প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে আমরা কয়েকটা শিশু নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ হতে দেখি। এর বাইরে অসংখ্য ঘটনা, এমন চিত্র আড়ালে থেকে যায়। আর এ যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশুদের কোনো দোষ থাকে না, কিন্তু সে শিকার হয় খুন, ধর্ষণ কিংবা ভয়াবহ নির্যাতনের। প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পায় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। অনেক সময় ভোক্তভোগী আইনের আশ্রয় নিলেও অপরাধী ফাঁক-ফোঁকরে ছাড়া পেয়ে যায়। আর এসব কারণেই প্রতিনিয়ত বাড়ছে শিশু নির্যাতন। এমনকি করোনা মহামারিতে মানুষ যখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে এদেশে, এর মধ্যে ঘরবন্দি সময়ে ভয়াবহ ভাবে বেড়েছে শিশুর প্রতি সহিংসতা। সম্প্রতি আসকের করা একটি গবেষণা প্রতিবেদন দেখে আমি আঁতকে উঠেছি, আতঙ্কিত হয়েছি। নিয়মিত ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনা মোটেই স্বস্তিকর নয়। চলমান করোনা পরিস্থিতিতে বড় একটা অংশ কর্মহীন হয়েছেন, তাদের আয় কমে গেছে। কারো আয় বন্ধ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিশ্চিত জীবনযাত্রার হতাশা থেকে মানুষ সহিংস হয়ে উঠছে। এসব কমাতে হলে মানুষের অপ্রতুল জ্ঞান, বৈরী মনোভাব ও অন্যের ক্ষতি করার মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য কার্যকর তথ্য, অংশগ্রহণের মঞ্চ এবং উপযুক্ত নীতি নিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু সেই কাজ করবে কে?
এসব নিয়ে কাজ করা যাদের সেসব সরকারি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা কেবল চাকরিটা করতে পেরেই খুশি। তাদের মাথাব্যথা থাকে ইনক্রিমেন্ট, বেতন, বোনাস নিয়ে। দেশ নিয়ে, মানুষ নিয়ে ভাবার মতো মন-মেধা এদের বেশিরভাগেরই নেই। যারা রাজনীতি করেন তারা দলের নেতাদের জন্ম আর মৃত্যু বার্ষিকীতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে মনে করে, এইটাই রাজনীতি। এর বাইরে এদের সবাই না হলেও বেশির ভাগ মেতে থাকে চুরি-চামারি আর চামচামিতে। ফলে অল্প কিছু কাজ হচ্ছে বেসরকারি কিছু সংস্থার মাধ্যমে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে এ দেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
সবাই উন্নয়ন বলতে রাস্তা ঠিক করা আর ব্রিজ বানানো, বৃহৎ দালাল তৈরিকে বুঝে এখন। সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে ভাবছে না কেউ। এভাবে অপরাধ কমবে? সকলের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া সুষ্ঠু সমাজ গড়ে উঠবে কীভাবে? আর আইনের প্রয়োগ এ দেশে কতোটা হয় আমরা তা সবাই জানি। অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবিত করে ফেলা হয় এখানকার বিচার ব্যবস্থাপনার অনেক কিছু। ফলে শিশুকে নির্যাতন করেও একজন যখন পার পেয়ে যাচ্ছে, তখন এসব ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে কোনো উন্নয়নের সুফল আমাদের কাজে লাগবে না। শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ সমাজ কাঠামো আমরা যদি গড়ে তুলতে না পারি, তবে সবকিছুই মুখ থুবড়ে পড়বে।
ইউনিসেফ বলছে, দেশের ৫ থেকে ১২ বছরের শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ৭০ শতাংশই যৌন নির্যাতনের শিকার হয় আমাদের দেশে। আর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৭ মাসে হত্যার শিকার হয়েছে ৩৬৫ শিশু। এদের মধ্যে অনেকে গৃহকর্মী। এ ছাড়া ৪৬২ শিশু ধর্ষণের ও অর্ধশতাধিক শিশু বলাৎকারের শিকার হয়েছে। এ সময় শিশুর প্রতি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ১৯৯টি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, করোনার সময় শিশু ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ও এর ভয়াবহতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। গত বছর ২০২০ সালে একই সময়ে শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ছিল ৯৮৬টি। ২০১৯ সালে বছরজুড়ে ঘটেছিল দুই হাজার ১৮৪টি শিশু নির্যাতনের ঘটনা। আগের বছর যা ছিল এক হাজার ৫৩২টি। গবেষকরা বলছেন, করোনা মহামারি সামাজিক অস্থিরতা ও শিশু নির্যাতনের প্রবণতা বাড়িয়েছে। বিচারহীনতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং বিকৃত মানসিকতার কারণে শিশুর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে।
আমাদের দেশের মানুষের আচরণ দিন দিন আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে নানা খারাপ দিক দিয়ে। সমাজ হয়ে উঠছে বসবাসের অযোগ্য ও অনিরাপদ। অথচ আমরা জানি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য মানুষের সামাজিক আচরণের কারণগুলোর দিকে নজর দিতে হয়। এ দেশে দীর্ঘ দিন ধরে যেসব আচরণ শিশুর অধিকারকে ক্ষুণ্ন করছে স্বাস্থ্য থেকে শিক্ষা পর্যন্ত সেসব আচরণের সুস্পষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আর আমরা জানি, বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার আওতায় সবাই সুবিধা পায়নি বলে অনেক পরিবার শিশুদের চাহিদা মেটাতে পারছে না। এসব শিশুর অধিকার, বিকাশ ও সুরক্ষা নিয়ে কোনো কথাও তারা বলতে পারছে না। আর তাদের বেশির ভাগ শিশুর জন্য যেসব সেবা রয়েছে সে বিষয়গুলো সম্পর্কেও জানে না।
খবরের কাগজে প্রকাশিত হাজার ঘটনার দুইটি সংবাদ আমি উল্লেখ করছি। পত্রিকায় এসেছে, গত ২২ জুলাই রাতে সিলেটে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত ছোটমণি নিবাসে দুই মাস বয়সী শিশু নাবিল কান্না করলে আয়া সুলতানা বিরক্ত হয়ে তাকে বিছানা থেকে ছুড়ে ফেলেন। বিছানার স্টিলের রেলিংয়ে বাড়ি খেয়ে নাবিল মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারায়। তার মুখের ওপর বালিশচাপা দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
গত ৯ আগস্ট ৫ বছরের শিশু জিসানুল ইসলাম আকাইদকে হাত-পা বেঁধে ক্ষুর দিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়। মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের জন্য তাকে অপহরণ করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। রাজধানী খিলগাঁওয়ের মধ্য নন্দীপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এসব থেকেই বোঝা যায় এ দেশ শিশুদের জন্য কতটা অনিরাপদ হয়ে আছে। দেশে কিন্তু শিশু আইন আছে। এই আইন ১৯৭৪ সাল থেকেই ছিল। শিশু অধিকার বিষয়ক এই পুরনো আইনটি সময়ের চাহিদা পূরণে যথার্থ ছিল না। এজন্য আগের আইনটি বাতিল করে ২০১৩ সালে প্রণীত হয় নতুন একটি আইন। আন্তর্জাতিক আইনের আলোকেই আমাদের শিশু আইনটি প্রণয়ন করা হয়। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে শিশুদের বিশেষ অধিকারের কথা বলা আছে। এ বিশেষ অধিকারগুলো শিশুর বেড়ে ওঠা ও নিরাপদ শৈশবের জন্য অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক আইনের এ বিধানগুলো আমাদের ২০১৩ সালের আইনেও স্থান পেয়েছে। কিন্তু শিশু নির্যাতন বন্ধ হয়নি।
কেন বন্ধ হয়নি? কারণ আইনের প্রয়োগ না হলে তা কাগুজে বাঘই রয়ে যায়। আর শিশু নির্যাতনের বিচার করা আরো কঠিন। কারণ শিশুরা ভয়ে নির্যাতনের কথা গোপন রাখে। তাদেরকে নানাভাবে ভয়-ভীতি দেখানো হয়। প্রলুব্ধ করা হয়। সেই সাথে অনেক নির্যাতনের কোনো সাক্ষী থাকে না। শিশু নির্যাতনের মতো পৈশাচিক ঘটনার সাথে যেসব অপরাধীরা জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা আইনগত ও সামাজিক দায়িত্ব। আর সমাজে অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। কোনো শিশুকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার ঘটনা বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত ২৭, ৩১, ৩২ ও ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে বর্ণিত সাংবিধানিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। শিশু আইন ২০১৩-এর ৭০ ধারা অনুযায়ী শিশুদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক নিষ্ঠুর আচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আমাদের মনে রাখতে হবে, জাতি গঠনে শিশু অধিকার সুরক্ষা ও শিশু কল্যাণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। করোনার মধ্যেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য শিশুর প্রতি নৃশংসতার শত শত ঘটনা ঘটেছে। একের পর এক শিশু নির্যাতনের ঘটনায় দেশের সামগ্রিক শিশু অধিকার আজ প্রশ্নবিদ্ধ। শিশুর শৈশবের সব পর্যায়ের কথা বিবেচনায় নিয়ে সামাজিক আচরণের একটা রূপরেখা তৈরি করে সেটির ব্যাপক প্রচার ও কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পরিবারের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রকে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। নির্যাতনের ঘটনাগুলো তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে প্রশাসনকে। তবেই সুফল পেতে শুরু করব আমরা।
প্রকাশিত পত্রিকা- সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৪ অক্টোবর, ২০২১; দৈনিক সমকাল, ১৯ অক্টোবর, ২০২১