হাসান হামিদ
আজ রাতে খাবার টেবিলে আমার স্ত্রীকে বললাম, রক্তের সম্পর্কের কেউ কি কখনো ভীষণ ভয়ের হয়? তিনি কপাল কুচকালেন। কিন্তু এটাই তো সত্যি যে, মশার সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক। মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মীয়তা দুই রকমের হয়— রক্তসম্পর্কের ও বৈবাহিক সূত্রের। মশা মানুষের রক্তসম্পর্কের আত্মীয় নয়; শত্রু। কিছুক্ষণ আগে খবরে পড়লাম, আজ সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, মশার কামড়ের ভয়ে এখন থেকে তিনি সচিবালয়ে অফিস করবেন। একবার তিনি চিকুনগুনিয়া ও আরেকবার ডেঙ্গু জ্বরে ভুগেছেন। এরপর থেকে মশার ভয়ে আগারগাঁওয়ে তার কার্যালয়ে যেতে ভয় পাচ্ছেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ওখানে (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) বেশি মশা। এ পর্যন্ত দুইবার কামড় দিয়েছে। একবার চিকুনগুনিয়া ও আবার ডেঙ্গু। এটা কোনো কথা হলো! আমি ওই জন্য ভয়ে ওখানে যাচ্ছি না।’ বাজেট পেশের দুই দিন আগে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। ১৩ জুন তিনি বাজেট উপস্থাপন শুরু করলেও শেষ করতে পারেননি। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পক্ষে বাজেট উপস্থাপন করেন। (সূত্র- প্রথম আলো, ১৮ জুলাই, ২০১৯)
মশা নিয়ে লেখার শুরুতে একটি কৌতুক বলে নিই। এক মা-মশা বলছে তার সন্তানদের, তোমরা যদি সারা দিন ভালো আচরণ করো, তাহলে রাতে তোমাদের পিকনিকে নিয়ে যাব। বাচ্চা মশাগুলো জিজ্ঞেস করলো, পিকনিকে? কোথায় হবে সেটা? তাদের মা বললো, পাশের বাসায় একদল বেড়াতে এসেছে। সারা রাত কাটাবে ওখানে।
জেনে অবাক হতে হয়, পৃথিবীতে মোট ৩০০০ এরও বেশি প্রজাতির মশা আছে। একটি মশার ওজন হতে পারে ২.৫ মিলিগ্রাম অর্থাৎ ০.০০২৫ গ্রাম। মশার ৪৭ খানা দাঁত আছে। তবে এরা কিন্তু রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে না! মূলত রক্তের প্রোটিন অংশটি কাজে লাগিয়ে তারা ডিম পারে! মশার আসল খাদ্য হল গাছের রস।
ভাবতে খারাপ লাগে, আমাদের ঢাকায় মশা মারতে কামান না লাগলেও হাইকোর্টের তাগাদা লাগে। সিটি করপোরেশনের মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে সম্প্রতি একটি নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে প্রতিটি ওয়ার্ডে যথাযথভাবে ওষুধ স্প্রে করার পর দুই সপ্তাহের মধ্যে তা হাইকোর্টকে জানাতে বলা হয়েছে। তারপরও কি এই ওষুধে মশা মরেছে? আদেশ দেওয়ার পরও মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তীব্র সমালোচনা করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, গণমাধ্যমে রিপোর্ট এসেছে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে শিশুসহ ২১ থেকে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে একজন মেয়র বলেন, এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি। আমাদের প্রশ্ন উনি একথা কীভাবে বলেন? আমরা তো দেখতে পাচ্ছি এটা মহামারি আকারে রূপ নিতে বাকি নেই।
আমাদের একজন মেয়র বলেছেন, মশারা নাকি শক্তিশালী হয়ে গেছে! আমরা কতোটা অসহায় আর আমাদের মেয়র কতোটা দুর্বল তা কয়েকটি খবর পড়লেই বোঝা যায়। সম্প্রতি এডিস মশা নিধনে ব্যর্থ হওয়ায় ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবী। গত সপ্তাহে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে স্কয়ার হাসপাতালে ডা. নিগার নাহিদ দিপু নামে এক নারী চিকিৎসক মারা গেছেন। তবে এবার ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেশি। জ্বরের মাত্রা কম, দৃশ্যমান র্যাশ বা দাগ না হওয়া এমনকি শরীরে পর্যাপ্ত ব্যথা না হওয়ায় অনেকেই বুঝতে পারছেন না যে তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কি না। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া অনেক রোগীর লক্ষণের সঙ্গে পূর্বের লক্ষণের মিল না থাকায় চিকিৎসকদের মধ্যেও সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে। এবার সংক্রমণের হার যেমন বেশি মৃতের হারও বেশি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসলে এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে সেই ভয় পাচ্ছি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ১৭ দিনে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ৮১ জন, মৃত্যু ৫ জন। আর স্পষ্টই আমরা জানি, মশা নিধন কার্যক্রমে শক্তিশালী বা গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলেই রাজধানীজুড়ে এডিস মশার বিস্তার ঘটেছে। যার পরিণতিতে ডেঙ্গু জ্বর ভয়াবহভাবে ছড়াচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি না, মশা মারতে কী ওষুধ দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে, মশা মরছে না আরও তাজা হচ্ছে। আর মশা মারার ওষুধে যদি কাজ না হয় তার মানে অকার্যকর ওষুধ কেনা হয়েছে। ওখানে দুর্নীতি হয়েছে! দুর্নীতি হয়ে থাকলে কারা কারা এর জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। যে মানুষগুলো মারা যাচ্ছে, তাদের দায়ভার কে নেবে? খবরে পড়লাম, মেয়র মশার ওষুধ সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার কথা জানান। লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস নামের ওই কোম্পানিকে শাস্তি ও জরিমানা করা উচিত। ডিএনসিসি থেকে জানা যায়, গত ১১ বছর ধরে মশা নিধনে লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস ও নোকন লিমিটেড নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান থেকে থেকে একটি নির্দিষ্ট মিশ্রণের ওষুধ সংগ্রহ করা হয়ে আসছে। আর তাদের এসব কতোটা কাজে আসছে তা সবাই বুঝতে পারছেন!
আমাদের ঢাকায় এখন ডেঙ্গু আতঙ্ক। জেনেছি, এবারে ডেঙ্গুর চার ধরনের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক সেরোটাইপ-৩-এ আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। দ্রুত প্লাটিলেট কমে যাওয়া এবং কিডনি, ফুসফুস, লিভারসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সংক্রমণ হওয়ায় অনেক রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হচ্ছে। ডেঙ্গু জ্বরের যে চেনা লক্ষণ তার পরিবর্তন ঘটেছে। জ্বর কমে যাওয়ার পরও হুট করে প্লাটিলেট কমছে কারও কারও। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। এতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন গড়ে ৯০ জন ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে। জ্বর এলে মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সামান্য অবহেলা করে দুই একদিন বাসায় বসে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবন করে সময় ক্ষেপণ করলেই বিপদে পড়তে হচ্ছে। এই দু-একদিনের মধ্যেই শরীরের গুরুত্বপূর্ণ ফুসফুস, লিভার, মস্তিষ্ক ও কিডনি আক্রান্ত করছে ডেঙ্গুর এজেন্ট। রোগীর অবস্থা দ্রুত অবনতি হয়ে মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করছে।
আমাদের ঢাকা থেকে মশাকে বিদায় করার কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা সেটা নিয়ে ভাবা দরকার। পরিবেশের ওপর মশার ইতিবাচক কোনো প্রভাব এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। এ থেকে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সব মশা মেরে ফেলা হয় না কেন? বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এই উৎকর্ষের যুগে মানুষের হাতে কি কোনো অস্ত্র নেই, যা দিয়ে সব মশা মেরে ফেলা যায়? যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়েসের মশক নিধন কর্মসূচির কর্মকর্তা রজার এস নেস্কির মতে, বর্তমানে বিজ্ঞানের কোনো শাখায়ই পৃথিবী সব মশা মেরে ফেলার মতো কোনো অস্ত্র তৈরি হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো দেশ বা শহর কর্তৃপক্ষ যতই কীটনাশক ব্যবহার করুক না কেন, কিছু মশা রয়েই যায়। আর ওই মশা থেকে আবার বিপুল পরিমাণ মশা তৈরি হয়। গবেষকরা বলেন, আগেও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক স্থানে মশা পুরোপুরি দূর করার চেষ্টা চালানো হয়। তবে প্রতিবারই টিকে থাকার লড়াইয়ে মশা জয়ী।
মশা দূর করতে লাতিন আমেরিকায় ১৯৫০-৬০ দশকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। ব্যাপক হারে ডিডিটিসহ বিভিন্ন শক্তিশালী কীটনাশক ব্যবহার করা হয় পুরো মহাদেশে। কিছু সময়ের জন্য মশা দূর হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই ধীরে ধীরে মশা ফিরতে শুরু করে। ধারণা করা হয়, সেখানকার মশা দূর হলেও এশিয়া বা আফ্রিকার জাহাজ থেকে আবার মশা ফিরে আসে। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় ডিডিটি ও এর মতো শক্তিশালী কিছু কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে অনেক দেশে। এসব শক্তিশালী কীটনাশক ছাড়া মশার বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণই কঠিন, সেখানে মশা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার চিন্তাই করা যায় না। তবে মশা নিধনের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই আশাবাদী। নিত্যনতুন সব পদ্ধতি আসছে মশা নিধনের। ব্যাকটেরিয়া ছিটিয়ে দিয়ে মশার বাসস্থান নষ্ট করে দেওয়ার একটি পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে। অপর এক মশা নিধনের পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে, যেখানে প্রাণঘাতী রোগ ছড়িয়ে দেয় এমন সব মশা মারা যাবে।
মশা শুধু আমাদের দেশে বেশি তা কিন্তু নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের জনসংখ্যার ৫০ ভাগ সাধারণ ও মারাত্মক ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এখন বছরে মারাত্মক ডেঙ্গুজ্বরে কমপক্ষে ৫ লাখ মানুষ আক্রান্ত হন। প্রতি মিনিটেই বিশ্বের কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তাদের অধিকাংশই শিশু। আর বছরে ২২ হাজার ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। গত জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ৪৬ হাজার, মৃত্যু ৭৪ জন। একই সময়ে ফিলিপাইনে আক্রান্ত ৭২ হাজার, মৃত্যু ৩০৩ জন, সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত ৩ হাজার ২৩৩ জন, ভিয়েতনামে আক্রান্ত ৬০ হাজার, মৃত্যু ৪ জন। ভারতে আক্রান্ত ৬ হাজার ৮০৭, মৃত্যু ৭ জন, মিয়ানমারে আক্রান্ত ৪ হাজার, মৃত্যু ১৪ জন, থাইল্যান্ডে আক্রান্ত ২৬ হাজার, মৃত্যু ৪১ জন। ফিলিপাইনে ইতিমধ্যেই বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
মশা নিয়ে যখন বাংলাদেশের মানুষ ভয়ঙ্করভাবে উদ্বিগ্ন তখন মশক নিধনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে চীন। দেশটির দুটি দ্বীপ প্রায় সম্পূর্ণভাবে আক্রমণকারী মশা মুক্ত করা হয়েছে বলে দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ। চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ চীনের গুয়াংঝু শহরের পাশ্ববর্তী দুটি দ্বীপ থেকে এশিয়ান টাইগার জাতীয় স্ত্রী মশার বংশবৃদ্ধি ৯৪ থেকে ৯৭ ভাগ হ্রাস করা গেছে। এই মশা রোগ সংক্রামণ ও মৃত্যুর হার বাড়ানোর অন্যতম উৎস। ২০১৪ সালে চীনের গুয়াংঝু শহরে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এসময় প্রায় ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় এ জ্বরে। চীন এর জন্য পদক্ষেপ নিয়ে অনেকটাই মশামুক্ত হবার পথে। আমাদেরও সে সময় এসেছে। সরকার ও দায়িত্বশীলরা প্লিজ ভাবুন, আপনাদের অনেকের তো ছেলেমেয়ে আছে। আজ যারা মশার কামড়ে জ্বরে মরছে, সেই তালিকায় যদি আপনাদের সন্তানের নাম আসে? ব্যাপারটি খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করছি। বাসযোগ্য একটি দেশ, একটি শহর করা কি খুব অসম্ভব? নাকি আমাদের সদিচ্ছার অভাব? বুকে হাত দিয়ে নিজেদের প্রশ্ন করুন!
প্রকাশিত পত্রিকা- দেশবার্তা, ১৯ জুলাই, ২০১৯