হাসান হামিদ
রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়ে শুরু করি, ‘‘বিদ্যা যে দেবে এবং বিদ্যা যে নেবে, তাদের উভয়ের মাঝখানে যে সেতু সেই সেতুটি হচ্ছে ভক্তিস্নেহের সম্বন্ধ। সেই আত্মীয়তার সম্বন্ধ না থেকে যদি কেবল শুষ্ক কর্তব্য বা ব্যবসায়ের সম্বন্ধই থাকে, তা হলে যারা পায় তারা হতভাগ্য, যারা দেয় তারাও হতভাগ্য’’(বিশ্বভারতী)। প্রকৃত শিক্ষালাভের জন্য বা সঠিক চর্চার জন্য শুধু বিদ্যালয় নামের দুর্গটির ইট সিরামিকের করলে হবে না; শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য যিনি শিক্ষা দান করবেন, তাঁর যাপিত জীবন স্বস্তির হতে হবে। আজকাল শিক্ষক লাঞ্চনার সংবাদ প্রায়ই খবরের কাগজে দেখি। লজ্জায় আমার মুখ কাঁচুমাচু হয়, প্রচণ্ড মানসিক চাপে হাত পা কাঁপে আর কিছু বলতে না পারার অক্ষম বেদনায় অভিমানে আমার কণ্ঠ বুজে আসে। এ কোন প্রজন্ম জন্ম দিতে চলেছি আমরা? বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই আজকাল শিক্ষকদের হয়রানি তো হচ্ছেই, কান ধরে উঠবস করানোর ঘটনা পর্যন্ত ঘটে গেছে। মন আরও খারাপ হয়, যখন সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাক সব না বোঝেই কিছু পদক্ষেপ নেয়। মূল লেখাটি শুরুর আগে অন্যদিকে একটু চোখ ফেরাবো।
আমি অনেকবার সরকারি হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার পাইনি। আর আমার পরিচিত ডজন ডজন ডাক্তার আছেন, যারা সরকারি বেতন, ভাতা আর সব সুবিধা নিয়েও তাদের প্রতিদিনের প্রায় সিংহভাগ সময় হাসপাতালের বাইরে কাটান। আর আমলাদের নিয়ে বলা মুশকিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ স্যার তাঁর এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, একজন সচিবের সমান বেতন হলেও স্যারের আর্থিক অবস্থা আর সচিবের আর্থিক অবস্থার ফারাকের কথা। সে ব্যাখ্যায় তিনি তখন বলেন, আমলারা টাকা কামায় দুর্নীতি করে; তবে তাদের আসলে কিছু নেই। সচিব কয়েক বছর থাকার পর চাকরি থেকে অবসর; আর থাকে না তার কিছুই। এই নেই নেই দুঃখ ঘুচাতে এরা বাড়ি-গাড়ি করে রাখে। সে যাই হোক, কর্মক্ষেত্রে উপস্থিতি আর কাজের প্রতি মমতা যদি বেশি দেওয়ার তর্কে আপনি যান, আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে, এক্ষেত্রে শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি নম্বর পাবেন। আমি সোজা কথায় বলি, শিক্ষকরা মাইকিং করে ব্যবসায় নামেন না; সেটা গুটি কয়েকজন করলে করতেও পারে। কিন্তু ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হতে পারে না। তবে সব ডাক্তারই মাইকিং করে প্রচারের মাধ্যমে প্রাইভেট প্রেক্টিস করেন। আর তাতে সমস্যা নেই, অথচ কোনো শিক্ষক চারজনকে বিকেলে পড়ালে আপনি তাঁকে কোচিংবাজ বলছেন। আমার বলতে লজ্জা করছে, বাজ শব্দটি শিক্ষকদের সাথে কে লাগানোর দৃষ্টটা দেখিয়েছে এদেশে? বাজ একটি ফারসি প্রত্যয়, যা দক্ষতা অর্থে যুক্ত হলেও সাধারণত ঋণাত্মক ভাব ব্যক্ত করে। যেমন- চালবাজ, গুটিবাজ এসব। আমি বলি, ব্যবসা যারা করছে সাইনবোর্ড লাগিয়ে, তাদের কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দিন। ঝামেলা মিটে যাক। আর টিউশন? সব দেশেই আছে এটা। বেশি বোঝার জন্য, বাড়তি পড়ার জন্য এটা শিক্ষাগ্রহণের অংশ যদি মনে করা হয়, তবে এর পারিশ্রমিক সম্মানিত শিক্ষকরা নিবেন না কোন যুক্তিতে? এদেশে হাজার কোটি টাকা মেরে, ব্যাংক লুটে পার পেয়ে যায় বড়জনেরা (!) কিন্তু গরীব শিক্ষকদের নাম তালিকা করে, অপরাধী বানিয়ে তাদের অস্বস্তিতে ফেলা হয়। কিন্তু তাতে শিক্ষাদানে ব্যাঘাত যা হচ্ছে, সেই মূল্য কে দেবে? অতীতে তো শুধু গুরুর গৃহে শিক্ষাদান ছিল, তখন মেধাবী তৈরি হয়নি? অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ স্যার ১৯৯৫ সালে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, শিক্ষকদের বেতন ৫০ হাজার করা উচিত, কারণ তবেই তারা গবেষণা করবেন, আর অন্য দিকে চিন্তাও করা লাগবে না। কিন্তু ২২ বছর পরও তা হয়নি!
কিছু বিষয় পরিবর্তন করা দরকার। চালু করা দরকার নতুনভাবে, যেমন- প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বছরে দুইটি টার্ম পরীক্ষা হবে। প্রতিটি টার্ম পরীক্ষার খাতা ইন্টার স্কুল এবং ইন্টার কলেজ শিক্ষকগণ পরীক্ষা করবেন। নিজস্ব স্কুল কিংবা কলেজের শিক্ষক কোনো খাতা মূল্যায়ন করবেন না। খাতা মূল্যায়ন করার জন্য শিক্ষকদের সম্মানী থাকবে। তাহলে তারা খাতাও ভালোভাবে দেখবেন এবং ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে। কারণ খাতা ভালোভাবে মূল্যায়ণ করে ছাত্রছাত্রীদের দেখানো উচিত যাতে তারা তাদের ভুলত্রুটি ধরতে পারে এবং শোধরাতে পারে- যে কাজটি এখন অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই হয় না। আর একই স্কুলের বা কলেজের শিক্ষক প্রশ্নপত্রও প্রণয়ন করবেন না, অন্য স্কুল কলেজের শিক্ষক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করবেন। কোন স্কুলের এবং কলেজের প্রশ্নপত্র কোন স্কুল কিংবা কলেজ করবেন, তা উক্ত স্কুল ও কলেজের প্রধানগণ সিদ্ধান্ত নিবেন। ব্যাপারটি সমন্বয় করবেন শিক্ষা বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ কিংবা স্কুল ও কলেজ প্রধানগণ নিজেরাই। উপর্যুক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করার মাধ্যমে আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে কিছুটা গুণগত পরিবর্তন আনতে পারি। শিক্ষাদানের পাশাপাশি আদমশুমারি, ভোটার তালিকাভুক্তি, টিকাদান, শিশু জরিপ, উপবৃত্তি বিতরণ, স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রমে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আমাদের দেশের শিক্ষকদেররও সংসার আছে, ভাই-বোনকে মাস শেষে টাকা পাঠানো আছে, বাবার চিকিৎসার জন্য টাকা বা অর্থের প্রয়োজন আছে। তাছাড়া যুগ পাল্টেছে। এখন আর সেই সময় নেই যে শিক্ষকগণ বিনা পয়সায় ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞান দান করবেন। আবার এটিও ঠিক শিক্ষকগণ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হবেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে জ্ঞানের চর্চা হচ্ছে তার সাথে পরিচিত হবেন। তবে প্রাইভেট পড়াতে গিয়ে কোনো কোনো শিক্ষক কিছুটা অসততার আশ্রয়ও নিচ্ছেন এটা ঠিক। যারা নিচ্ছেন তাদের সংখ্যা খুব কম; কিন্তু দোষটা পড়ছে পুরো শিক্ষক সমাজের উপর। আবার যারা করছেন না তারাও এই দোষে দুষ্ট হচ্ছেন। তার চেয়েও বড় কথা হলো, যে উদ্দেশ্যে পরীক্ষা নেয়া হয় পরীক্ষার সেই উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। এই অবস্থা আর চলতে দেয়া যায় না। এক স্কুল কিংবা কলেজের প্রশ্নপত্র অন্য স্কুল কিংবা কলেজের শিক্ষকগণ করলে ছাত্রছাত্রীদের অরিজিনালিটি যাচাই করা যায় এবং ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করা হয় যে কারণে, সেটি আর তেমন গুরুত্ব পাবে না।
আমি আগেও বলেছি, বলতে লজ্জা হয়, দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত ও শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে দেখা যায়। এটা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও অমানবিক কাজ।শিক্ষক হলেন সেই সব ব্যক্তি যারা শিখন ও শিক্ষাদান কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। শিক্ষা-পরিবারে নিয়োজিত ব্যক্তিরা ছাত্রদের কর্মদক্ষতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে আত্মমর্যাদাবোধ, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধেরও শিক্ষা দিয়ে থাকেন। আর এভাবেই গড়ে ওঠে আমাদের বাংলাদেশ। তাই শিক্ষকরা যেনো অযথা হয়রানির শিকার না হোন তা নিশ্চিত করেই যেনো দুদক পা ফেলে। তার আগে কোন খাতে দুর্নীতি বেশি আর কারা বেশি করছে, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। আর শিক্ষা যিনি দেবেন তাঁকে অস্বস্তিতে রেখে প্রকৃত শিক্ষালাভ কি আদৌ হবে?
প্রকাশিত পত্রিকা-
শিক্ষাবার্তা ২২/০৭/২০১৭
দৈনিক শিক্ষা ২২/০৭/২০১৭