হাসান হামিদ
রবীন্দ্রনাথের একটি কথা দিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করব। ‘শিক্ষাসমস্যা’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, “বালকদিগের হৃদয় যখন নবীন আছে, কৌতুহল যখন সজীব এবং সমুদয় ইন্দ্রিয়শক্তি যখন সতেজ তখনই তাহাদিগকে মেঘ ও রৌদ্রের লীলাভূমি অবারিত আকাশের তলে খেলা করিতে দাও…তরুলতার শাখাপল্লবিত নাট্যশালায় ছয় অঙ্কে ছয় ঋতুর নানা রস বিচিত্র গীতি নাট্যাভিনয় তাহাদের সম্মুখে ঘটিতে দাও”। কবিগুরুর এ সুপারিশ শিক্ষা নিয়ে সৃষ্টি হওয়া আজকের পরিস্থিতির ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। আমাদের দেশে করোনা পরিস্থিতির কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবই বন্ধ। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখছি, তখন শিক্ষার্থীরা কিন্তু বেশিরভাগ ঘরে বসে নেই। তারা দলবেধে ঘুরতে যাচ্ছে, এমন ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গতবার সেপ্টেম্বরের পর অন্তত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চালু করতে পারতাম। অনেক দেশেই যখন সংক্রমণ কমেছে তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। আমরা তা করিনি। আমরা যদি সুযোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখতাম, তাহলে টানা ১৭ মাসের এ দীর্ঘ বন্ধের ইতিহাস তৈরি হত না।
সংক্রমণ কমলেও সেই সুযোগগুলোতে আমরা পরীক্ষা নিতে পারিনি, আমাদের প্রস্তুতি ছিল না বলেই। যার ফলে সব পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে এবং একাডেমিক ক্যালেন্ডার আর মেনে চলা সম্ভব হয়নি। স্কুল-কলেজ বন্ধের পর, সরকার মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য সংসদ টেলিভিশনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে। পরে বিভিন্ন সময় স্কুল-কলেজে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার চেষ্টা করলেও তা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি বলেই মনে হয়। কারণ শহরাঞ্চলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটের মাধ্যমে শেখার সুযোগ থাকলেও ডিভাইসের অভাব ও ইন্টারনেটের দুর্বল গতির কারণে ডিজিটাল সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় অসুবিধা। ফলে শিক্ষার্থীদের ভয়ানক ক্ষতিই হয়ে গেল। ঘরে বসে তো আর শিক্ষা গ্রহণ হয় না আসলে। রবীন্দ্রনাথের কথায়, “শিশুবয়সে নির্জীব শিক্ষার মতো ভয়ংকর ভার আর কিছুই নাই; তাহা মনকে যতটা দেয় তাহার চেয়ে পিষিয়া বাহির করে অনেক বেশি” (পথের সঞ্চয়/শিক্ষাবিধি)। অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যে মূল্যায়ণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে পুরোপুরি মূল্যায়ণ তো হচ্ছে না। তাই শিক্ষার্থীদের ক্ষতিটার দিকে লক্ষ রাখতে হবে বেশি। এর মধ্যে পত্রিকায় দেখলাম, চলমান ছুটি আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। সে অনুযায়ী, ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলমান ছুটি অব্যাহত থাকবে। অবশ্য স্বস্তি পেয়েছি, ১৭ অক্টোবর থেকে ধাপে ধাপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলা হবে- এমন ঘোষণা এসেছে বলে। আমাদের প্রত্যাশা স্কুল-কলেজ দ্রুত খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা বলেছে, বাংলাদেশে করোনা মহামারির পুরোটা সময়জুড়েই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। করোনার কারণে যেসব দেশে দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। আর মহামারিতে দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাংলাদেশের প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবেদনে তারা আরও বলেছে, যত বেশি সময় শিশুরা স্কুলের বাইরে থাকবে সহিংসতা, শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ের ঝুঁকির কারণে তাদের স্কুলে ফেরার সম্ভাবনা ততই কমে যাবে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, মহামারির কারণে প্রথমবার স্কুলে যাওয়ার উপযোগী বিশ্বের ১৪ কোটি শিশুর পাঠচক্রে ঢোকার সুযোগ পিছিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ৪০ লাখ শিশুও রয়েছে। সশরীরে শিক্ষা গ্রহণের প্রথম দিনটির জন্য তারা এক বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছে। তাদের অপেক্ষার পালা বেড়েই চলেছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। দীর্ঘ সময় শিক্ষার বাইরে থাকায় তারা স্কুল বিমুখ হয়ে যেতে পারে। এসব মাথায় নিয়ে, শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু সিলেবাস কাটছাঁট করে পরীক্ষা নিলেই হবে না।
স্বস্তির কথা এই, কয়েক দিন ধরে সরকারের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে আলোচনা জোরদার হয়েছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং টিকা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রস্তুতি শুরু করে। এই ধারাবাহিকতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি সভাও হয়। সভা শেষে সংশ্লিষ্টরা গণমাধ্যমকে জানান, সংক্রমণের হার ৭-৮ শতাংশ থাকলেও খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাছাড়া এরই মধ্যে মাঠপর্যায়ে স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষকে যে কোনো সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে বলেছে মন্ত্রণালয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে কীভাবে ক্লাস চলবে, সে ব্যাপারে একটি নির্দেশনা দেওয়া দরকার এখনই। যাতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিষয়গুলো আগে থেকে জেনে প্রস্তুতি নিতে পারে, আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কি না- এর জন্য প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। তবে আমরা মোটামুটি বুঝতে পারছি যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা হলো প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া। পরে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষাদান বিষয়ে এক জায়গায় বলেছেন, “বিদ্যা হল আহরণের বস্তু, শিক্ষা আচরণের”। আমরা এ-বিষয়টি মাঝেমধ্যে ভুলে যাই। আমাদের ছেলেমেয়েরা বাসায় থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। অনলাইনে যতটুকু ক্লাস হয় তা একেবারেই যথেষ্ট নয়। অনেক অভিভাবকের সাথে আমি কথা বলেছি। তারা বলেছেন, ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় আছেন সবাই। যেভাবে কয়দিন পর পর স্কুল কলেজ খোলার সময় বাড়াচ্ছে তাতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিভাবকরা হতাশায় ভোগছেন। মানসিক ভাবে শিক্ষার্থীরাও ভালো নেই। এখন করোনা সংক্রমণের হার কম; চাইলেই সরকার এখান স্কুল কলেজ খুলে দিতে পারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। অভিভাবকদের দাবি এখন স্কুল কলেজ খুলে দেয়া হোক।
চীনা প্রবাদে আছে, If you are planning for a year, sow rice; if you are planning for a decade, plant trees; if you are planning for a lifetime, educate people. আর আমাদের তাই এই মহামারিতে শিক্ষার ক্ষতি নিয়ে এখনই ভাবা উচিত। স্কুল-কলেজ খোলার পর শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তার জন্য বিস্তৃত পরিসরে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। গত ১৭ মাসে অনেক বার উদ্যোগ নেওয়া হলেও মহামারি পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় স্কুল-কলেজ খোলা যায়নি। এই দীর্ঘ সময় ধরে সরাসরি পাঠদান বন্ধ আছে। ফলে পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতার ওপর বিরূপ প্রভাব যাতে না পড়ে তার জন্য করণীয় নিয়ে এখনই নীতি নির্ধারকদের ভাবতে হবে। এই করোনায় অধিক দারিদ্র্য ও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিনিয়োগ করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর এই শিক্ষা সংকট যাতে শিক্ষা বিপর্যয়ের দিকে না যায়, সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব স্কুল খুলে দেওয়াই উচিত। এর জন্য যা করা দরকার, অবিলম্বে সেসব পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রকাশিত পত্রিকা- সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৭ আগস্ট, ২০২১