা রোধে এ-জাতীয় বাহিনী নয় কেন? সব জায়গা থেকে বলা হচ্ছে, কোনোভাবেই তা রোধ করা যাচ্ছে না। সরকারি ও বেসরকারিভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবে কার্যকর করা যাচ্ছে না। আমাদের দেশের গাড়িচালকের সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকা, দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো, ওভারটেক করাসহ বিভিন্ন কারণে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার বেড়ে যাচ্ছে। আর এই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আমাদের দেশে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। বাংলাদেশের ওপর আছে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। কিন্তু দেশগুলোয় যানবাহনের সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য ১ হাজার ১৩৩ যানবাহন রয়েছে, চীনে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য রয়েছে ১৮ হাজার, ভারতে প্রায় ১৩ হাজার আর পাকিস্তানে পাঁচ হাজার। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি দুজনে একটি করে যানবাহন রয়েছে। অথচ এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা বেশি। এই প্রোপটে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় গঠন করা হয়েছে ‘ন্যাশনাল রোড সেফটি স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।

দুর্ঘটনার কারণগুলো সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলেই কমবেশি জানেন। এর মধ্যে রয়েছে- দেশে সড়ক অবকাঠামো এবং স্থলভাগের আয়তন অনুপাতে জনসংখ্যার চাপ বেশি। সড়কের তুলনায় মোটরযানের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। একই সড়কে চলছে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, রিকশাসহ নানা রকম মিশ্র যানবাহন। উপরন্তু সড়ক ও মহাসড়কগুলো ত্রুটিপূর্ণ। দেশব্যাপী মহাসড়কের অনেক স্থানেই রয়েছে বিপজ্জনক বাঁক। এসব বাঁকের কারণে প্রায়শই সেসব জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়া অবকাঠামোগত কারণেও দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকি খুব বেশি বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। সম্প্রতি দুর্ঘটনা মহামারীর আকার ধারণ করার জন্য যেসব কারণকে দায়ী করা হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চালকের অসতর্কতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো। এই সমস্যা বার বার চিহ্নিত হলেও এর কোন প্রতিকার নেই।

আমাদের দেশের বেশীরভাগ চালক লেখাপড়া জানে না, তাদের রোড সাইন সম্পর্কে তেমন কোন ধারনা নেই। গাড়ী চালানোর সময় কোথায় ওভারটেক করা যাবে এবং কোথায় যাবে না সে বিষয়ে তাদের কোন ধারনা নেই। সড়ক দুর্ঘটনার আরো একটি অন্যতম কারন পথচারীদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা। রাস্তা পারাপারের জন্য ট্রাফিক আইন হলো- আপনি প্রথমে ডানে তারপর বামে এবং সর্বশেষ ডানে তাকিয়ে রাস্তা পার হবেন। পথচারীরা রাস্তায় চলার সময় ডান পার্শ¦ দিয়ে চলার কথা। অথচ আমাদের দেশের বেশীর ভাগ লোক এই চলার নিয়মটা জানে না। দেখা যায় বেশীর ভাগ পথচারী বাম পার্শ্ব দিয়ে চলে এবং আমাদের দেশের ট্রাফিক আইন অনুসারে গাড়ী ও বাম পার্শ¦ দিয়ে চলে ফলে পিছন থেকে আগত গাড়ী গুলো কোন কারনে বাম পার্শ্বে সরে যাওয়া প্রয়োজন হলে পথচারী দুর্ঘটনার স্বীকার হয়। পথ চলার নিয়মগুলো প্রাইমারী স্কুলে কাস ওয়ান থেকে শেখানো প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

দুর্ঘটনার আরো একটি অন্যতম কারণ হলো ঘুম ঘুম অবস্থায় গাড়ী চালনা। একজন চালকের কোন অবস্থাতেই একটানা ০৫ ঘন্টার উপর গাড়ী চালানো নিষেধ। অথচ আমাদের দেশের বাস এবং ট্রাকের চালকরা একটানা ১৫/১৬ ঘন্টা গাড়ী চালাচ্ছে। বিশ্রাম ব্যতিত কান্ত অবস্থায় গাড়ী চালানোর ফলে তাদের চোখে অনেক সময় ঘুম চলে আসে। ফলে ঘটে যায় মারাত্মক দুর্ঘটনা।

মহাসড়কে দুর্ঘটনার মূল কারণ চালকদের বেপরোয়া, অতিরিক্ত গতি এবং ইচ্ছামত যেখানে সেখানে ওভার টেক করা। যেহেতু বেশীর ভাগ দুর্ঘটনা ঘটায় বাস এবং ট্রাক। তাদের বেপরোয়া খামখেয়ালী এবং ওভার টেকিং এর কারনে বেশীর ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। তাই প্রতিটি বাসে বিআরটিএ কৃর্তক বাস এবং ট্রাকের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ৬০-৭০ কি.মি. নির্ধারণ করে দিয়ে স্পীড লিমিট গভর্নর সীল সংযুক্ত করে দিলে একজন চালক ইচ্ছামত নির্ধারিত গতির অধিক গতিতে গাড়ী চালাতে পারবে না। এটা এখন সময়ের দাবীতে পরিনত হয়েছে। চালক পরবর্তীতে এই সীল পরিবর্তন করার চেষ্টা করলে অবশ্যই গাড়ী আটকের মাধ্যমে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা যেতে পারে। আর যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ চালক নিজে। তাই তাদের নিয়ন্ত্রন করার জন্য জেলা পুলিশ এবং হাইওয়ে পুলিশকে পর্যাপ্ত স্পীড ডিটেক্টর সরবরাহ করা যেতে পারে।

সড়ক দুর্ঘটনা হয় না এমন দেশ নেই। উন্নত দেশগুলোয় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেসব পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তা খুবই সুনির্দিষ্ট হয়। কিন্তু বাংলাদেশে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দায়সারা গোছের। কত বছরে কী পরিমাণ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমানো হবে, কীভাবে তা অর্জিত হবে, কারা তা সফল করবে সেটাও ভেবে দেখা দরকার। দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতি যত কমিয়ে আনা যায় সেটিই লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভাল যান, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক, সড়ক ব্যবস্থা উন্নতকরণ, সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিক ও যুগোপযোগী করার বিষয়গুলো তো রয়েছেই। এর সঙ্গে দুর্ঘটনায় পতিতদের ত্বরিত চিকিৎসা পাওয়ার বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি। অনেক সময় আইনি জটিলতার কারণে আহতদের চিকিৎসা দিতে সমস্যা হয়। এ সমস্যাটি সমাধানেও ব্যবস্থা নিতে হবে।

আমরা দেখেছি, বুলগেরিয়ায় একটি যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গিরিখাতে পড়ে ১৭ যাত্রীর মৃত্যু হলে জনবিক্ষোভের চাপে দেশটির পরিবহনমন্ত্রীসহ তিন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহির এমন দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে অনুসরণ করা হলে, এ দেশের সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল এত দীর্ঘ হতো না। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করতে হলে সরকারের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে গাড়ির চালক, মালিকপসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত দেশের মানুষ সচেতন না হবে ততক্ষণ সড়ক দুর্ঘটনা আইন করে রোধ করা যাবে না। সবার আগে আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আমাদের ভাবতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু শুধু একটি পরিবারে গভীর শোক, ক্ষত সৃষ্টি করে না, ওই পরিবারকে আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে ফেলে। কোন কোন দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি প্রাণ হারান। তখন ওই পরিবারের যে কী অবস্থা হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর যারা পঙ্গুত্ববরণ করে তাদের পরিবারের অবস্থা আরও করুণ, আরও শোচনীয়।দুর্ঘটনার কারণে একদিকে চলে যায় মানুষের প্রাণ আর অপরদিকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংশ্লিষ্ট সবাই। তাছাড়া নষ্ট হয় দেশের সম্পদ। একটি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অনেকগুলো চোখ সারা জীবন ধরে কেঁদে চলে। টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ার সাথে , গড়িয়ে পড়ে সুখ আর জীবনের সব হাসি।

প্রকাশিত পত্রিকা-

শিক্ষাবার্তা ০৫/০৯/২০১৮

বিডিটুয়েন্টিফোর লাইভ ডটকম  ০৫/০৯/২০১৮

নিরাপদ নিউজ  ২১/০১/২০১৮

সড়কে আর কত মৃত্যুর মিছিল?
Scroll to top