একজন লেখককে সম্ভবত শাসন করে তার লেখা। এ কারণে নিজের সৃষ্টির শাসনে একজন লেখক যে জীবনকে যাপন করেন, সেটি হয় যুগপৎ বন্দি ও মুক্ত। কয়েকদিন আগে আমাদের সবার শ্রদ্ধেয়, প্রাবন্ধিক আহমদ রফিকের একটি সাক্ষাৎকার দৈনিক আজকের পত্রিকায় পড়ে মনটা ভীষণ খারাপ হলো।
সেইসাথে এ কথা ভেবেও বিচলিত হলাম, যে জীবন রাতের পর রাত নিদ্রাহীন চোখ নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করে যায়, সমৃদ্ধ করে চলে দেশের ভাষা আর সংস্কৃতি; শেষ বয়সে তার উপার্জনহীন জীবনে রাষ্ট্র কতটা পাশে দাঁড়ায়? যতটা দাঁড়ায় কখনো কোনো লেখকের ক্ষেত্রে, সেটা কি যথেষ্ট হয়?
একজন আহমদ রফিক, যিনি সাহিত্যকর্ম বিচারে মূলত প্রাবন্ধিক, জাতীয় মুক্তির ইতিহাসে একজন অগ্রগামী ভাষাসংগ্রামী, তিনি আমাদের পরম শ্রদ্ধেয়জন। আহমদ রফিক সম্পর্কে প্রয়াত আনিসুজ্জামান স্যার লিখেছিলেন, ‘ডাক্তারি পাস করলেও তিনি চিকিৎসা পেশায় যাননি, একটি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। রাজনীতিতে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেননি, তবে মার্ক্সবাদে তার আস্থা রয়ে গেছে অবিচল এবং তার সৃষ্টিশীল কর্মেও মার্ক্সবাদী চেতনার প্রতিফলন আছে। অন্যদিকে সাহিত্যকর্ম শুধু ধরেই রাখেননি, এটিই হয়ে দাঁড়ায় তার সর্বক্ষণের কাজ।’
সাহিত্যকর্মকে সর্বক্ষণের কাজ হিসেবে নেয়া সেই মানুষটি আজ শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে ভালো নেই। আমরা চাই রাষ্ট্র তার পাশে দাঁড়াক।
আমরা প্রাবন্ধিক আহমদ রফিকের প্রবন্ধে ও কলামে পাই কালের স্বাক্ষর। তার শেষ বই তথা আত্মজীবনীর নাম দিয়েছেন, ‘দুই মৃত্যুর মাঝখানে নান্দনিক একাকিত্বে’। এই নামেই একটা মৌন হাহাকার, একটা অতৃপ্তি টের পাওয়া যায়। সেই অতৃপ্তির কথা তিনি বলতে চান না। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তার বিড়ম্বনা জাগতিক ও পূর্বাপর, জীবনটা যেন এক ধরনের বহুমাত্রিক লড়াই।
আহমদ রফিকের জন্ম কুমিল্লা জেলার শাহবাজপুর গ্রামে। ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে আহমদ রফিকের সংশ্লিষ্টতা ১৯৪৮ সালের মার্চে মুন্সীগঞ্জে হরগঙ্গা কলেজে পড়ার সময় মিছিলে আর স্লোগানে। এরপর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য অগণতান্ত্রিক ধারার বিরুদ্ধে সূচিত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এজন্য ঢাকার রাজপথে মিছিলে হেঁটেছেন, হল-লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত থেকেছেন সামনের কাতারে। এ ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে সর্বাত্মক সংশ্লিষ্টতা তাকে একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তিনি ৯৪ নবাবপুর রোডে ১৪৪ ধারার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা চলাকালে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করেন।
১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে আলোচনার পর স্ব-উদ্যোগেই চলে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে। সেখানে দফায় দফায় কথা হয় ছাত্র নেতাদের সঙ্গে। এ ঐতিহাসিক মুহূর্তে আন্দোলন পরিকল্পনা, ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে ছাত্রদের সম্পৃক্ত করা এবং সমন্বয় করার ব্যাপারে আহমদ রফিক ভূমিকা পালন করেন। তার কর্মব্যস্ততা ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমতলার সভা, গুলিবর্ষণসহ পরবর্তীকালে আন্দোলনের প্রায় সব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ মিনার নির্মাণের শেষ পর্যন্ত। তিনিই প্রথম গঠন করেন ‘একুশে পরিষদ’ ও ‘ভাষা আন্দোলন জাদুঘর’। ‘একুশে’ তার জীবনে বড় একটি জায়গা দখল করে নেয় এভাবেই।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী এই মানুষটি ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন, ‘আটচল্লিশ থকে বায়ান্নর তরুণ প্রজন্ম বিশেষত ছাত্রসমাজ মাতৃভাষা বাংলার অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে, দাবি জানায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী সব। তারা বুঝতে পারে দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হলে বাঙালি জাতির উন্নতির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সে দাবি মানতে নারাজ। তাই তাদের আন্দোলনে নামতে হয়। সে আন্দোলনে ছাত্র নয়, এমন সব তরুণও যোগ দেয়; সব কিছু দেখে এগিয়ে আসে সাধারণ মানুষ। আন্দোলন এভাবেই জমজমাট হয়ে ওঠে। পুলিশের গুলিতে রক্ত ঝরে, শহীদ হন অনেকেই। ওই আন্দোলনের জেরে ১৯৫৬ সালে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে মেনে নেয় পাকিস্তান সরকার। এই ভাষা আন্দোলনের জের ধরে গণ-আন্দোলন শুরু, শেষ পর্যন্ত একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ।’ (রাষ্ট্রভাষার লড়াই)
আহমদ রফিকের প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। সেই প্রথম বইটির নাম ‘শিল্প সংস্কৃতি জীবন’। এই গ্রন্থে সাহিত্য-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন মার্ক্সবাদী নন্দনতাত্ত্বিক ধারায়। তিনি লেখালেখিকে অর্থনৈতিক পেশা নয়, সাংস্কৃতিক পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম রাজনীতির বিপরীতে। অবশ্য এটাই শেষদিকে হয়ে ওঠে তার সার্বক্ষণিক কাজ। উপমহাদেশে রবীন্দ্র গবেষণা ও রবীন্দ্র চর্চার প্রবাদ পুরুষ তিনি। গড়েছেন রবীন্দ্রগবেষণা কেন্দ্র। জমানো ২০ লাখ টাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্ট করে খরচ করেছেন আহমদ রফিক। তার বিশ্বাস, রবীন্দ্রজীবন ও রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে ভিন্ন মাত্রায় মৌলিক গবেষণার এমনকি নতুন ধারায় বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ এখনো রয়েছে। ভাষা আন্দোলন বিষয়ে তার বহু তথ্যবহুল গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা, প্রবন্ধ, কলাম, রবীন্দ্র গবেষণা, নজরুল-জীবনানন্দ-বিষ্ণুদেসহ বাংলা ভাষার বহু লেখক কবির নিবিড় বিশ্লেষক তিনি। পেশা ও জীবিকার চেয়ে সাহিত্যের নেশাই তার কাছে মুখ্য ছিল সব সময়।
পত্রিকায় দেখলাম, সম্প্রতি তার ৯৩তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বেচ্ছায় মৃত্যুর আইন চেয়েছেন। এ বিষয়টি জানার পর তার বর্তমান অবস্থার সম্পৃক্ততা অনুভব করে বিচলিত বোধ করছেন বাংলাদেশের সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্বরা। এ অবস্থায় ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিককে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের জন্য সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানিয়েছেন বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ১৮ জন লেখক-কবি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদয় হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
আহমদ রফিকও বলেছেন, যদি শর্তহীন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাষ্ট্র তার পাশে দাঁড়ায়, সেক্ষেত্রে তার কোনো আপত্তি থাকবে না। আর আমরা জানি, বিপুল কাজের যে সৃষ্টিশীল বিশাল ভুবন আহমদ রফিক গড়ে তুলেছেন তা জাতির এক অমূল্য সম্পদ। এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য তাকে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করবে বলে আশা করি।