হাসান হামিদ
চোখ বন্ধ করে আপনি যদি ভাবেন, কোন পেশার মানুষগুলো একটি দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? হেনরিএডামস-এর কথাটি আপনার মনে আসবে। তিনি বলেছেন, একজন শিক্ষক সামগ্রিকভাবে প্রভাব ফেলেন, কেউ বলতে পারে না তার প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হয়। বাট্রাণ্ড রাসেল আরো এক পা এগিয়ে এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, মানুষের সুখী হওয়ার জন্যে সবচেয়ে বেশি দরকার বুদ্ধির এবং শিক্ষার মাধ্যমে এর বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব। আর সেই কাজটি করেন একজন শিক্ষক। অথচ আমাদের দেশে, সমাজে শিক্ষকদের যে সম্মান আর মর্যাদার কথা বলা হয়, তা পুঁথিগত বিদ্যার মতোই মলাটবদ্ধ। বাস্তবের আলোর বাইরে। শিক্ষকদের তাই প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হতে হয়, লাঞ্ছিত হতে হয়, জেল কাটতে হয়, স্থানীয় নেতাদের সামনে কান ধরে উঠবস করতে হয়। আর এইসব অপরাধের বিচার না হওয়াতে এক পক্ষ ধরেই নিয়েছে, শিক্ষক আর্থিকভাবে শুধু দুর্বল তা নয়, সব দিক দিয়েই অবলা। শেষতক শিক্ষক লাঞ্ছনা এ দেশে হত্যায় এসে ঠেকেছে। আমরা কি বিচার চাইব?
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম জিতুর ক্রিকেট স্টাম্পের আঘাতে মারা গেছেন শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার। নিহত উৎপল আশুলিয়ার চিত্রশাইলে হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। কেন এই ঘটনা ঘটেছে? জানা গেছে, কয়েক দিন আগে এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করে হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু। আর এ কারণে জিতুকে সাবধান করে দিয়েছিলেন নিহত শিক্ষক। গত শনিবার হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে ছাত্রীদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছিল। এ সময় মাঠে খেলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন উৎপল। দুপুর আড়াইটার দিকে স্কুলের বখাটে ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু সবার সামনে ক্রিকেট স্টাম্প হাতে নিয়ে উৎপলের মাথা ও পেটে বেধড়ক আঘাত করতে থাকে। বিষয়টি বোঝার আগেই রক্তাক্ত হন শিক্ষক উৎপল। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। পেটে অস্ত্রোপচার করা হয়। ষোল ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয় শিক্ষক উৎপলের শরীরে। কিন্তু পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় উৎপল মারা যান। খুনী বখাটে ওই ছাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মালিকের ভাগ্নে উজ্জ্বল হাজির ছেলে। হামলার পরপর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাকে আটক করলেও প্রভাব খাটিয়ে ছাড়িয়ে নেয় তার পরিবার। এরপর সে পালিয়ে যায়। এই হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে শিক্ষকদের নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
কী ঘটেনি এ দেশের শিক্ষকদের ভাগ্যে? খুন হওয়া, বাড়ি-ঘর ভাংচুর, হামলা-মামলা, বিচারের নামে অপমান ও অপদস্ত, ছুরিকাঘাত, এসিডদগ্ধ, শারীরিকভাবে প্রহারের মাধ্যমে ক্ষতবিক্ষত করা, কানেধরে ওঠবস করানো, জুতার মালা এমনকি শিক্ষকের শরীরে মানুষের মল ঢালা! নড়াইলের কলেজ অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের কথা একবার ভাবুন। একজন শিক্ষককে জুতার মালা পরানো হলো! ওই শিক্ষক যখন নিজের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ডাকলেন; তখন সেই পুলিশের সামনেই এটি হয়েছিল। এই যে ভয়ানক একটা ঘটনা ঘটানো হলো, আমাদের প্রত্যকের উচিত যে যার জায়গা থেকে ছাত্র-শিক্ষক- সাংবাদিক সকলের এগিয়ে আসা। জুতার মালা শুধু সেই শিক্ষকের গলায় পরানো হয়েছে তা নয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রীসহ আমি-আপনি যে শিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেছি, মন্ত্রী-আমলারা যে শিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেছেন, পুলিশের আইজিপি যে শিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেছেন, সেই শিক্ষকের গলায় জুতার মালা সেদিন উঠেছে। এবার শিক্ষককে সবার সামনে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। এই আমাদের আজকের বাংলাদেশ? এদেশে কিন্তু সিরিজের মতো একটার পর একটা শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটছে। কয়েক বছর আগে পাবনায় একজন ছাত্র তথাকথিত অভিযোগে শিক্ষককে দুই হাতে ইট দিয়ে মাঠের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। এরপর আমরা ক্রমাগত শ্যামল কান্তির ঘটনা দেখেছি, আমরা সবাই ফেসবুকে কান ধরে ‘দুঃখিত স্যার, দুঃখিত স্যার’ বলেছি। কিন্তু যে সংসদ সদস্য শিক্ষার্থীদের সামনে তাকে চড় মেরেছিলেন, তাকে কি জবাবদিহিতায় আনা হয়েছিল? হয়নি। এরপর আমরা দেখেছি শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে। তাকে মারধর করা হয়েছে, জেলে নেওয়া হয়েছে। সেই ঘটনার মধ্যেই দেখলাম আশালতা নামের আরেকজন শিক্ষিকাকে নির্যাতনের শিকার হতে।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে শিক্ষক নির্যাতনের যে ঘৃন্য চিত্র উঠে এসেছে এবং বর্বরতার সকল সীমানা যেভাবে অতিক্রম করা হয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে এ পেশার মর্যাদা নিতান্তই মুখেমুখে এবং এ নিয়ে নতুন করে ভাবার সময়ও হয়েছে। এ দেশে শিক্ষকরা নির্যাতিত হন দুই ভাবে- আর্থসামাজিক নির্যাতন এবং মনো-দৈহিক নির্যাতন। আর্থসামাজিক নির্যাতন হলো আর্থিক সুযোগ-সুবিধা কম দিয়ে সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা। বেসরকারি শিক্ষকদের সময়মতো তার পাওনা পরিশোধ না করাও আর্থসামাজিক নির্যাতনের মধ্যে পড়ে। আর মনো-দৈহিক নির্যাতন বলতে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। এই যে ক্রমাগত শিক্ষকরা নির্যাতিত হচ্ছেন তার কী কী কারণ থাকতে পারে? অন্যতম প্রধান কারণ এসব ঘটনার বিচারহীনতা তথা রাষ্ট্রের উদাসীনতা। পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রতি এ দেশের আমলাদের বিমাতা সুলভ আচরণ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের উদাসীনতা, নগ্ন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, শিক্ষকদের পেশাগত দায়িত্বশীলতা, আদর্শ ও নৈতিকতাসহ সহকর্মীদের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ঘাটতি।
আজকের যুগে বাংলাদেশে শিক্ষক নিয়মিত নির্যাতনের শিকার হন। অথচ কত কত আগে আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করে ছিলেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব-শিষ্টাচার শেখো। এবং তাঁকে সম্মান করো, যার থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো।’ [আল-মু’জামুল আউসাত : ৬১৮৪] খেলাফতের যুগে ইসলাম প্রত্যেকের জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিল। তৎকালীন সময়ে শিক্ষাকে সহজলভ্য করতে এ খাতে সম্মানজনক পারিশ্রমিকও নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও দ্বীনি শিক্ষার শিক্ষকরা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জ্ঞান বিতরণ করে থাকেন। তবুও তাঁরা যেহেতু নিজেদের জীবিকার পেছনে জীবনের ঘোড়া না লেলিয়ে জ্ঞান বিতরণের পবিত্র কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন, তবে তাঁদের এ কাজকে সম্মান জানিয়ে তাঁদের ও তাঁদের পরিবার-পরিজনের দায়িত্বভার নেওয়া নিজেদের ওপর ফরজ করে নিয়েছিল তৎকালীন খেলাফত (সরকার), যাতে শিক্ষকদের জীবনের তাকিদে কোনো ভিন্ন পথে পা বাড়াতে না হয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষক মাত্রই বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। তাই শিক্ষকদের প্রতি আমাদের সবার সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো উচিত। কারণ শিক্ষকেরা মানুষ তৈরির কারিগর। শিক্ষকেরা জাতির প্রধান চালিকাশক্তি। এককথায় বলা যায়, শিক্ষক মানুষ চাষ করেন। যে চাষাবাদের মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে নীতি-নৈতিকতা ও জীবনাদর্শের বলয় একজন শিক্ষার্থী তার ব্যক্তিগত ও কর্মময় জীবনকে মুখরিত করে। পাশাপাশি পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র তার দ্বারা উপকৃত হয়। যুগে যুগে শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেই কাজ করে আসছেন। অতীতে শিক্ষানুরাগীদের শিক্ষকের বাড়ি গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে হতো। এতে শিক্ষাগুরুরা তাদের জ্ঞান, সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, দর্শন, মন-প্রাণ-অন্তর, এমনকি ভরণ-পোষণসহ শিক্ষানুরাগীদের শিক্ষা দিয়ে এমনভাবে গড়ে তুলতেন যেন এরা বড় হয়ে উন্নততর ও উচ্চতর জীবনবোধ এবং বিবেকবোধ নিয়ে সমাজ ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়। সামাজিক দায়িত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও জাতীয়ভাবে শিক্ষকদের তেমন সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় না। দেশে অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র মনোযোগী হলেও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে বেশ অবহেলা আর উদাসীনতার পরিচয় দেয়। যুগের পর যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু শিক্ষকদের নির্মম ভাগ্য আজও বদলায়নি।
শিক্ষকরা সমাজ বিনির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রাখার পরও শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের নজরে দেখা হয়। শিক্ষকের জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট অর্থের প্রয়োজন হয়। অথচ এই মহান পেশায় যারা নিয়োজিত, তাঁদের নেই কোনো অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা। সামাজিক মর্যাদা ও সম্মানজনক জীবনধারণ উপযোগী বেতন-ভাতা না থাকায় মেধাবীরা শিক্ষকতায় আকৃষ্ট হচ্ছেন না। শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব, এ দুর্মূল্যের বাজারে বেতন-ভাতার অপ্রতুলতা, শিক্ষাকে রাজনীতিকরণ এবং বাণিজ্যিকীকরণের উদ্ভট মানসিকতা, শিক্ষকদের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সীমাহীন ঔদাসীন্য ও অবহেলাই যেন এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বহুলাংশে দায়ী। বলতে লজ্জা হয়, দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত ও শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে দেখা যায়। এটা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও অমানবিক কাজ। সম্প্রতি যে হত্যাকাণ্ড হলো এটিসহ অতীতের সবগুলো ঘটনার বিচার চাই আমরা।