শিক্ষানীতি সংশোধনের আগে যা ভাবা উচিত

হাসান হামিদ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি প্রবন্ধ আছে। সেখানে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘‘আমরা চাই আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি এমন হউক যাহা আমাদের জীবনী শক্তিকে ক্রমেই সজাগ, জীবন্ত করিয়া তুলিবে। যে শিক্ষা ছেলেদের দেহ-মন দুইকেই পুষ্ট করে তাহাই হইবে আমাদের শিক্ষা। মেদা-মারা ছেলের চাইতে সে হিসেবে ডানপিটে ছেলে বরং অনেক ভাল। কারণ পূর্বোক্ত নিরীহ জীবরূপী ছেলেদের ‘জান’ থাকে না; আর যাহার ‘জান’ নাই, সে মোর্দা দিয়ে কোন কাজই হয় নাই আর হইবেও না। এই দুই শক্তিকে– প্রাণশক্তি আর কর্মশক্তিকে একত্রীভূত করাই যেন আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হয়।’’ (নজরুল রচনাবলী, প্রথম খন্ড, বাংলা একাডেমি)। আসলেই তাই। যে শিক্ষায় জীবনীশক্তি অর্জন হয় না সেই শিক্ষায় কোনো কাজ নেই। কয়েক দিন ধরে শিক্ষানীতি সংশোধন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সেটি সম্পর্কে একটু বলবো আজকে।

অন্য আর অনেক কিছুই স্বাভাবিক হওয়ার দিকে ছুটলেও আমাদের দেশে শিক্ষার সবকিছু থমকে আছে করোনার কবলে পড়ে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে স্কুল খোলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে সব পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন, তারা মনে করছেন না এখনও স্কুল খোলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়েছে। এর মধ্যে খবরের কাগজে দেখলাম, শিক্ষানীতি সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। আমরা লক্ষ করলে দেখি, চলমান শিক্ষানীতিটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক কিছুই ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিল। তবু প্রায় দশ বছর আগে বর্তমান শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। দশ বছর অনেক লম্বা সময়। এই এক দশকে বদলে গেছে পৃথিবীর অনেক কিছু। দীর্ঘ এই সময়ে আমাদের দেশেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দ্রুত বদলে যাচ্ছে কর্মের ধারণা, দরকারি দক্ষতার ধরন এবং এরকম যা কিছু আছে। তাই এখন সময় এসেছে শিক্ষানীতিকে সংশোধন, পরিমার্জন ও সংযোজন করার। আর এ কাজ করার আগে কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। যদিও এ নিয়ে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে এ কাজে আমরা কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছি এটা প্রশ্নাতীত বিষয় নই। শিক্ষার অনেক কিছু নিয়ে আমাদের উদাসীনতা একেবারে নতুন নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে এ কারণেই বলেছেন, ‘‘শিক্ষার জন্য আমরা আবদার করিয়াছি, গরজ করি নাই।’’ সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে উদাসীনতা এবং অদূরদর্শিতা থাকলে হয়তো আগের করা নীতির মতো এখনকারটিও ঠিকঠাক যুগের উপযুক্ত হবে না।

আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে উনপঞ্চাশ বছর আগে। এই সময়ে এদেশের  এক সরকার শিক্ষানীতি করেছে তো আরেক সরকার সেটিকে বাতিল করেছে। ফলে কোনো শিক্ষানীতিই সেই অর্থে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময়ে যে সরকার ক্ষমতায় ছিল, সেই সরকারই এখন ক্ষমতায় আছে। শিক্ষানীতিটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্যও ছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন সেই অর্থে হয়নি। তাই আমার মনে হয়, শিক্ষানীতি চূড়ান্ত করার আগে সেটি যেন বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়ন সম্ভব এমন আর যুগের উপযোগী হয়; সেটি মাথায় রাখতে হবে। আমাদের এখানে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যা শিখছে, তা পরে কাজে লাগছে না। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে এই প্রশ্নটি আসা স্বাভাবিক, এ শিক্ষার দরকার কি?

আমরা জানি, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ-কে কো-চেয়ারম্যান করে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। চার মাসের মধ্যে সেই কমিটি তখনকার শিক্ষামন্ত্রীর কাছে শিক্ষানীতির খসড়া পেশ করে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা তাদের ওয়েবসাইটে দিয়ে জনমত সংগ্রহণ করে। এইসব কাজ সম্পাদনের পর সংশোধন ও পরিমার্জন করে মন্ত্রীসভায় শিক্ষানীতিটি অনুমোদন করা হয়। এই শিক্ষানীতিতে ত্রিশটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং শিক্ষাস্তর নির্বিশেষে সতেরোটি প্রস্তাবের উল্লেখ রয়েছে। একাত্তর পৃষ্ঠার এ শিক্ষানীতিতে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল এবং কুদরাত-এ খুদা কমিশন রিপোর্ট থেকে শুরু করে বাংলাদেশে সকল শিক্ষানীতি এবং শিক্ষা সংস্কার প্রস্তাবের ধারাবাহিকতার প্রতিফলন ঘটেছে।

শিক্ষানীতির ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, প্রাক্-ব্রিটিশ সময় পর্যন্ত শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি, সম্প্রদায়, প্রতিষ্ঠান ও সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও ১৮৩৫ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ঘোষিত শিক্ষানীতি হলো বাংলা তথা ভারতের প্রথম সরকারি শিক্ষানীতি। এর মাধ্যমে নীতিগতভাবে ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার অগ্রযাত্রা শুরু হয়। এরপর বহুল আলোচিত অ্যাডাম রিপোর্ট-এর ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান সৃষ্টি পর্যন্ত অন্তত আটটি কমিশন, কমিটি ও সংস্কার প্রতিবেদন প্রণীত হয়েছে। এর মধ্যে হান্টার কমিশন রিপোর্ট (১৮৮২) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত নাথান কমিটি (১৯১১) রিপোর্ট খুবই পরিচিত। পাকিস্তান আমলে বেশ কয়েকটি শিক্ষা কমিশন ও কমিটি রিপোর্ট প্রণীত হয়েছিল। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সংস্কার (আতাউর রহমান খান) কমিশন-১৯৫৭, জাতীয় শিক্ষা কমিশন (এস এম শরিফ কমিশন) রিপোর্ট-১৯৫৯, হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট-১৯৬৬ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ‘শিক্ষা নীতি’ নামেও দু’টো প্রতিবেদন প্রণীত হয়েছিল- এয়ার মার্শাল এম. নূর খান নেতৃত্বে পাকিস্তানের নতুন শিক্ষানীতি-১৯৬৯ ও শামসুল হক কমিটি প্রণীত শিক্ষানীতি-১৯৭০। ঘোষিত সব কয়টি নীতি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল আস্তাকুড়ে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ১৯৭৪ সালে হয় ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন। এরপর একে একে কাজী জাফর-আবদুল বাতেন প্রণীত অন্তবর্তীকালীন শিক্ষানীতি-১৯৭৯, মজিদখান কমিশন রিপোর্ট-১৯৮৩, মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট-১৯৮৭, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০০ ও জাতীয় শিক্ষা কমিশন (মনিরুজ্জামান মিয়া) প্রতিবেদন-২০০৩ শিক্ষানীতিগুলো প্রণীত হয়। সর্বশেষ শিক্ষানীতিটি হয় ২০১০ সালে। দশ বছর আগে করা শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার কথা বলা হয়, মাদ্রাসাশিক্ষাকে আধুনিকায়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এগুলো মৌলিক ও প্রয়োজনীয় বলে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট গবেষকরা মনে করেন। তবে সবচেয়ে জরুরি কথা হলো, প্রণীত শিক্ষানীতি যত ভালোই হোক না কেন, ঠিকমতো বাস্তবায়িত না হলে দেশবাসী তার সুফল পাবে না। আমাদের দেশে অনেক ভালো নীতি আছে, কিন্তু এর বাস্তবায়ন নেই। বিশেষ করে শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি ঠেকাতে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একাগ্রচিত্তে কাজ করতে হবে। কেবল শিক্ষার হার বাড়লেই হবে না, দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি গড়তে শিক্ষার মানও বাড়াতে হবে।

জাতীয় শিক্ষানীতির কয়েকটি মৌলিক বেশিষ্ট্য থাকে। যেমন শিক্ষানীতির একটি দর্শন থাকবে, এতে জাতির আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটবে। তাছাড়া জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা প্রণীত ও গৃহীত হবে। জাতির পূর্ব অভিজ্ঞতাসমূহ এখানে ব্যবহৃত হবে, উপেক্ষিত হবে না। শিক্ষানীতি সংশোধন ও চূড়ান্ত করার আগে এ বিষয়গুলোর দিকে সর্বোচ্চ নজর দিতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যদি পরে বাস্তবায়ন করাই হয়, তবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী হিসেবে অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা রাখা যায়। সেজন্য পঞ্চম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষাটি বাতিল করে দেওয়া উচিত। আর আমাদের শিক্ষাকে পেশামূলক শিক্ষায় রূপান্তর করা দরকার সবার আগে। পেশামূলক বিষয়গুলোর সঙ্গে বাংলা ভাষা, জাতীয় ইতিহাস ও নীতিশিক্ষাকে আবশ্যিক বিষয় রুপে স্থান দিতে হবে। পেশামূলক শিক্ষার এই দুই ধারার বাইরে মূলধারার বাংলা মাধ্যমে নবম ও দশম শ্রণিতে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক শাখাকে একীভূত করে এক ধারায় পরিণত করতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শাখা থাকবে। সব পর্যায়ে আগামীর বিশ্বের চাহিদা ও কাজের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পাঠ্যসূচি তৈরি করতে হবে।

আমাদের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠিত করতে হবে যাতে বিভিন্ন ধারার পেশামূলক শিক্ষার মাধ্যমে যোগ্য, দক্ষ, উৎপাদনক্ষম, উন্নত-চরিত্র ও মানসিকতার কর্মী সৃষ্টি হয়। শিক্ষাব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যেন দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রকৃত জ্ঞানী ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের আত্নপ্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়। আর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে আমাদের কর্মক্ষেত্র এত পরিবর্তন হবে যে বর্তমানে অর্জিত জ্ঞান হয়তো ভবিষ্যতে আর তেমন প্রয়োজন হবে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে তাই এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে যাতে করে কোনো কর্মজীবী যে কোনো সময় যে কোনো পরিবর্তনের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে রিস্কিল এবং আপস্কিল করতে পারে। আর একদিন দক্ষ সেইসব কর্মীদের মাধ্যমেই গড়ে উঠবে আগামীর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।

প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক মানবকণ্ঠ, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০

শিক্ষানীতি সংশোধনের আগে যা ভাবা উচিত
Scroll to top