রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো প্রভাব কি বাংলাদেশে পড়বে?

হাসান হামিদ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে কোনো প্রভাব পড়বে কিনা তা নির্ভর করছে এই মুহুর্তে এই দুই দেশের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক কিংবা বাণিজ্য খাতের সম্পর্ক কেমন তার ওপর। বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন প্রকল্পে রাশিয়া কাজ করছে। (উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র) তাছাড়া রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য রয়েছে। রাশিয়া থেকে এদেশে সামরিক সরঞ্জাম, খাদ্যপণ্য এসব আসে। আর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের নতুন বাজার এখন রাশিয়া। গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ গণমাধ্যমে বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের প্রভাব তাদের ব্যবসায় পড়তে শুরু করেছে। আর বিশেষজ্ঞদের মত হলো, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বড় প্রভাব বাংলাদেশে খুব শীঘ্রই হয়তো দৃশ্যমান হবে না। কিন্তু এই যুদ্ধ যদি অনেক দিন ধরে চলে তবে কিছু বিষয়ে বাংলাদেশকে বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে হবে।

রাশিয়া কেন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে? এটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে হলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে থাকাতে হয়। চলমান সংকটের পেছনে ‘ন্যাটো’ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ন্যাটো গঠিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। ন্যাটো একটি সামরিক জোট যা একটি অভিন্ন নিরাপত্তা নীতিতে কাজ করার আদেশ দেয়। যদি একটি ন্যাটো সদস্য দেশ আক্রমণ করা হয়, এটি সমস্ত ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর ওপর আক্রমণ হিসাবে বিবেচিত হয়। তখন ন্যাটোর সকল সদস্য দেশ এই আক্রমণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। বর্তমানে ন্যাটোর ৩০টি সদস্য দেশ রয়েছে। ইউক্রেন এই ন্যাটোর অংশ হতে চায়, কিন্তু রাশিয়া এর বিপক্ষে। কেন পক্ষে না? কারণ রাশিয়া আশঙ্কা করছে ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিলে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর বাহিনী তার সীমান্তে থাকবে। কিন্তু রাশিয়া তা চায় না। আর ইউক্রেন কেন ন্যাটোতে যোগ দিতে চায়?

ইতিহাস বলছে, ১৯১৭ সালের আগে, রাশিয়া এবং ইউক্রেন রাশিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। রুশ বিপ্লবের পর রুশ সাম্রাজ্য ভেঙে গেলে ইউক্রেন তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে এটি সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগ দেয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ইউক্রেন স্বাধীন হয়। ইউক্রেনের রয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম দুটি অংশ। পূর্ব অংশে বসবাসকারী ইউক্রেনীয়রা নিজেদের রাশিয়ার কাছাকাছি এবং পশ্চিম অংশে বসবাসকারীরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে যুক্ত। রাশিয়া সমর্থিত বিদ্রোহীদের পূর্ব ইউক্রেনের বিশাল অংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এই অঞ্চলে রাশিয়া দোনেস্ক এবং লুহানস্ককে আলাদা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১৪ সালে, রাশিয়া ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করেছিল। রাশিয়ার তুলনায় ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী অনেক কম। যেখানে রাশিয়ার সক্রিয় সৈন্য রয়েছে ৮.৫ লাখ, ইউক্রেনের সক্রিয় সৈন্য রয়েছে মাত্র ২ লাখ। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা বাজেট ইউক্রেনের ১০ গুণ। এই পরিস্থিতিতে, ইউক্রেনের একটি সামরিক সংস্থার প্রয়োজন যেটি তার সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে পারে এবং ইউক্রেনের জন্য ন্যাটোর চেয়ে ভাল আর কেউ নেই তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য ন্যাটোর হাত ধরতে চাইছে, যা রাশিয়া পছন্দ করছে না। আর তা নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান সংকট।

এছাড়া আরেকটি বিষয় হলো ইউক্রেনের বিপুল পরিমাণের খনিজ সম্পদ। যেমন ১ দশমিক ০৯ ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাসের মজুত আছে ইউক্রেনে, যা ইউরোপে দ্বিতীয় বৃহৎ মজুত। কয়লার মজুতেও বিশ্বে সপ্তম ও ইউরোপে দ্বিতীয় এই ইউক্রেন। এখানকার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ হলো লিথিয়াম, যা গাড়ির ব্যাটারির অন্যতম উপাদান। আবার টাইটানিয়াম যা মূলত উড়োজাহাজ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়, এটিরও বিশ্বের ২০ শতাংশ মজুত রয়েছে ইউক্রেনে। এসব মিলিয়ে কেউ কেউ মনে করছেন রাশিয়া প্রাকৃতিক সম্পদের এই প্রাচুর্য পেতে চায় বলেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

জানা কথা, প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া। চলমান সংকটে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তা হলে এর বড় প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে যানবাহন, কৃষি সবকিছুর ওপর প্রভাব পড়াই স্বাভাবিক। অবশ্য সেই প্রভাব কতো ব্যাপক হবে, সেটা নির্ভর করবে এই সংকট কতদিন ধরে চলে তার ওপরে। যদি নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সেটার মাত্রা বাড়তেই থাকবে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর দেওয়া তথ্য মতে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশে থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য, যার মধ্যে তৈরি পোশাক সবচেয়ে বেশি। আর রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য, যার বেশিরভাগই খাদ্য পণ্য। বাংলাদেশে গমের যে চাহিদা এর এক-তৃতীয়াংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। প্রতিবছর আট থেকে দশ লাখ টন গম আমদানি হয় এই দুই দেশ থেকে। আর ভুট্টার ২০ শতাংশ আসে এই দুই দেশ মিলিয়ে। যুদ্ধের কারণে এখন সেটা বাধাগ্রস্ত হবে। তাছাড়া ইউক্রেনের ওপর হামলা চালানোর কারণে ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশ রাশিয়ার ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তার বেশিরভাগই আসলে অর্থনৈতিক। এই সংকটের কারণে তেলের দাম বিশেষ করে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়েছে। আরও বাড়তে পারে। ফলে এর একটা প্রভাব বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর পড়বে বলে মনে করছেন অনেকে।

আমরা জানি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বাংলাদেশের সাথে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এদেশে রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিংবা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মতো বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে রাশিয়ার ওপরে সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে এসব প্রকল্পে কোনো প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন না বিশেষজ্ঞরা। কূটনীতিকরা বলছেন, বৈশ্বিক একটি পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব বিশ্বের দেশগুলোর ওপর নানাভাবে পড়বে। সংকট দীর্ঘ হলে বাংলাদেশের ওপরে কূটনীতিকভাবে চাপও তৈরি হতে পারে। এসবের মাঝেও রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের যে ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, বিশেষ করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যাপারে, সেটা কীভাবে আমরা অব্যাহত রাখা যায়, সেটি খেয়াল রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো প্রভাব কি বাংলাদেশে পড়বে?

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top