হাসান হামিদ
সোজা কথায় কমোডিটি এক্সচেঞ্জ (commodity exchange) মানে হল পণ্য বিনিময়। আমাদের দেশের জনসংখ্যা অনেক। তাদের জন্য ভোগপন্যের বিশাল বাজারও রয়েছে। অর্থাৎ কমোডিটি মার্কেট আছে। কিন্তু এখানে কোনো কমোডিটি এক্সচেঞ্জ হয়নি এখনও। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতে ১৯৯৩ সালে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু হয়। আর চীনে এটি শুরু হয় ২০০২ সালে, পাকিস্তানে ২০০৭ সালে এবং নেপালে ২০০৯ সালে। আমাদের দেশে এ ধরনের বাজার গড়ে তোলার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রথম উদ্যোগ নেয় ২০০৭ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এটি নিয়ে ২০০৭ সালের ১৬ এপ্রিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বৈঠকও করেছিল। সে সময় প্রাথমিকভাবে পাট ও আলুকে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ হাউসের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১০ সালের শুরুতেই বাংলাদেশে এ নতুন ধরনের এক্সচেঞ্জ যাত্রা শুরু করবে বলা হয়েছিল। এরপর এর এক দশক পর সম্প্রতি দেশের প্রথম কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করার অনুমতি পেয়েছে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ। চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এ সংক্রান্ত একটি চিঠি সিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর পাঠিয়েছে। একইসঙ্গে বিষয়টি সিএসই চেয়ারম্যানকে অবহিত করা হয়েছে। সেই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালু ও পরিচালনায় এবং পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু করার আগে ৬টি অবকাঠামো সুবিধা এবং সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। অবকাঠামোর মধ্যে পণ্যের গুণমান নিশ্চিতকরণ ব্যবস্থা। পণ্য গুদামজাতকরণ, সংরক্ষণ ও স্থানান্তরের জন্য নিবন্ধিত গুদাম সুবিধা এবং এই ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করতে হবে।
আমাদের দেশে এই ২০২১ সালে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও বিশ্বের প্রথম কমোডিটি এক্সচেঞ্জ হাউস হয়েছিল অনেক আগে। সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৫৩০ সালে নেদারল্যান্ডসে। নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম স্টক এক্সচেঞ্জকে বিশ্বের প্রথম কমোডিটি এক্সচেঞ্জ হাউস বলা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিদেনপক্ষে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ হাউস নিয়ন্ত্রণে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, ওয়্যার হাউস ও গুদামের দরকার হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের একটি এক্সচেঞ্জ হাউস প্রতিষ্ঠার রূপকল্প তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হানসহ দুই শিক্ষককে। তারা এরই মধ্যে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ হাউসের কাঠামো ও লেনদেনের পদ্ধতি, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর চিত্র তৈরি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করেছেন।
সাধারণত কমোডিটি এক্সচেঞ্জের পণ্যসম্ভারকে কৃষি পণ্য বা সফট প্রডাক্ট এবং অকৃষি বা হার্ড পণ্য হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। কৃষিপণ্যের মধ্যে রয়েছে- চাল, ডাল, গম, আলু, ভোজ্যতেল, ফলের জুস, কফি ইত্যাদি। অকৃষি পণ্যের মধ্যে রয়েছে- জ্বালানি তেল, গ্যাস, স্বর্ণ, লোহা, কয়লা ইত্যাদি। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে কমোডিটি এক্সচেঞ্জে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ১০ পণ্য অপরিশোধিত জ্বালানি তেল, কফি, প্রাকৃতিক গ্যাস, স্বর্ণ, গম, তুলা, ভুট্টা, চিনি, রৌপ্য ও কপার।
ভারতের কমোডিটি এক্সচেঞ্জ হাউসে অ্যালুমিনিয়াম, কপার, লেড, নিকেল, জিঙ্ক, স্বর্ণ, রৌপ্য, তুলা, অপরিশোধিত পাম তেল ও মসলা, অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস ইত্যাদি লেনদেন হচ্ছে। পাকিস্তান তাদের এক্সচেঞ্জ হাউসে স্বর্ণ, সুতা, ইয়ার্ন, চিনি, ধান ও গম লেনদেন করছে। নেপালেও লেনদেন হচ্ছে খাদ্যসহ সবজি, তেলবীজসহ নানা পণ্য। বাংলাদেশে কী কী পণ্য কমোডিটি এক্সচেঞ্জ হাউসে লেনদেন হবে? আসলে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বিষয়টি এ দেশে নতুন। এর অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের কারও নেই। বাংলাদেশে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর জন্য এরই মধ্যে ভারতের মুম্বাইভিত্তিক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ এমসিএক্সকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান সম্ভাব্যতা যাচাই করবে। একই সঙ্গে প্রাথমিকভাবে কোন কোন পণ্য নিয়ে এ এক্সচেঞ্জ চালু করা যায়, তার গাইডলাইন দেবে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রশ্ন হলো, কমোডিটি এক্সচেঞ্জের বাজারে কেনাবেচার প্রক্রিয়াটা আসলে কেমন? খুব জটিল কিছু নয়। অভ্যস্ত নয় বলে এ দেশের অনেকেই এই মুহূর্তে অনাগ্রহী হতে পারেন। এই প্রক্রিয়ায় কেনাবেচাটা অনেকটা কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচার মতো। ব্রোকারের মাধ্যমে বিক্রেতা পণ্য বিক্রির আদেশ দেন। আর ক্রেতা তার ব্রোকারের মাধ্যমে ক্রয় আদেশ দেন। আমাদের দেশে এখন অনলাইনে প্রচুর কেনাকাটা হয়। প্রায় সবাই এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। দিন দিন অনলাইনে কেনাবেচা বাড়ছে। এই ব্যবস্থায় উভয়ের এই কেনাবেচার আদেশ প্রদর্শিত হয় কমোডিটি এক্সচেঞ্জের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে আমরা দেখি, ক্রেতা-বিক্রেতা দুইজনের দামে মিলে গেলে তাদের মধ্যে পণ্য কেনাবেচা হয় অর্থাৎ লেনদেন হয়। তবে লেনদেন নিষ্পত্তি হয় ক্লিয়ারিং অ্যান্ড সেটেলমেন্ট হাউসের মাধ্যমে। আগে ক্যাশ সেটেলমেন্ট অর্থাৎ ক্রেতার ব্রোকার থেকে অর্থ নিয়ে বিক্রেতার ব্রোকার অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। এরপর চুক্তি অনুযায়ী ফিজিক্যাল ডেলিভারি সম্পন্ন করতে পণ্যটি যে ওয়্যারহাউস রয়েছে, ক্রেতার অর্ডার অনুযায়ী ওই পণ্য সরবরাহ করতে বলা হয়। মজার ব্যাপার হলো, অনেক সময় পণ্য কালেকশনে না থাকার পরও কমোডিটি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ওই পণ্য কেনাবেচা করা যায়। কমোডিটি এক্সচেঞ্জের বাজারের এ অংশকে ‘ফিউচার কন্ট্রাক্ট’ বলা হয়। যে জিনিস এখন নেই এর জন্য বিক্রেতা আগাম বিক্রির আদেশ দিতে পারেন। আর সেই আদেশ অনুযায়ী, কোনো ক্রেতা তা আগাম ক্রয়ের অর্ডার দেন। বাজারে যখন পণ্যটি আসে, তখন এটি সরবরাহ করা হয়। এই ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে পণ্য ডেলিভারি হয় কয়েক মাস পর।
কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, কমোডিটি এক্সচেঞ্জ হাউস স্থাপন হলে মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্দ্য কমবে। স্থাপিত হবে উৎপাদক ও ক্রেতার মধ্যে একটি যোগসূত্র। সরকারের পক্ষে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম পর্যবেক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর নজরদারি করাও সম্ভব হবে। বাম্পার উৎপাদনের পরও ওই পণ্যের হঠাৎ দরপতন ঘটবে না। সাধারণ শেয়ারবাজারের মতোই কমোডিটি এক্সচেঞ্জ হাউসে বিভিন্ন পণ্যের দৈনন্দিন দর আহ্বান (বিট) করা হবে। বিপুলসংখ্যক ক্রেতা ও বিক্রেতা এখানে শেয়ার লেনদেন করতে পারবেন। সরকারও বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে।
কমোডিটি এক্সচেঞ্জ হাউস পণ্য কেনাবেচার জন্য একটি সংগঠিত বাজার। বর্তমানে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে আমাদের দেশে পণ্য কেনাবেচা হচ্ছে। এতে বিক্রেতা যেমন প্রতিযোগিতামূলক মূল্য পাচ্ছে না, তেমনি ক্রেতাও ন্যায্যমূল্যে পণ্য পাচ্ছে না। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ-এ কেনাবেচার প্রাথমিক প্রক্রিয়া কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচার মতো। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ হাউস ক্রেতা-বিক্রেতাকে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে আসবে।কমোডিটি এক্সচেঞ্জ হলে বিশ্বের আগ্রহী সব ক্রেতা-বিক্রেতাকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে পণ্য কেনাবেচার সুযোগ করে দেবে। এতে পণ্যমূল্যে ভারসাম্য নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ বাড়বে। আবার বাংলাদেশের বাজারে সিন্ডিকেটভিত্তিক পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে দিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
প্রকাশিত পত্রিকা- সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৮ নভেম্বর ২০২১