হাসান হামিদ
‘বিনুর বই’ নামে অন্নদাশঙ্কর রায়ের চমৎকার একটা বই আছে। সেটার গল্পে বিনুর হাতে কেউ একজন একগুচ্ছ বই তুলে দেয়। তারপর সেই বই পড়তে পড়তে বিনু চলে যায় ভিন্ন এক জগতে। ভাবতে থাকে, সে একদিন পত্রিকা বের করেছে, প্রেমে পড়েছে এবং সে লেখক হয়ে গেছে। লেখক হবার পর বিনু অবশেষে বুঝতে পারে লেখকের অর্থনৈতিক ব্যর্থতা। তার সাথে বিনু এটাও বুঝতে পারে যে, একজন লেখক চিরন্তন ও চিরমধুর। অন্য সবারই ক্ষয় আছে, লেখকদের ক্ষয় নেই। আসলেই একজন লেখক পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারেন। যেমন ধরুন শেক্সপীয়ার। এই ভদ্রলোক মারা গেছেন চারশো বছর আগে। অথচ সারা পৃথিবীতে তিনি এখনও অনেকখানি আলোচিত ও চর্চিত!
তবু এদেশের কোনো তরুণ ভুল করেও এখন আর লেখক হতে চান না। এর মধ্যে যারা চান, ন্যাড়া হয়েও যারা বেলতলায় বসতি গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন, আমি তাদের প্রশংসাই করি। আমাদের দেশের মা-বাবারা ছেলেমেয়েদের হাতে সাধারণ জ্ঞানের বই দেখলে যতোটা খুশি হোন, ঠিক ততোটাই চিন্তিত হয়ে ওঠেন তাদের হাতে গল্পের বই দেখলে। গল্প উপন্যাসের বইকে আমাদের সমাজে আউটবই নাম ডাকা হয়! পাঠ্যবইয়ের বাইরে সব বই যেন অপাঠ্য অপ্রয়োজনীয়। আর এই ভুল ভাবনাগুলোর ভয়াবহ একটা প্রভাব আমরা এখন টের পেতে শুরু করেছি। লাইব্রেরিগুলোর বইয়ে এখন ধুলো জমে। কেউ হাত দিয়ে স্পর্শ করে না। তরুণ পাঠকদের চোখ চাকরির পরীক্ষা পাসের গাইড বইয়ের দিকে। গুগলে যেসব তথ্য এক সেকেন্ডে পাওয়া যায়, সেই তথ্য দিন রাত আমাদের ছেলেমেয়েরা মুখস্থ করে সময় পার করছে। এই মুখস্থ বিদ্যা সভ্যতার কোন কাজে লাগবে কে জানে! চাকরির পরীক্ষা কি আরও বিষয়ভিত্তিক, কাজের কাঠামোভিত্তিক প্রশ্নে নেওয়া যায় না? সংশ্লিষ্টরা কি ভেবে দেখবেন?
যাই হোক, ভালো চাকরি পাওয়ার চেষ্টা তরুণরা করবে এটা স্বাভাবিক। আর এই চেষ্টা করাটা কিন্তু নতুন কিছু নয়। এখন যেমন বিয়ের পাত্র হিসেবে অনেক অভিভাবকই বিসিএস ক্যাডারদের পছন্দ করেন, একসময় সেটা ছিল ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের জল-মেশানো উত্তরসূরী পরাক্রান্ত সিএসপিদের দখলে! স্নিগ্ধ, নিরঞ্জন, রুচির চর্চার বদলে অধিকাংশ তরুণীদের অভিভাবকরা ওই সিএসপিদের দিকে ছুটত। সিএসপি হওয়া ছেলেরা বাগিয়ে নিত সব সুন্দরী রমণীদের। এ নিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখা একটি মজার কবিতা আছে। কবিতায় তিনি লিখেছেন,
‘‘ওগো কন্যে, তোমার জন্যে
লিখব না আর কবিতা;
ওগো বড়লোকের ঝি
আমি হবো সিএসপি!’’ (সূত্র: বিদায় অবন্তী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ)
চারদিকে দেখি, সবাই ছুটছে সরকারি চাকরির পেছনে। সেই চাকরি পেতে পাস করতে হয় বাংলা, ইংরেজি, গণিত আর সাধারণ জ্ঞান মেশানো প্রশ্নপত্রের পরীক্ষা। সেটার প্রস্তুতি নিতে সব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে! সব বাদ দিয়ে কাজ ওইসব বই মুখস্থ করে ফেলা। তারা গাদা গাদা চাকরির পরীক্ষা পাসের বই নিয়ে লাইব্রেরিতে ভীড় করছে। সেখানে পরিবেশ নিরিবিলি। অবশ্য দেশের অন্য শহর নয়; এটা আমি ঢাকা শহরের লাইব্রেরিগুলোর কথা বলছি। এ ব্যাপারে আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।
গত বছর জরুরি একটা বিষয়ে কিছু বই সংগ্রহ করতে পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভেতরে গিয়ে দেখি বসার মতো অবস্থা নেই। টেবিলগুলোতে ছড়ানো ছিটানো আছে ওরাকল, এমপিথ্রি সিরিজের বিভিন্ন বই আর মুখ গুঁজে সেসব মুখস্থ করতে ব্যস্ত শত শত তরুণ শিক্ষার্থী। এদের কেউ সদ্য স্নাতক, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। তারা কার্যত অপ্রয়োজনীয় তথ্যে ঠাসা বইপত্র নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকলেও পাশের শেলফে রাখা হাজার হাজার মহামূল্যবান বইয়ের দিকে কারো নজর নেই। সেদিন সেখান থেকে ফিরে আসার সময় ভাবলাম, এই লাইব্রেরিগুলো প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য কী ছিল; কিংবা চাকরিজীবী বানানো কি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য হতে পারে? জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা বাংলাদেশের তরুণরা কীভাবে পার করছে সেটা নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। নইলে প্রকৃত মননশীল মানুষ ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে মেধাহীন ডিগ্রিধারী কিছু চাকরিজীবী, যাদের দিয়ে সরকারি সেবা জনগণের কাছে পৌঁছানোর কাজ হয়তো করানো যাবে কিন্তু দেশ এগিয়ে নেওয়ার জন্য নানা খাতের গুরুত্বপূর্ণ প্রজ্ঞাবান জ্ঞানীজন আমরা পাব না।
লাইব্রেরির গুরুত্ব নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এ জন্যই লাইব্রেরি ব্যবহারে উৎসাহ দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ বিদ্বানেরা। প্রমথ চৌধুরী লাইব্রেরিকে স্কুল কলেজের ওপরে স্থান দিয়েছেন। আর মোতাহার হোসেন চৌধুরী লাইব্রেরিকে চিহ্নিত করেন জাতির সভ্যতা ও উন্নতির মাপকাঠি হিসেবে। শুধুমাত্র লাইব্রেরির সংস্পর্শে থেকেই আরজ আলী মাতুব্বর হয়েছিলেন একজন স্বশিক্ষিত দার্শনিক। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘লাইব্রেরির মুখ্য কর্তব্য হচ্ছে বইয়ের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া।’ কিন্তু আজকাল পাঠকেরাই লাইব্রেরির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে বিসিএস পরীক্ষার বিভিন্ন বই। এখন আর আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা অনুসন্ধিৎসু হয়ে লাইব্রেরিতে যায় না। তারা লাইব্রেরিতে যায় মূলত চাকরির পরীক্ষার বই পড়তে। আর চাকরিপ্রার্থীরা লাইব্রেরিতে থাকা বই ছুঁয়েও দেখে না। তাদের নজর থাকে কিছু সুনির্দিষ্ট চাকরির বইয়ের দিকে। আর এই ব্যাপারটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য উদ্দেশ্যের সাথে একেবারেই মিলে না।
আপনি যদি সকাল ছয়টা থেকে আটটা এই সময়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে যান, দেখবেন শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরিতে পড়ার জন্য ভোর থেকে লাইনে দাড়িয়ে আছে। সকাল আটটায় গ্রন্থাগারের গেইট খুলে দেয়া হয়। এরপর সবাই ভেতরে প্রবেশ করে, শুরু করে দিনব্যাপী পড়াশোনা। সবাই প্রবেশের এক ঘণ্টা পর কৌতুহল নিয়ে আপনি যদি ভিতরে প্রবেশ করেন তবে দেখতে পাবেন, থরে থরে সাজানো এনসাইক্লোপিড়িয়া ব্রিটেনিকাসহ বৈশ্বিক জ্ঞান-ভান্ডারের প্রতি তাদের কোন আগ্রহ নেই। পড়ার টেবিলগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম শ্রেণির পাঠ্যবই। আর সাথে ওরাকল, মহামহিম এমপি থ্রি নামের অদ্ভুত এক জগাখিচুড়ি বই।
আমরা যারা পড়াশোনা করি বা করছি, তারা শুধু নিজের একটা চাকরির চিন্তা করলেই হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমাদের পেছনে খরচ করা ভর্তুকির টাকায় অনেক খেটে খাওয়া মানুষেরও অংশ আছে। সবচেয়ে বড় কথা দেশের খুব কম মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়। যাদের টাকায় আমরা পড়াশোনা করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ফ্যান-বাতি চলে, তাদের অনেকেই উদয়াস্ত পরিশ্রম করে নিজের জীবনমানকে আরেকটু সুন্দর আর উন্নত করার চিন্তা করতে পারে না। তাই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়ায় যেন উচ্চ বিদ্যায়তনের শিক্ষার্থীরা গবেষণা করে এমন তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারে যাতে পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবনের কোনো না কোনো কল্যাণ হয়। গত দুই দশকে দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান সৃজনের আয়োজন বহুলাংশে যে অনুপস্থিত সেটি সহজে অনুমেয়। মোটকথা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন তাদের দায়িত্ব কেবল নিজের একটা চাকরি জোগাড় করে আরাম আয়েশে বাদবাকি দিন কাটিয়ে দেওয়া নয়। যদিও বেশিরভাগ আসলে তাই-ই করেন। কিন্তু আর এমন ভাবলে দেশের উন্নতি কখনও হবে না। জাতি উন্নত করতে যে চিন্তাগুলোর সমন্বয় দরকার, যে শিক্ষার প্রয়োজন তা আমাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে আসে না। আমাদের পড়াশোনার জন্য, ভালো জীবনের জন্য সারা দেশের মানুষই ভর্তুকির টাকায় অংশীদার ছিলেন এটা মনে রেখে সবার জন্য কোনো না কোনো খাতে নিজের জ্ঞান বুদ্ধি খাটিয়ে পরিশ্রম করে কিছু করে যাওয়া উচিত। যা পরবর্তী উন্নত, সুখি, সুন্দর, মননশীল জীবনের অধিকারী হতে মানুষের কাজে লাগবে। আর সেজন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হলো বই পড়া। আর সেই বই পড়তে লাইব্রেরিগুলোতে বসার জায়গাই আপনি এখন পাবেন না। সেখানে ওরাকল, এমপিথ্রি সব দখল করে ফেলেছে। কী লজ্জা!
লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাংলা বইয়ের দু:খ’ নামে একটা অভিভাষণ আছে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘বিলেতে প্রতি ঘরে একটি করে লাইব্রেরি আছে। কেউ বই পড়ুক বা না পড়ুক ওটা ওদের ঘরের শোভা।’ অনেক দিন আগে করা শরৎচন্দ্রের এই কথা এখন আর বিলেতে কতোটা বাস্তব তা আমি জানি না, তবে কথিত পাঠ্যপুস্তকের বাইরে যত বেশি বই আমরা পড়বো, ততো বেশি দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির জন্য কাজ করতে নিজেকে যোগ্য করতে পারব। তখন হয়তো পাঠ্য আর অপাঠ্য পুস্তক আলাদা করে বিচার করার জ্ঞানও অর্জিত হবে।
প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক মানবকণ্ঠ, ৩০ আগস্ট, ২০২০