শুরুতে ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্নে হলেও শেষদিকে ভোগান্তি ছিল চরমে : হাসান হামিদ

প্রতি বছর ঈদে মানুষ যখন ঢাকা শহর ছেড়ে নাড়ীর টানে ছুটে গ্রামে যায় তখন পথে পথে শিকার হয় নানা ভোগান্তির। তবে এবারের ঈদ যাত্রা অন্য বারের তুলনায় স্বস্তিদায়ক ছিল। সব ধরনের যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল। লাগেনি তেমন বড় কোনো জট। এমনকি ঈদের আগে বাড়ি যেতে ট্রেন কিংবা বাসে অন্য বারের মত এত উপচে পড়া ভিড় ছিল না। কয়েকটি ছাড়া সব ট্রেনই নির্দিষ্ট সময়ে স্টেশন ছেড়ে গেছে। লঞ্চ কিংবা বাসে নির্বিঘ্ন ঈদ যাত্রায় অনেক স্বস্তিতে ছিলেন যাত্রীরা। তবে ঈদের ছুটির শেষ দিকে যাত্রীদের ভোগান্তি হয়েছে সব জায়গায়; বাস, লঞ্চ কিংবা ট্রেনে।

জানা যায়, পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে এবার ৬ জোড়া বিশেষ ট্রেন চালু করেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। এসব ট্রেন ২৯ এপ্রিল থেকেই চলাচল শুরু করে। এছাড়া বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ২৩ এপ্রিল থেকে ঈদের অগ্রিম টিকিট বিক্রির ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার ঘরমুখো মানুষের ঈদ যাত্রা ছিল স্বস্তিদায়ক। ঈদ ছুটির শেষদিন রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের একথা বলেন তিনি। এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘সব সময়ই উৎসবের সময় যাত্রী সংখ্যা বেড়ে যায়। আমরা বরাবরের মতো এবারও ঘরমুখো যাত্রীদের বাড়িফেরা নির্বিঘ্ন করতে ব্যবস্থা নিয়েছিলাম।’ তিনি আরো বলেন, ‘টিকিট কালোবাজারি রোধে ঢাকা, বিমানবন্দর, জয়দেবপুর, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট, রাজশাহী, খুলনাসহ সব বড় স্টেশনে জিআরপি, আরএনবি, বিজিবি ও স্থানীয় পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন ছিল। চলন্ত ট্রেনে বা রেললাইনে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা জোরদার করা হয়েছিল। জরুরি সমস্যা নিরসনে কর্মকর্তা নিয়োজিত ছিলেন’। এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান বলেছেন, ‘সারাদেশে মানুষ যাতে ঈদ উদযাপন করার জন্য ভালোভাবে যেতে পারে, সেজন্য মহাসড়ক, রেল, লঞ্চ ও অন্যান্য যাতায়াতের সুব্যবস্থাপনা করা হয়েছে। সেকারণে স্রষ্টার কৃপায় এবছর ঈদ যাত্রায় মানুষের ভোগান্তি হয়নি।’

সূত্র বলছে, ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করেছে সারাদেশের ট্রাফিক বিভাগ। উপ পুলিশ কমিশনারদের তত্ত্বাবধানে দেশের বিভিন্ন শহরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে স্থাপন করা হয়েছে অস্থায়ী চেকপোস্ট। দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যায় এমন স্টেশনগুলোতে রয়েছে পুলিশ সদস্যদের দৃশ্যমান উপস্থিতি ও নিয়মিত নজরদারি। নগরীর ঘরমুখো সাধারণ মানুষজন যেন টিকেট কালোবাজারি, অতিরিক্ত দামে টিকেট ক্রয়, বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ইত্যাদি ঈদ কেন্দ্রিক হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকে নজর রেখেই কঠোর অবস্থানে ছিলেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পাশাপাশি ঈদকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে কাজ করেছে গোয়েন্দা বিভাগ ও ক্রাইম বিভাগ। ঈদের কেনাকাটা বা ব্যবসার ক্ষেত্রে ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়ে যেন সর্বশান্ত না হতে হয়, সেজন্য প্রতিটি থানা ও মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ একটানা নিরলসভাবে কাজ করেছে। ঈদকে সামনে রেখে বাড়ানো হয়েছিল ব্যাংকসমূহের নজরদারি কার্যক্রমও।

ঈদ যাত্রায় গত শুক্রবার পর্যন্ত দূরপাল্লার বাস টার্মিনালগুলোতে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ তেমন দেখা গেলেও শনিবার চিত্র ছিল খানিকটা ভিন্ন। সূত্র বলছে, উত্তরাঞ্চলের অনেক পরিবহনে সময়সূচির ব্যত্যয় ঘটেছে। বিভিন্ন বাস টার্মিনালে দেখা যায়, ঈদে অগ্রিম টিকিট কেনা যাত্রীরা কোনো বিড়ম্বনা ছাড়াই যাত্রা করছে। তাছাড়া প্রতিটি টার্মিনালেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা লক্ষ করা গেছে। কমলাপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফরমে টিকিট ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ঈদ যাত্রার শুরুর দিকে অন্যান্য সময়ের তুলনায় এবার লঞ্চে ব্যাপক চাপ দেখা যায়নি। তবে গত শনিবার সকাল থেকে ঘাটে যাত্রীর চাপ বাড়ে। ঈদের পর কর্মস্থলে ফেরার শেষ দিনে ফেরিঘাটে চরম ভোগান্তিতে পড়েন দক্ষিণ-পঞ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ। উত্তরবঙ্গের যাত্রীরা টাঙ্গাইল ও ঢাকার প্রবেশমুখে আটকা পড়েন। দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা লঞ্চে গাদাগাদি করে ফেরেন গন্তব্যে। অনেকেই আসন না পেয়ে বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে ও ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চের ছাদে এসেছেন। এছাড়া যাত্রীদের গুনতে হয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া। বিভিন্ন ফেরিঘাটে ছিল ভীড়। উদাহরণ হিসেবে বাংলাবাজার ফেরিঘাটের কথাই ধরা যাক। এই ঘাটে সাধারণ যাত্রী, মোটরসাইকেল ও ছোট গাড়ির চাপ ছিল শনিবার দিনভর। বাংলাবাজার-শিমুলিয়া রুটে ফেরিতে বড় গাড়ি পারাপার বন্ধ ছিল। তবুও গাড়ির পার্কিং ইয়ার্ডে দিনভর ৪০০ থেকে ৫০০ গাড়ির জট দেখা গেছে। ফেরি পার হতে ৮-১২ ঘণ্টা সময় লেগেছে।

পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঈদের ছুটির শেষ দিন ছিল শনিবার। রবিবার থেকে সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের অফিস ও শিল্প-কারখানা খোলা শুরু হয়। এ কারণে বাস, লঞ্চ ও ট্রেনে শনিবার ছিল যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। সড়ক-মহাসড়কে গণপরিবহণ ছাড়াও ব্যক্তিগত ও মোটরসাইকেলের চাপ ছিল ভয়াবহ। এতে মানুষের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছে। সূত্র জানায়, ঈদের ছুটির শেষ দিন শনিবার দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া এবং বাংলাবাজার-শিমুলিয়া-এ দুই ফেরিঘাটে দিনভর হাজার হাজার গাড়ির দীর্ঘ সিরিয়াল ছিল। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও ফেরি মেলেনি। ফলে গাড়ির চাপে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে ১২-১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। ফেরি পার হতে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগেছে। আবার, বাংলাবাজার ফেরিঘাটে পার্কিং ইয়ার্ডে দিনভর চারশ থেকে পাঁচশ গাড়ি পারাপারের জন্য অপেক্ষায় ছিল। এই ঘাটে মোটরসাইকেলের হুড়োহুড়িতে আতঙ্কজনক পরিস্থিতির তৈরি হয়। ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি আটকে থাকায় যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হন। তবে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া এবং বাংলাবাজার-শিমুলিয়া এই দুই ফেরিঘাটে গাড়ির দীর্ঘজটে মানুষের ভোগান্তির জন্য যাত্রী ও মোটরসাইকেলের চাপকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ করপোরেশনের চেয়ারম্যান আহমদ শামীম আল রাজী। তিনি বলেন, ‘পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় ২১টি এবং শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও মাঝিরকান্দি রুটে ১০টিসহ সারা দেশে মোট ৪৯টি ফেরি চলাচল করছে। তবুও গাড়ি পার হতে দীর্ঘ সময় লাগছে। এর কারণ হচ্ছে, ঘাটে ফেরি আসলেই প্রচুর সংখ্যক যাত্রী ফেরিতে উঠে পড়ছেন। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে-মানুষের মতো প্রচুর সংখ্যক মোটরসাইকেলও ফেরিতে উঠছে। এ দুটি কারণে ফেরিতে গাড়ি উঠানো যাচ্ছে না। ফেরির ট্রিপ কার্যকর হচ্ছে না’। তিনি আরও বলেন, ‘শুক্রবার সারা রাতই ফেরিতে মোটরসাইকেল পার করা হয়েছে। এ কারণে বাসের সিরিয়াল দীর্ঘ হয়েছে’।

বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক শিহাব উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমানে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ছোট-বড় ২১টি ফেরি চলাচল করছে। চালু রয়েছে ৪টি ফেরি ঘাট। ৩টি ঘাট বন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, শুক্রবার এ রুটের দুটি ফেরি বিকল থাকাতে সমস্যা প্রকট হয়। শনিবার ভোর থেকেই মহাসড়ক যানবাহন ও যাত্রীদের ব্যাপক চাপ তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় সাধারণ যাত্রী ও ব্যক্তিগত শত শত গাড়ি ঘাটে এসে ভিড় করছে। কোনো ফেরি ঘাটে ভেড়া মাত্রই তারা হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ছেন। ফলে ফেরিতে পর্যাপ্ত বাস ও অন্যান্য যানবাহন পারাপার করা যাচ্ছে না। এতে করে মহাসড়কে দূরপাল্লার বাসের সারি দীর্ঘ হচ্ছে’।

বিআইডব্লিউটিসি সূত্র বলছে, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া এবং আরিচা-কাজিরহাট রুটে ২১টি ফেরিতে ১৩ হাজার ৭৮৩টি গাড়ি পার করা হয়। এর মধ্যে ৩ হাজার ৩০৮টি মোটরসাইকেল। অপরদিকে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া এবং মাঝিরকান্দি-শিমুলিয়া রুটে ১০টি ফেরিতে ৫ হাজার ১০২টি গাড়ি পার করা হয়, এর মধ্যে মোটরসাইকেল ছিল ২ হাজার ৬৭৭টি। মানুষ ও যানবাহনের চাপে ঘাটে তীব্র যানজট ছিল।

শুরুতে ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্নে হলেও শেষদিকে ভোগান্তি ছিল চরমে : হাসান হামিদ

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top