করোনাকালে মহামারি মোকাবিলায় দেশের ব্যাংক খাতে দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের ছাড়। কিন্তু তাতেও তেমন কোনো উন্নতি হয়নি দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই খাতের। কিছু ক্ষেত্রে হয়েছে বরং উল্টো সমস্যা। ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়ার কারণে অনেক গ্রাহক ঋণ পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছেন। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসলেও ব্যাংকগুলো নানা কারণে ঋণ আদায়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। ফলে দেশের বেশকিছু ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি বলেছে, করোনার আগে থেকেই বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দুর্বল ছিল। এখন এই খাতে ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২১ সালে ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালের চেয়ে ১৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ছিল ৪৮ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা, যা সমগ্র ব্যাংকখাতের ৪৭ শতাংশ। এর মানে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতিও বেড়েছে। এসব মিলে মূলধন ঘাটতি বেড়ে গেছে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যাংকের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মূলধন রাখতে হবে। এর কম মূলধন থাকলেই তা ঘাটতি হিসাবে গণ্য হবে। সূত্র বলছে, দিনের পর দিন খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের হার বেড়েছে ব্যাংক খাতে। এসব কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতিতে রেকর্ড হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০টি ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি হয়েছে ৩৪ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। এর আগে ১০ ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি ছিল ২৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা।
সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি খাতের ৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংক, বেসরকারি খাতের ৩টি ও বিশেষায়িত ২টি ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি রয়েছে। বিশেষায়িত ও বাণিজ্যিক মিলে সরকারি খাতের ব্যাংক রয়েছে ৭টি। এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণ করতে বাজেট থেকে অর্থের জোগান দেওয়া হয়। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটাতে শেয়ারহোল্ডারদের মাধ্যমে অর্থের জোগান বাড়ানো হয়।
জানা যায়, সরকারি খাতের ৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ৫টিতেই মূলধন ঘাটতি রয়েছে ১৭ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি রয়েছে সরকারি খাতের বিশেষায়িত ব্যাংক বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে। এদের ঘাটতি ১২ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। আর বেসরকারি খাতের ৩টিতে ৩ হাজার ২০৬ কোটি ৪৬ লাখ এবং বিশেষায়িত ২টি ব্যাংকে ১৪ হাজার ৯৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ঘাটতি রয়েছে। ইতোপূর্বে ২০০২-২০০৩ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ২০ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকার মূলধন যোগান দিয়েছিল সরকার। কিন্তু, এরপরও এই উদ্যোগ ব্যাংকগুলো জন্য ইতিবাচক কোনো কিছু বয়ে আনতে পারেনি।
মূলধন ঘাটতি হয়েছে যেসব ব্যাংকের এদের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, অগ্রণী, বেসিক, জনতা, রূপালী ও সোনালী ব্যাংক। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে মূলধন ঘাটতিতে আছে বাংলাদেশ কমার্স, আইসিবি ইসলামিক ও ন্যাশনাল ব্যাংক। অবশ্য ছাড় পাওয়ায় সাবেক ফারমার্স বা পদ্মা ব্যাংক এখন ঘাটতিতে নেই। আর নতুন করে এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে ঝামেলায় পড়া ন্যাশনাল ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্যমতে, মূলধন ঘাটতিতে থাকা ১০ ব্যাংকের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১২ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি ৩ হাজার ৮৭৭ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ৫২৯ কোটি, জনতা ব্যাংকের ৪ হাজার ২৫৬ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৩ হাজার ৩৭ কোটি ও সোনালী ব্যাংকের ৩ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে গত বছরের শেষে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ১ হাজার ৬৬১ কোটি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের ৪৫৭ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো বিভিন্ন আর্থিক কেলেঙ্কারির পর এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ব্যাংকগুলো থেকে যে পরিমাণ টাকা লোপাট হয়েছে, সরকার সেই পরিমাণ মূলধন জোগান দেয়নি। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে তারা মূলধন ঘাটতিতে আছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের সংকট বাড়িয়েছে হলমার্ক গ্রুপ, জনতা ব্যাংকের অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ ও রূপালী ব্যাংকের মাদার ও মাদারীপুর গ্রুপ। বেসিক ব্যাংকের সংকটে পড়েছে সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাইয়ের কল্যাণে। আর অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি হয়েছে চট্টগ্রামের কয়েকটি গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকটি লোকসানের কারণে শেয়ারবাজারে যেতে পারছে না। শেয়ারহোল্ডাররাও অর্থের জোগান দিচ্ছেন না। সরকারের যে শেয়ার আছে তার বিপরীতেও মূলধনের জোগান দেওয়া হচ্ছে না। ফলে এর মূলধন ঘাটতিও পূরণ হচ্ছে না। আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকটি আর্থিক সংকটে পড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একে পুনর্গঠন করে মালয়েশিয়াভিত্তিক একটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয়। মামলার কারণে কোম্পানিটি মূলধনের জোগান বাড়াতে পারছে না। ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি হয়েছে ব্যাংকটির কয়েকজন পরিচালকের বেনামে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার কারণে।
জানা কথা, ব্যাংকের মাধ্যমেই সরকারি-বেসরকারি খাতের উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালিত হয়। আর উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিত করা। এই ধরনের তহবিল পর্যাপ্ততার নিশ্চয়তা দেয় একটি শক্তিশালী ব্যাংকখাত। কিন্তু মূলধন সংকট বলছে, আমাদের ব্যাংকখাত যথেষ্ট দুর্বল, যা পর্যাপ্ত তহবিল সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয় না। আর দক্ষিণ এশিয়ার যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির তুলনা করা হয়, তাদের চেয়ে এখানকার ব্যাংকখাতের মূলধনের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ২০২০ সালে পাকিস্তানের ব্যাংকগুলোতে মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত ছিল ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ভারতে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ। আর বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে ওই সময় এই অনুপাত ছিল ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত বা অন্যান্য দুর্বল বেসরকারি ব্যাংকগুলো ধারাবাহিকভাবে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণ হচ্ছে দুর্নীতি। অনিয়মের মাধ্যমে এসব ব্যাংক থেকে ঋণের নামে বের করে ফেলা হয়েছে বড় অঙ্কের টাকা। দুর্নীতি মোকাবিলার পাশাপাশি করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশের মূলধন সংকটে থাকা ব্যাংক মুক্তি পেতে পারে বর্তমান সমস্যা থেকে।
সাম্প্রতিক দেশকাল, ৭ এপ্রিল ২০২২