হাসান হামিদ
পৃথিবীজুড়ে মানুষের সময় যাচ্ছে ভয়াবহ উদ্বিগ্নতায়, সীমাহীন দুর্ভাবনার ভেতর দিয়ে। সংক্রামক করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। কয়েকটি দেশে কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হলেও বেশিরভাগ দেশে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। পরিসংখ্যানে প্রতিদিন আরও নতুন সংখ্যা যোগ হচ্ছে। সবাই করোনার ভয়ে প্রায় দুই মাস অবরুদ্ধ থাকার পর মাস খানেক ধরে অফিস-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এসব সীমিত আকারে চলছে। তবে এখনও আমাদের দেশসহ অনেক দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কার্যত সারা পৃথিবীর শিক্ষাব্যবস্থাই এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছে বলা যায়। কয়েকদিন আগে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের একটি বুলেটিনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বের অন্তত ৯০ শতাংশ স্কুল বন্ধ করা হয়েছিল। এর মধ্যে চায়না, জাপান, ডেনমার্ক, নরওয়েসহ কয়েকটি রাষ্ট্র ইতোমধ্যে প্রাইমারি স্কুল রি-ওপেন করেছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। তবে, ইউনেস্কোর একটি বুলেটিনে দেখা গেছে, ৭১টি দেশ স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত দিলেও বিশ্বের অন্তত ১২৮টি দেশ এখনও স্কুল বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এর মধ্যে আমাদের দেশে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিবিষয়ক নানা পরিকল্পনার কথা আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারছি। শিক্ষা নিয়েও কম হলেও কিছু পরিকল্পনার কথা আজকাল শোনা যাচ্ছে। অন্যান্য অনেক দেশের মতো শিক্ষা কার্যক্রম টিভি ও অনলাইনে চলছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কিছু পরিকল্পনার খবর আমরা পত্রিকায় পড়েছি। কিন্তু আমার প্রশ্ন সেইসব নীতি ও পরিকল্পনার কার্যকারিতা নিয়ে। কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, জীবন বাঁচানোর কার্যক্রম যেখানে পর্যাপ্ত নয়, সেখানে শিক্ষা নিয়ে এই সময়ে কথা বলা কতটা স্বাভাবিক? কিন্তু আসল ব্যাপার হলো শিক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে জীবন বাঁচানোর জন্যই। শিক্ষাকে অবহেলা করে আমরা আগামীর করোনামুক্ত পৃথিবীতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পাব না, কখনোই না। সুতরাং শিক্ষা নিয়ে আমাদের সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা এখনই নিতে হবে।
করোনা এখনই যাচ্ছে না
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, কোভিড-১৯ এখন বিশ্বের আনাচকানাচে ছড়িয়ে পড়েছে, দিন দিন তা আরও সংক্রমিত করছে মানুষকে।অনেকে বলছেন, করোনা ভাইরাসের এটি প্রথম ধাপ। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারিতে বিশ্বের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ আক্রান্ত হয়েছিল। সেই সময় প্রথম ধাপে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে স্প্যানিশ ফ্লুর আক্রমণ মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। আর করোনাভাইরাসের স্বভাব অনেকটা স্প্যানিশ ফ্লুর মতো মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মার্কিন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের পরিচালক রবার্ট রেডফিল্ড ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’কে বলেছেন, আগামী শীত মৌসুমে ভাইরাসটির আক্রমণ আরও বেশি কঠিন হয়ে ওঠার আশঙ্কা আছে। তার মানে এটি লম্বা সময় ধরে থাকার এবং পরবর্তী ধাপে পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষাপঞ্জিকা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। শিক্ষার পুরো সিলেবাস, ক্লাস, পরীক্ষা এবং সব ধরনের মূল্যায়ন কার্যক্রম কীভাবে হতে পারে, তা নিয়ে দ্রুত চিন্তা করতে হবে। সেই বিষয়গুলো শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পরিষ্কার করে জানাতে ও বুঝাতে হবে। কার্যত শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা থেকে দূরে থাকছে অনেক ক্ষেত্রেই। সে ক্ষেত্রে সিলেবাস সীমিত করে তাদের অল্প দিন পাঠদানের পর পরীক্ষা আয়োজন করা যাবে।
তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, তাদের স্পষ্ট কোনো গাইডলাইন এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। আর বিদ্যালয় যদি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকে, তাহলে একটি মাত্র মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পরের শ্রেণিতে উন্নীত করার ব্যবস্থা নেওয়া যাবে হয়তো; কিন্তু করোনা যদি আরও সময় ধরে থাকে তাহলে কী হবে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম? সেই পরিকল্পনা নিয়ে শিক্ষার নীতিনির্ধারকেরা কিছু কি ভাবছেন? কারণ, করোনা নামের এই ভাইরাস দীর্ঘদিন পৃথিবীতে থাকতে পারে, এমন আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শিক্ষার সাথে শিক্ষার্থীদের দূরত্ব বাড়ছে
করোনার প্রকোপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ৮০ শতাংশ কমেছে। আগে প্রতিদিন গড়ে পড়াশোনায় ১০ ঘণ্টা সময় ব্যয় হতো যা নেমেছে ২ ঘণ্টায়। এছাড়া শিশুশ্রম ও গৃহকর্ম বেড়েছে শিক্ষার্থীদের। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এর এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিআইজিডির ‘কোভিড-১৯, স্কুলিং এন্ড লার্নিং’ শীর্ষক এ গবেষণায় মূলত গ্রামীণ বাংলাদেশকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিআইজিডি তাদের গবেষণায় বলেছে, করোনার প্রভাবের আগে দিনে শিক্ষার্থীরা ১০ ঘণ্টা সময় ব্যয় করত, যেখানে এখন তা ২ ঘণ্টা হয়। অর্থাৎ আগের চেয়ে পড়াশোনা ৮০ ভাগ কমেছে। সরকার টেলিভিশনের মাধ্যমে ‘ঘরে বসে শিখি’ ও ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ নামে দুটি পাঠ কার্যক্রম চালু করেছে, যা দেখছে মাত্র ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর মাত্র ১ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস করছে। শিক্ষার্থীদের ৬২ ভাগের বাসায় টিভি এবং ৩০ ভাগের বাসায় ইন্টারনেট সুবিধা আছে। গবেষণায় বলা হয়, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে মা-বাবার শিক্ষাগত যোগ্যতাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যাদের মা-বাবার পড়াশোনা অন্তত এসএসসি পাস বা তার বেশি, তারা টিভিতে ও অনলাইনে ক্লাস বেশি করে।
শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা
করোনার এই সময়ে পড়াশোনা অনেক ক্ষেত্রেই শিকেয় উঠেছে। এতে করে কেমন আছে আমাদের শিক্ষার্থীরা? বুঝতে হলে ওয়ার্ল্ড ভিশনের এক জরিপে আপনাকে চোখ বোলাতে হবে। ওয়ার্ল্ড ভিশনের ‘চিলড্রেন ভয়েসেস ইন দ্য টাইম অব কোভিড-১৯’ শিরোনামে প্রকাশিত এই জরিপে বলা হয়, মহামারির সময়ে স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতনের জন্য সরাসরি তিনটি কারণকে উল্লেখ করেছে শিশু–কিশোরেরা। সেগুলো হলো শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া, সামাজিক দূরত্বের কারণে মানসিক চাপ এবং পরিবারে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া। শতকরা ৭১ ভাগ শিশু ও তরুণ বলেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে তারা নিজেদের শিক্ষাজীবন নিয়ে চিন্তিত। তারা বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ অনুভব করছে। ওয়ার্ল্ড ভিশন ১৩টি উন্নয়নশীল দেশে এই জরিপ চালিয়েছে। দীর্ঘদিন এমন থাকলে শিশু–কিশোরদের দ্বিধা, ভয় ও হতাশা আরও বাড়বে। এর থেকে সরে আসতে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানসিকস্বাস্থ্যের পরিবর্তনের বিষয় উঠে এসেছে বিআইজিডির আরেকটি গবেষণায়। সেখানে বলা হয়েছে, করোনার আগে শিক্ষার্থীদের ৮৭ শতাংশ সুখী ছিল, এখন তা ৭২ শতাংশ। আগে ৭৩ শতাংশের কোনো চিন্তা ছিল না, যা এখন ৫৯ শতাংশ করে। করোনার আগে ১৪ শতাংশ দুঃখী ও ১০ শতাংশ ভীত ছিল। এখন এ পরিমাণ ৩২ ও ৩৬ শতাংশ।
পরীক্ষা কবে হবে?
করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ার কারণে অন্তত চারটি পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা অনিশ্চয়তা। এর মধ্যে স্থগিত রাখা হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষা। আবার আগামী নভেম্বরে নির্ধারিত পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির দুটি সমাপনী পরীক্ষার কী হবে, তা–ও আমরা জানি না। আর পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির দুই সমাপনী পরীক্ষা সময়মতো নেওয়া হলে কাটছাঁট করতে হবে সিলেবাস। নইলে শিক্ষার্থীরা চাপে পড়বে। সেই সীমিত সিলেবাসের আকার কেমন হতে পারে, তা নিয়েও আগে থেকে শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে। সিলেবাস সীমিত হবে বলা হচ্ছে, কিন্তু স্পষ্ট কিছু জানে না শিক্ষার্থীরা। পত্রিকার খবর বিশ্লেষণ করে বলা যায়, আগামী জেএসসি, প্রাথমিক সমাপনী, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য এসএসসি ও আগামী এপ্রিলে অনুষ্ঠিতব্য এইচএসসি পরীক্ষার কী হবে, তা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডগুলো এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না। অবশ্য তা পারার কথাও নয়। কেননা পাঠদান ও অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন যদি বন্ধ থাকে, তাহলে পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম
প্রাথমিক শিক্ষায় নতুন ৮টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য কাজও শুরু করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এরমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য ‘হ্যালো টিচার’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপস তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা এই অ্যাপস দিয়ে শিক্ষার্থীরা পছন্দের শিক্ষক বাছাই করে পরামর্শ নিতে পারবে। সেক্ষেত্রে অভিভাবকদের ফোন ব্যবহার করে হ্যালো টিচার অ্যাপসের মাধ্যমে শিশুরা তাদের প্রশ্নের উত্তর জানতে পারবে। এছাড়া জুম অ্যাপস ব্যবহার করে প্রধান শিক্ষকরা সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের সাঙ্গে সভা করবেন; টেলিভিশনে ‘ঘরে বসে শিখি’ কার্যক্রমে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী যেন যুক্ত করতে অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকরা যোগাযোগ করবেন; স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের শিক্ষকরা প্রশ্নপত্র তৈরি করে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে কিংবা ফোনে শিক্ষার্থীদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তা মূল্যায়নের ব্যবস্থা করবেন। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কর্মকর্তারা ‘রিকভারি অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি করে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠাবেন। প্রত্যেক বিদ্যালয়ের নামে ফেসবুক আইডি খুলতে হবে। শিক্ষকরা পাঠদান ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড দেবেন।
অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণের সুযোগ সবার নেই
আমাদের দেশেও যথাযথ সময়ে করোনা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে টিভিতে সীমিত আকারে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠদান চলছে। কেবল এটিতে আসলে ক্ষতি কাটবে না। অবশ্য অনেকেই টিভিতে ক্লাসের এই ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, যাদের টিভি নেই তারা দেখবে কীভাবে? ব্র্যাক শিক্ষাকর্মীদের করা এক হিসাবে দেখা যায়, টিভির ক্লাস গড়ে চল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশ শতাংশ শিক্ষার্থী দেখছে। গ্রামে অনেকের টিভি নেই, আবার কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ থাকে না। ফেসবুক ও ইউটিউবে এই পাঠগুলো পাওয়া গেলেও প্রত্যন্ত এলাকায় নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে অনেকে তা চাইলেও দেখতে পারে না। আর তার চেয়ে বড় কথা আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পরিবার দরিদ্র। কার্যত এসব ব্যবস্থা তাদের তেমন কাজে আসবে না। কেননা, দেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থীর বড় একটি অংশ টিভি, ফেসবুক কিংবা ইউটিউবের মাধ্যমে পাঠদানের সুবিধা নিতে পারবে না। তবে শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর শিক্ষার্থীরা এ সুবিধার আওতায় আসতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে দরিদ্র পরিবার অনেক। সেসব পরিবারের শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখেই সরকারকে পুরো পরিকল্পনা সাজাতে হবে। পুরো প্রক্রিয়ায় সরকার, শিক্ষাবিদ, প্রযুক্তি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, টেলিকম এজেন্সি, সুশীল সমাজ এবং এনজিওগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। দেশে যার যে দক্ষতা আছে, এই সময়ে সেগুলো কাজে লাগাতে হবে। যেমন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণের প্রযুক্তি রয়েছে। এই সময়েই এটি আমরা কাজে লাগাতে পারি।
হাওরে বন্যা ও করোনা একসাথে
হাওর এলাকায় বিশেষ করে সুনামগঞ্জ জেলায় গত ২৭ জুন থেকে ব্যাপক পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে বন্যা শুরু হয়। প্রথম দফাতেই সীমান্ত সংলগ্ন সদর, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলার একাংশে মানুষের কাচাপাকা ঘরবাড়িতে বন্যার পানি উঠে। জেলার প্রধান নদী সুরমার পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে নদীর তীরবর্তী বাসিন্দারা পানিবন্দী হয়ে অবর্ণনীয় দূর্ভোগে পড়েন। দুদিন ধরে সুরমার পানি কমলেও নিচু এলাকায় পানি বাড়ছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ। মানুষের পাশাপাশি ঘরবাড়ী,গবাদিপশু ও রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা শিক্ষা উপকরণের অপ্রতুলতা নিয়েই সব সময় পড়াশোনা করে। এদের অনলাইনে বা টিভিতে পড়াশোনায় যুক্ত হবার সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পাঠদান বন্ধ হওয়ায় অনলাইন, ফেসবুক গ্রুপ ও টেলিভিশন মাধ্যমে পাঠদানের যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে, হাওরপাড়ের স্কুলগুলোতে এসব মাধ্যমে পরিচালিত পাঠদান নানান প্রতিবন্ধকতা থাকার কারণে ফলপ্রসূ হবার সম্ভাবনা কম। এখানকার শিক্ষার্থীদের জন্য এই সময়ে আলাদা নীতি বা পরিকল্পনা না করলে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বে। আর বড় এই সংখ্যাটিকে এড়িয়ে গেলে শিক্ষায় বৈষম্য আরও প্রকট হবে।
শিক্ষা কার্যক্রম সমন্বয়ে ফেসবুক ব্যবহার
বাংলাদেশের সব প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম সমন্বয়ের কাজে ফেসবুককে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। সবগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তৈরি করা একটি ফেসবুক গ্রুপে এবং একটি ফেসবুক পেইজে যুক্ত হতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে। প্রাইমারি স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের সাপ্তাহিক পাঠ্যসূচী সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার অগ্রগতি সম্পর্কে জানা এবং দাপ্তরিক বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত সম্পর্কে স্কুলগুলোকে নিয়মিত ওয়াকিবহাল করার উদ্দেশ্যে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, প্রাথমিক স্কুলগুলোর কার্যক্রম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে স্কুলগুলোর প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা নিয়মিত বিরতিতে মিটিং করতেন। কিন্তু করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে সেসব মিটিং আয়োজন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই ফেসবুকের সাহায্যে সবাইকে যুক্ত করার চেষ্টা চলছে।
পরিকল্পনা কতটুকু কার্যকর হবে?
বাংলাদেশে মোট প্রাথমিক স্কুল রয়েছে ৬৫ হাজারের মত। সেগুলোর মধ্যে থেকে ৩০ হাজারের মত স্কুলের প্রধান শিক্ষক অধিদপ্তরের ফেসবুক গ্রুপের সাথে যুক্ত করার লক্ষ্য রয়েছে রয়েছে অধিদপ্তরের। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অর্ধেকেরও বেশি প্রাথমিক স্কুলকে যুক্ত না করে কীভাবে এই পরিকল্পনায় সাফল্য পাওয়া সম্ভব? বাংলাদেশের অনেক গ্রাম এবং উপজেলায় ইন্টারনেট সুবিধা অপ্রতুল, আবার অনেক স্কুলের শিক্ষকরাই সোশ্যাল মিডিয়ার মত প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে দক্ষ নয়। তাই সেসব মাথায় রেখে ভাবতে হবে। তবে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব চলাকালীন সময় প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ফেসবুকের মাধ্যমে স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের সংযুক্ত রাখার প্রয়াস কাজে দেবে বলে আমার ধারণা। মনে রাখতে হবে, চর, হাওর বা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের অনেক স্কুলের প্রধান শিক্ষকই যথাযথ ইন্টারনেট সুবিধা পান না। তাদেরকে সংযুক্ত রাখার জন্য বিকল্প চিন্তা মাথায় রাখতে হবে।
দরকার সব বিষয়ের গাইড লাইন
আসলে করোনায় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ধারাবাহিকতা রক্ষাই আমাদের এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আর শিক্ষার ধারাবাহিকতা ধরে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি তথ্য মতে, প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে সারাদেশে দুই কোটি নয় লাখ ঊনিশ হাজার দুইশ’ একজন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এই শিশুদের শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ার আগে স্বাস্থ্যবিধি ও সুরক্ষা নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনও উদ্যোগ নেওয়ার খবর আমরা এখনও পাইনি। করোনা মহামারি কবে শেষ তা নিয়ে কথা বলা অনিশ্চিত হওয়ায় স্কুলগুলোকে পুনরায় খোলার আগে বেশ কয়েকটি বিষয়কে বিবেচনায় রাখতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ হলো শিশুদের স্বাস্থ্য। করোনা ঝুঁকি শেষে যখন স্কুল খোলা হয়, তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয় থাকায় সবরকম স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে শিশুদের স্কুলগামী করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে আমাদের জন্য। আবার গত মার্চ থেকে পড়াশোনায় যে ঘাটতি হয়েছে, তা রিকভার করা; রিকভারের পদ্ধতি কী হবে, তা ঠিক করা; শ্রেণিকক্ষ, পরিবহন, স্যানিটাইজেশন ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী সম্পন্ন করা; ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার, ঘন ঘন তাপমাত্রা চেকাপ, বারবার হাত ধোয়াসহ সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি শিশুদের বুঝিয়ে দিতে গাইডলাইন তৈরি করতে হবে।
স্কুল-কলেজ ছাড়া সব কিছু সীমিত আকারে খুলছে। তবে অবস্থা আরও দীর্ঘায়িত হলে অচিরেই হয়তো আমরা হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে অন্ধকার দেখবো। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বিজ্ঞানশাস্ত্রে বলে, চক্ষুষ্মান প্রাণীরা যখন দীর্ঘকাল গুহাবাসী হইয়া থাকে তখন তাহারা দৃষ্টিশক্তি হারায়।’ না, আমরা আশাহত হতে রাজি নই। রবীন্দ্রনাথের কথা আবারও বলি, ‘আশা করিবার অধিকারই মানুষের শক্তিকে প্রবল করিয়া তোলে।’ আশা করছি, দ্রুত এ সংকট আমরা কাটিয়ে উঠবো। আর এ সমস্যা মোকাবিলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে সম্মিলিত চিন্তা নিয়ে। দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী অনেক। সরকারের পক্ষেই কেবল সম্ভব এদের শিক্ষা কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়, সে জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা জানি, এ দেশে বহু অনুৎপাদনশীল খাতে, অযথা রাষ্ট্রীয় সম্পদ অনেক সময় ব্যয় করা হয়। অথচ সেগুলোর কোনো প্রয়োজনই নেই। তাই জরুরি এই খাতে সরকার যেন পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে ব্যবস্থা করে দেয়, তা আমরা চাই। কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মহামারি বা জরুরি অবস্থার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, যত বেশি সময় শিশুরা বিদ্যালয় থেকে দূরে থাকে, তাদের বিদ্যালয়ে ফেরার সম্ভাবনা ততটাই কমে যায়। করোনায় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এ অবস্থা আমরা কোনোভাবেই চাই না। তাই করোনাকালে শিশুদের লেখাপড়া যাতে ঠিকমতো চলে, তার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বাজেট দিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক মানবকণ্ঠ, ০৫ জুলাই, ২০২০