হাসান হামিদ
আসলে দার্শনিকদের কাজ-কারবারই ছিল অন্য রকম । উল্টোভাবে বলা যায়, এ রকম কাজ-কারবার করতেন বলেই তারা দার্শনিক ছিলেন । বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো একবার মানুষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘মানুষ হচ্ছে পালকবিহীন দ্বিপদ একটি প্রাণী’। এই সংজ্ঞা শুনতে পেয়ে আরেক দার্শনিক ডায়োজেনিস একটি মুরগি জবাই করে সবগুলো পালক ফেলে দিয়ে প্লেটোকে পাঠিয়ে দিলেন । সঙ্গে একটি কাগজে লিখলেন, ‘এটাই তোমার সংজ্ঞায়িত মানুষ’।
মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার এটাই একটা দারুণ ব্যাপার যে, আমাদের আবার মানুষ হতে হয় । অন্য প্রজাতির কাউকেই কিন্তু সেটি হতে হয় না । প্রজাপতি হলেই প্রজাপতি, পাখি হলেই পাখি; কিন্তু মানুষ হলেই মানুষ নয়, সেটা হতে হয় । হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হয় । আর মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিদ্যার্জন । অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই গরিব দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সেটি সবার জন্য সমান সম্ভবের হয় না। তবে বিদ্যা অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার বাছাই চরিত্র হলেন বিদ্যা যিনি দেন আর যিনি সেটি গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ কী বলেছেন একটু দেখি, ‘বিদ্যা যে দেবে এবং বিদ্যা যে নেবে তাদের উভয়ের মাঝখানে যে সেতু সেই সেতুটি হচ্ছে ভক্তিস্নেহের সম্বন্ধ। সেই আত্মীয়তার সম্বন্ধ না থেকে যদি কেবল শুষ্ক কর্তব্য বা ব্যবসায়ের সম্বন্ধই থাকে তা হলে যারা পায় তারা হতভাগ্য, যারা দেয় তারাও হতভাগ্য’ (বিশ্বভারতী)।
আমাদের দেশের সম্মানিত শিক্ষকদের উন্নয়নের জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ সে সম্পর্কে শিক্ষা আইনে কতটা কি বলা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। শিক্ষক প্রশিক্ষণকে আমাদের দেশে পেশাগত উন্নয়নের জন্য অতটা গুরুত্বপূর্ন মনে করা হচেছ না বোধ হয়। যদিও বিষয়টি ফলপ্রসূ শিক্ষাদান ও সৃজনশীল নাগরিক হিসেবে শিক্ষার্থীদের তৈরি করার জন্য এটি একটি অন্যতম প্রয়োজনীয় বিষয়। এটা ঠিক যে অনেকে প্রশিক্ষণ পেলেও আমাদের দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের বড় একটি অংশ কিন্তু সেটির বাইরে থেকে যান দীর্ঘ সময়। শিক্ষার পর প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ ছাড়া ভালোভাবে অনেক কিছুই হয় না। আমার জন্ম সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে। একসময় সেখানে বিদ্যুতের আলো জ্বলতো না। রাত নামলে কেরোসিন দিয়ে হারিকেন বা কুপি বাতি জ্বালানো
হতো। আমি ছোট বেলায় দেখেছি, সন্ধ্যা বেলায় যে হারিকেনটি জ্বালানো হবে সেটি আমার মা দুপুর বেলায় ঠিক করে রাখতেন। দেখতেন তেল ঠিক আছে কিনা, সলতে ঠিক আছে কিনা, চিমনি ঠিকঠাক আছে কিনা । আর এই প্রস্তুতির কারণেই সন্ধ্যে হওয়ার সাথে সাথে ঠিক সময়ে তিনি সেটি জ্বালাতে পারতেন। প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণবিহীন একজন শিক্ষক কতটা ফলপ্রসূ ও আধুনিক শিক্ষাদান করবেন সে সম্পর্কে বোধ করি এ যুগের কোন সচেতন ব্যক্তি কোন প্রশ্ন তুলবেন না। আর প্রস্তুতি না থাকলে ঠিক সময়ে আলো জ্বলবে না এটাই স্বাভাবিক।
এদেশে একটা সময় ছিল, যখন শিক্ষকগন ছিলেন অনেক বেশি নিবেদিতপ্রাণ। তারা নিজ নিজ এলাকায় শিক্ষার মহানব্রত নিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানো শুরু করতেন নিজ বাসায় কিংবা প্রতিষ্ঠানে। সেখানে শিক্ষকতা করে করে তাদের এক ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জিত হতো, সেটি কাজে লাগিয়ে তাঁরা দীর্ঘদিন শিক্ষকতায় লেগে থাকতেন এবং তাদেরকে অনুসরন করে পরবর্তী সময়ে কেউ কেউ শিক্ষক হতেন। তাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল নিজেদের ডেডিকেশন। এখন সেটি সবক্ষেত্রে নেই। কোচিং আর প্রাইভেটের সংস্কৃতি আমাদের দেশের মতো এতো বিস্তৃতি আর কোথায় আছে আমার জানা নেই।
সত্যি কথা বলতে এখন যুগ পাল্টেছে। শিক্ষা নিয়ে দেশে বিদেশে বহু গবেষণা হচেছ, গবেষণার ফল শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচেছ। এগুলো শিক্ষক পরিবারের সাথে শেয়ার করা হয় প্রশিক্ষণে এবং শেণিকক্ষে সেটি প্রাকটিসের মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষাদান নিশ্চিত করা যায়। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরিচিত হওয়া যায় কোন ধরনের শিক্ষার্থীদের সাথে কিরুপ আচরণ করতে হবে, কোন ধরনের পরিবেশে কিভাবে শিক্ষাদান করতে হবে। প্রশিক্ষণ ছাড়া যেমন কোন গাড়ী চালানো যায়না, কোন অস্ত্র বা যন্ত্রপাতি চালানো যায়না তেমনি এই কঠিন কাজটিও ভালভাবে করা যায় না। কিভাবে ভাষা শিক্ষার একটি ক্লাস ফলপ্রসু হবে, কিভাবে আনন্দদায়ক হবে একটি শ্রেণিকক্ষ, কিভাবে স্বল্পব্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষার উপকরণ ব্যবহার করা যায়, কিভাবে শিক্ষার্থীদের গণিত ভীতি, পরীক্ষাভীতি দূর করা যায় ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রশ্ক্ষিণের মাধ্যমে শিক্ষকগণ জানতে পারেন। কিন্তু শিক্ষক প্রশিক্ষণ শিক্ষকদের প্রকৃত পেশাগত উন্নয়নের জন্য একটি অতীব গুরুত্বপূর্ন বিষয় হিসেবে ধরা হয় না। সরকারের কোন প্রজেক্ট থেকে কিংবা বেসরকারি কোন সংস্থা যদি শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন করে শিক্ষকগণ সেখানে আসেন। প্রশিক্ষণ থেকে তারা কিছু অর্থনৈতিক সুবিধা পান। এইটিই ছিল নিয়ম। শিক্ষকগণ কিছু পাবেন এটা অবশ্যই আমরা আশা করি। কিন্তু বিষয়টি যদি একটু গভীরে গিয়ে দেখি তাহলে দেখা যাবে, প্রকৃত পেশাগত উন্নয়নের জন্য এইসব প্রশিক্ষণে আসা শিক্ষকদের সংখ্যা হাতোগোনা দুএকজন হবে ।
আশার কথা হলো, আমাদের শিক্ষকগণ এখন দেশের পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পূর্বের তুলনায় অনেকটা ভাল অবস্থায় আছেন। কাজেই তাদের পক্ষে, নিজ দায়িত্বে ও প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ নেয়া সম্ভবপর। আমার প্রস্তাব হচেছ শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিষয়টি শিক্ষা আইনে সুন্দরভাবে যুক্ত করা প্রয়োজন এবং সেই প্রশিক্ষণ মানে শুধু অর্থনৈতিক সুবিধা প্রাপ্তির প্রশিক্ষণ নয়, প্রকৃতঅর্থে প্রশিক্ষণ হতে হবে। আর আমাদের পাঠ্যপুস্তক কতটা মানসম্মত, কতটা চাহিদা মেটাতে পারে শ্রেণিভিত্তিক এবং বয়সভিত্তিক কম্পিটেনসি অর্জনে সে বিষয় আমাদের ভাবতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যে হেয়ালি এখানে হচ্ছে গেল কয়েক বছর ধরে, তা মানা কঠিন। আর প্রশ্ন ফাঁস তো সংস্কৃতি হয়ে গেছে এখন। আর এভাবে সোনার দেশ গড়া যাবে না। সোনার দেশ গড়তে হলে আগে সোনার ছেলে তৈরি করতে হবে। আর মেধাবী সেই শ্রেণি তৈরির কারিগরদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত সম্মান ও সম্মানির নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকেই দিতে হবে। তারপর ভাবতে হবে পরীক্ষা আমরা কিভাবে গ্রহন করবো? বর্তমানকালে যে ভাবে সৃজনশীল পদ্ধতি চলছে এটিই থাকবে না কি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সৃজনশীলতা বিকাশে আমরা নতুন কিছু ভাববো এবং করবো। বর্তমানে যেটি হচেছ সেটিকে আমরা প্রকৃত অর্থে কতটা সৃজনশীল বলতে পারি? এটিতো এক ধরনের কাঠামো অনুসরণ করা মাত্র। একই ধরণের কাঠামো অনুসরন করা সৃজনশীলতার কথা বলে না। সৃজনশীলতা ব্যাপারটি এভাবে গাইডলাইন দিয়ে আর সীমানা দিয়ে যাচাই করা যায় না। সবশেষে রবীন্দ্রনাথের উক্তি, ‘মুখস্থ করিয়া পাস করাই তো চৌর্যবৃত্তি! যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায়, সেই-বা কম কী করিল?’
(শিক্ষার বাহন)
প্রকাশিত পত্রিকা-
দৈনিক যুগান্তর ২৬/০৭/২০১৭, দৈনিক শিক্ষা ২৬/০৮/২০১৮