মোজাফ্‌ফর হোসেনের ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’য় একদিন

জীবনে প্রথমবার আমি রেস্টুরেন্টে ভাত খেয়েছি ১৯৯৮ সালে, তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। গ্রামে বড় হওয়া আমি সেবার থানা পর্যায়ে যেখানে পরীক্ষা কেন্দ্র সেখানকার এক বাড়িতে নয় দিন থেকেছিলাম বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার নিমিত্তে। যে বাড়িতে থেকেছি সেখানে আমাদের স্কুলের এক শিক্ষক থাকতেন, নাম সীতেশ চন্দ্র তালুকদার। নিতান্ত ভদ্রলোক এই মানুষটি নিজে যে বাসায় ভাড়া থাকতেন, সে বাড়িতে আমার থাকার বন্দোবস্ত হয়। স্যার একটি হোটেলে খেতেন। অগত্যা আমারও সে ক’দিন নিয়মিত হোটেলে খেতে হলো। হোটেলটি এখন আছে কিনা জানি না, নাম ছিল ‘ইত্যাদি’ ভাতের হোটেল। সেই রেস্টুরেন্টের খাবারের স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। আমরা নাগরিক জীবনে প্রতিনিয়ত রেস্টুরেন্টে খাই। মাংস খেতে গেলে ঢাকায় অনেকেই দেখি সন্দেহ করে, ঠিক আছে তো সব! অথচ আপনি জেনে অবাক হবেন, মানুষের মাংসের পর্যন্ত রেস্টুরেন্ট আছে এই গ্রহে; ইয়েস, সেটি বৈধও। বর্তমান সময়ের আলোচিত গল্পকার প্রিয় মোজাফ্‌ফর হোসেনের ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ গ্রন্থ সম্পর্কে বলার আগে সেই ভয়ানক ব্যাপারটি বলার লোভ সামলাতে পারছি না।

আচ্ছা, আপনি ক্যানিবালিজম সম্পর্কে শুনেছেন? ক্যানিবালিজম শব্দটি প্রথম যখন সবার গোচরে আসে তখন বেশ আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। এই শব্দটির মানে ‘নরমাংস ভক্ষণ’। শুরুতে কেবল মানুষের ক্ষেত্রে ক্যানিবালিজম ব্যবহার করা হলেও পরবর্তীতে অবশ্য এর বর্ধিত সংজ্ঞার্থ দেওয়া হয়। প্রাণিজগতের কোনো প্রজাতি তার স্বজাতির মাংস খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে তাকে (প্রক্রিয়া) ক্যানিবালিজম বলা হয়।

মানুষের মাংস খাওয়া নিয়ে ১৯০৩ সালে জেমস ডব্লিউ ডেভিডসন একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম ‘দ্য আইল্যান্ড অব ফরমোসা’। এই গ্রন্থে তিনি বর্ণনা করেছেন কীভাবে তাইওয়ানের চীনা অভিবাসীরা তাইওয়ানের আদিবাসীদের মাংস খেয়েছিল ও বিক্রি করেছিল। ইতিহাস বলে, ১৮০৯ সালে নিউজিল্যান্ডের মাওরি উপজাতিরা নর্থল্যান্ডে দ্যা বয়েড নামের একটি জাহাজের প্রায় ৬৬ জন যাত্রী ও ক্রুকে খুন করে এবং এরপর তাদের সবার মাংস খেয়েছিল। যুদ্ধের সময় মাওরিরা তাদের প্রতিপক্ষের মাংস খেয়ে ফেলতো। আর আমি জাপানের যে রেস্টুরেন্টের কথা বলেছি সেটি টোকিওতে চালু করা হয়। সেই রেস্টুরেন্টে প্রকাশ্যেই বিক্রি হত মানুষের মাংস দিয়ে তৈরি করা নানা রকম খাবার। জানা যায়, ঐ রেস্টুরেন্টটির মানুষের মাংস বিক্রি করার বৈধতাও রয়েছে। টোকিওতে অবস্থিত ঐ রেস্টুরেন্টির নাম ‘The Resoto ototo no shoku ryohin’, নামটি জাপানি ভাষায় রাখা হয়েছে। এই নামের বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘খাবারের যোগ্য ভাই’। মেক্সিকান সংবাদমাধ্যম মেলিনিও’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঐ রেস্তোরাঁর মালিকের দাবি এটি বিশ্বের প্রথম রেস্টুরেন্ট, যেখানে বৈধভাবে মানুষের মাংস বিক্রি হয়। ঐ রেস্টুরেন্টটি নাকি মৃত মানুষের লাশ কিনে নেয়। এমনকি জাপানের অনেক মানুষই আছে যারা মৃত্যুর পূর্বে তাদের সেই দেহ ঐ রেস্টুরেন্টটিতে বিক্রয়ের জন্য পরিবারকে জানিয়ে রাখে। রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ প্রত্যেকটি লাশের জন্য ঐ মৃত ব্যক্তির পরিবারকে সর্বনিম্ন সাতাশ হাজার ইউরো পরিমাণ অর্থ প্রদান করে, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ত্রিশ লাখ টাকার বেশি। যুক্তরাজ্যের ‘দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট’-এ প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে রেস্টুরেন্টে মানুষের মাংস বিক্রি করার অপরাধে নাইজেরিয়ার আনাম্ব্রা প্রদেশের একটি রেস্তরাঁ থেকে দেশটির পুলিশ এগারো জনকে গ্রেফতার করেছিল।

সে যাই হোক, এবার আসি গল্পকার মোজাফ্‌ফর হোসেনের ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’র গল্পে। আমরা অনেকেই এখন জানি, বাংলা গল্পকে যারা বিশ্বসাহিত্যে সামিল করতে কাজ করে চলেছেন, গল্পকার মোজাফফর হোসেন তাঁদের অন্যতম। আমি মাঝে মধ্যে ভাবি, আচ্ছা, কী আছে তাঁর লেখা গল্পে যা এরকম আষ্টেপৃষ্টে টেনে ধরে পাঠককে? পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স প্রকাশিত ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ বইয়ের গল্পগুলো পড়ে বুঝতে পারি, তাঁর বিষয়ভাবনা অনন্য। আর তাই পাঠককে সেগুলো ভাবায় দারুণভাবে। লেখা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, গল্পকার মোজাফফর হোসেন Brandon Sanderson এর সেই কথাটি আত্নস্থ করেছেন, “The purpose of a storyteller is not to tell you how to think, but to give you questions to think upon” ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’র গল্পের কয়েক লাইন পড়তে চাই, ‘‘আমরা ‘মিট হিউম্যান মিট’-এ এলাম। হোটেলে মালিক একজন সাবেক মন্ত্রী। দেয়ালে বড় করে তার ছবি টাঙানো। ছবিটার নিচের টেবিলে আমরা বসেছি। এদিকে আলো ও মানুষের চাপ, দুটোই কম। গল্প করতে করতে সময় নিয়ে খাওয়া যাবে। মানুষের মাংস দ্রুত খেলে নাকি স্বাদ পাওয়া যায় না। মুখের ভেতর অনেকক্ষণ রেখে গিলতে হয়’’। এ লাইনগুলো পড়ে আমিও ভাবতে লাগলাম, নর মাংস আস্তে আস্তে খেতে হয়!

‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ গ্রন্থের বেশিরভাগ গল্প একরৈখিক। ডালপালা কম। আগাছা তো নেইই। তবে আমি নিশ্চিত তাঁর গল্প পাঠ করে পাঠক বিহ্বল হবে, কখনোবা চমকে যাবে, ধাক্কা খাবে। গল্পকার মোজাফফর হোসেন পাঠকের হাত ধরে ছুটতে ছুটতে একটা চৌরাস্তার মোড়ে এনে ছেড়ে দেন তার হাত। পাঠক খুঁজতে থাকেন পথ। হাঁটতে থাকেন সামনে। শেষ না জানা অবধি পড়া বন্ধ করতে পারেন না। অন্য অনেক লেখকের সাথে তাঁর ভিন্নতা এখানেই যে, তিনি যখন গল্প বলেন, তখন কেবল কাহিনি বলেন না, কাহিনির মধ্যে জীবনকে টেনে নেন। তাঁর গল্পগুলো ছোট হয়। কোনোটা এমনকি আড়াই-তিন পৃষ্ঠা। কিন্তু বিষয় বৈচিত্র্যতায় একেবারে আলাদা। আর এগুলৈ মূলত পাঠককে প্রবলভাবে ভাবায়, আকৃষ্ট করে। তাঁর গল্পে ঘটনার ঘনঘটা বেশি, মাঝেমধ্যে মনে হয় তাড়াহুড়ো করে ঘটছে একটার পর একটা। আসলে কাহিনির ঠাসা বুননে মোজাফফর হোসেন ওস্তাদ। তিনি আসল কথা সোজা করে বলেন, বলেন কেবল প্রয়োজনীয় কথাটিই। পাঠক তাতে বিরিক্ত হন না। মেদহীন ঝরঝরে গল্প বলেন তিনি। তাঁর গল্প বাহুল্যবর্জিত, রসঘন ও নিবিড়। গল্পের ভাষা সমসাময়িক। পাত্রপাত্রী বা চরিত্রের সংখ্যা খুবই সীমিত। প্রতিটা গল্পের প্রারম্ভ ও প্রাক্কাল খানিকটা নাটকীয়। এক লাইন পড়লে কল্পনার অকল্পনীয় বিস্তার ঘটে যায় পাঠকের মনে। ‘শেষ মাথাটি কাটাপড়ার আগে’ গল্পের শুরুটা পড়তে চাই,

‘‘ঘুম থেকে উঠে যা দেখলাম তাতে আমার মাথাটা যেন সত্যি সত্যি ঘুরে গেল। প্রতিদিনের অভ্যাস মতো বিছানা থেকে উঠে আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুলটা ঠিক করে নিলাম। এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। এরপর যখন রোজকার মতো বারান্দায় দাঁড়িয়ে পথচারীদের একবার দেখে নিতে চাইলাম মাথাটা তখনই ঘুরল। প্রথমে চক্কর দিয়ে ওঠে, মুহূর্তেই মনে হয় পড়ে যাব নিচে। বারান্দা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত গ্রিল দিয়ে আটকানো, পড়ে যাওয়ার কোনো শঙ্কা নেই, কিন্তু মনে হলো আমি পড়ে যাচ্ছ। নিজের চোখকে কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। ফের নিচে তাকালাম। রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে মাথাবিহীন মানুষ। রিকশাচালকের মাথা নেই, যে লোকটা মুদির দোকানে বসে আছে কিছু বিক্রি করবে বলে তার মাথা নেই, যে কিছু একটা কিনবে বলে দাঁড়িয়ে পকেটবিহীন টিশার্টের বুকে বারবার পকেট খুঁজে হয়রান হচ্ছে তারও মাথা নেই। ফুটপাতের উপর নিচ দিয়ে যারা ইটছে কারো মাথা নেই। একটা মোটরসাইকেল চলে যায় চোখের পলকে, মাথাবিহীন চালক, মাথাবিহীন পেছনে কেউ বসে। ফুটপাতে দুজন পড়ে আছে, মৃত কিংবা জীবিত, মাথা নেই তাদেরও। কাঁধের উপর মাথা যেখানে থাকে সেখানটা এমনভাবে ভোঁতা যেন কোনোদিনই এদের মাথা ছিল না। মাথাবিহীন অন্যরকম এক প্রাণী জগতের বাসিন্দা মনে হয় নিজেকে’’। কিংবা ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ নামের গল্পের প্রথমটা পড়েই পাঠকের আগ্রহ তৈরি হয়, ‘‘বড় বড় করে লাল অক্ষরে লেখা ‘এখানে মানুষের খাটি মাংস পাওয়া যায়’। হারুন আমাকে দেখিয়ে বলে, দেখ ‘খাঁটি’ শব্দে চন্দ্রবিন্দু বসায়নি। আমি নিশ্চিত ভেজাল মাংস রাঁধে!’’

‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ বইয়ের গল্পের চরিত্ররা অদ্ভুত, স্মৃতিভ্রষ্ট যেন! আপনার ভাবনায় আঘাত পড়বে যখন দেখবেন গল্পের চরিত্ররা মানুষের মাংস খেতে খেতে হিউম্যান রাইটস নিয়ে কথা বলছে! স্মৃতিভ্রষ্টের মতো ঠিকানাহীন ঠিকানায় চিঠি লিখছে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘একশ বছরের নিঃসঙ্গতা’ উপন্যাসের মাকোন্দ গ্রামের কথা মনে পড়লো এই গল্প পড়ে। সেই গ্রামের সকলেই ছিলেন স্মৃতিভ্রষ্ট। আগের সব কথা তারা ভুলে যান, মনে থাকে না কিছুই। এ কারণে তারা গাভীর গায়ে লিখে রাখেন, ‘এটা গাভী, দুধ দেয়’। ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ গল্পগ্রন্থের চরিত্রগুলোও এ রকম স্মৃতিভ্রষ্টের মতো আচরণ করে। আর এভাবেই গল্পের বিষয় ভাবনা পাঠকের অনুভূতির পুকুরে ঢিল ছোঁড়ে। আর পুকুরে ঢিল ছোঁড়ার সাথে সাথে প্রথম যে ছোট্ট বৃত্তটি তৈরি হয় তা হলো মুগ্ধতার বৃত্ত। তারপর বৃত্তের বাইরে একের পর এক বড় বৃত্ত তৈরি হয়। যা পাঠকের মন গল্পের ভেতরের গল্প জানতে আগ্রহ সৃষ্টি করে। ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ গল্পের কয়েক লাইন, ‘‘মিট হিউম্যান মিট রেস্তোরাঁয় এভাবেই নাকি রোজ রোজ সমাজ বদলের তর্কে বসে বিত্তবান মানুষরা, প্রান্তিক মানুষের অধিকার নিয়ে মিটিং করে দেশি বিদেশি সংগঠনগুলো। বিল দেওয়ার সময় ম্যানেজার হাসতে হাসতে আমাদের বলে, আবার আসবেন স্যার! আমাদের মানুষের মাংসে কোনো ভেজাল নেই’’।

‘একটি খুনের স্বীকারোক্তি’ গল্পে খুনির দুটো হাতই নাই। গল্পে বলা হয়েছে,  ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় রাজাকাররা তার দুটো হাতই কেটে নিয়েছে। আর এখন এলাকার চেয়ারম্যানকে খুনের অপরাধে আসামি করা হয়েছে দুই হাত না থাকা এই লোককে। ‘একটি খুনের স্বীকারোক্তি’তে প্রফলিত হয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার। পরের গল্প ‘শেষ মাথাটি কাটা পড়ার আগে’তে লেখক দেখিয়েছেন, মাথাহীন মানুষের রাষ্ট্রে কীভাবে মানবতা ভেঙে পড়েছে, সৃষ্টি হয়েছে বীভৎস বিশৃঙ্খলা। গল্পকার দেখছেন কেবল তারই মাথা আছে, আর কারো মাথা নেই! ‘একটি খুনের স্বীকারোক্তি’ গল্প থেকে পাঠের লোভ সামলাতে পারছি না, ‘‘খুন করেছিস কেন? খগেনকে জিজ্ঞাসা করেন থানার দারোগা। খগেন চুপ করে শোনে। জবাব দেয় না। হাবিব চেয়ারম্যানকে হত্যার মামলায় ওকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার বিবরণ মোতাবেক, খুনি রাতের অন্ধকারে হাবিব চেয়ারম্যানের বাড়িতে ঢুকে ঘুমন্ত চেয়ারম্যানকে প্রথমে চেতনানাশক কিছু শুঁকিয়ে অজ্ঞান করেছে, এরপর তার হাত দুটো খাটের সঙ্গে বেঁধে ধারালো বঁটি দিয়ে গলাটা কেটেছে। বঁটিটা পাওয়া যায়নি, কিন্তু বাদীপক্ষ কেসের বিবরণে এমনটি বলেছে। বাদী চেয়ারম্যানের দুই ছেলে। খগেনের বাড়ি চেয়ারম্যানবাড়ির ডান পাশের প্রাচীরের ওপাশে। প্রাচীরটা হাত-পা ছড়াতে ছড়াতে খগেনের উঠোনের প্রায় সবটুকু খেয়ে ফেলেছে। আর একবার ধাক্কা দিলেই ওর মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পগারে গিয়ে পড়বে। একসময় চেয়ারম্যানবাড়ির জমিটুকুসহ এখানে অনেকটা জায়গা খগেনদের ছিল। বেশি দিন আগের কথা না, এই ঠাকুরদা বেঁচে থাকতে। খগেনের দূরের স্মৃতিতে কিছু কিছু দৃশ্য এখনো টিকে আছে। সে নিয়ম করে কৃষাণের হেঁসু ধার দেওয়ার মতো করে এই সামান্য স্মৃতিটুকু শান দিয়ে রাখে’’।

মোজাফ্‌ফর হোসেনের গল্পগুলো ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধেও এক জোরালো প্রতিবাদ। তিনি ‘মসজিদ’ শিরোনামের গল্পটিতে দেখিয়েছেন ক্ষমতাবানেরা কীভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারণ নিরীহ জনগণকে শোষণ-নিপীড়ন করে। গল্পগুলোর কোনটির বিষয় এতটাই সম সাময়িক যে, পাঠকের মনে হবে চরিত্রটা একেবারে আশেপাশের কারো, চেনা কেউ অথবা সে নিজেই! ‘বেকারজীবনের অপঠিত গল্পটা’র কয়েক লাইন,

‘‘সাহিত্য সম্পাদক ফোন করে বলেছেন সাত দিনের মধ্যে একটা গল্প দিতে হবে। বিষয়ভিত্তিক গল্প। এবারের বিষয় বেকারত্ব। কোনোরকম ভাবনা চিন্তা ছাড়া বলে দিয়েছি পারব। বেকারত্ব নিয়ে ভাবতে ভাবতে আজ ঠিক পঞ্চম দিনের মাথায় আমার চাকরিটা গেল। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! এখন এই দুদিনে বেকার অবস্থায় আমাকে লিখতে হবে বেকারত্ব নিয়ে। আগেও বেকার আমি হয়েছি; কয়েকবার। এবারও যে খুব সহজে চাকরি হবে এমনটা ভাবছি না। পত্রিকা অফিসগুলো পাল্লা দিয়ে লোক ছাঁটাই করছে। অনলাইনে কপি-পেস্ট করেও আজকাল একটা দৈনিক দিব্যি চালিয়ে নেওয়া যায়। এক সময় বেতন বাড়ানোর জন্য হাউস পরিবর্তন করেছি, আর এখন হাউস পরিবর্তন করা মানেই বেতন কমা। তাও যদি জেনে যায় চাকরি নেই, তাহলে তো আমার কিছু বলার সুযোগই থাকবে না। এক মাস বা দু মাস চাকরি না থাকলেও আমি চালিয়ে নিতে পারব, ততটুকু সঞ্চয় আছে; কিন্তু এর বেশি হলে রুমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হবে’’।

মোজাফ্‌ফর হোসেনের গল্পে এভাবেই তাই বাস্তবতা, জাদুবাস্তববাদ, পরাবাস্তব এবং অধিবাস্তবতা দারুণভাবে একাকার হয়ে যায়। তার গল্পে খুব বেশি বিস্তার থাকে না, থাকে ভাবের ব্যাপকতা। ‘মেন্টাল’ গল্পের একটি অনুচ্ছেদ, ‘‘লোকটি হাঁপাতে হাঁপাতে পেছন থেকে আমার হাতটা চেপে ধরল। চমকে ওঠা খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু আমি এতটাই অন্য মনস্ক ছিলাম যে, পুরো বিষয়টা বুঝে নিতে কিছুটা সময় লাগল। লোকটা আমার হাত তখনো ছাড়ে নি। এত হাঁপাচ্ছেন যেন কিছু বলতে গিয়েও পারছেন না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমার ভয় পাওয়া বা ঘাবড়ে যাওয়া উচিত। আজকাল কতভাবে যে ক্রাইম হচ্ছে তার কি হিসাব আছে। প্রতিনিয়ত অপরাধীরা অপরাধের নতুন নতুন কলাকৌশল বের করে ফেলছে। সেদিনই আমার ছেলে সিনেমা নিয়ে পড়াশুনা করছে, ল্যাপটপ আর মোবাইল হারিয়ে এসে খাওয়ার টেবিলে বলল, মনে হচ্ছে এদেশে লেখক নির্মাতাদের চেয়ে ছিনতাইকারীরা বেশি সৃজনশীল। ভুল মানুষগুলো ভুল জায়গায় চলে গেছে’’। গল্পের ভেতরে এভাবেই অনেক সত্য কথাও গল্পকার বলে গেছেন কৌশলে।

সবশেষে বলব, একটি কাহিনী বা গল্পকে ছোটগল্পে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য যেসব নান্দনিকতা ও শিল্পশর্ত পূরণ করতে হয়, তার সবই পূরণ হয় মোজাফ্‌ফর হোসেনের গল্পে। একুশটি গল্প নিয়ে প্রকাশিত ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’ গল্পগ্রন্থটির সব গল্পই দারুণ এবং দুর্দান্ত। বইটি পড়ার পরামর্শের পাশাপাশি জানিয়ে রাখি এর গল্পের শিরোনামগুলো- একটি খুনের স্বীকারোক্তি, শেষ মাথাটি কাটাপড়ার আগে, স্পাই, মানুষের মাংসের রেস্তোরা, জীবনের গল্প প্রতিযোগিতা, বঙ্গবন্ধুকে চিঠি, যে জীবন ফুটবলের, খুনের সংবাদ ধরাতে, ধর্ষণের প্রতিশোধ, মিসিং পিজ্জা বয়, বাক-স্বাধীনতার এক চরম দৃষ্টান্ত, পুনরুত্থান, করোনা, মৃত্যুর আগে ও পরে, মেন্টাল, বেকারজীবনের অপঠিত গল্পটা, ফের প্রতিযোগিতায় খরগোশ-কচ্ছপ, সিসিফাস হাসে ঈশ্বরের হাসি, বিড়াল পোস্টমর্টেম, গল্প না বা নিছক কল্পনা, যেভাবে লেখা হলো কবি বাবু মণ্ডলের, জীবনবৃত্তান্ত, মসজিদ। গল্পগুলোতে সমকাল লেপ্টে আছে অন্যভাবে, তাই গল্পের বিষয় খুঁজতে গিয়ে পাঠক ধাঁধায় পড়বেন বারবার। ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’য় আপনাকে স্বাগতম, পাঠক!

মোজাফ্‌ফর হোসেনের ‘মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’য় একদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top