মুজিব কোটের গল্প

হাসান হামিদ

শুরু করবো একটি ঘটনা দিয়ে ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক ছাত্র একবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা দিতে গিয়েছিলেন । তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে অনেক কাছ থেকে দেখলেন, কথাও বললেন দীর্ঘক্ষণ । কথা শেষে ওঠে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যখন তার কালো কোটটি গায়ে জড়াচ্ছিলেন, তখন ওই ছাত্র লক্ষ্য করলেন কোটে ৬টি বোতাম রয়েছে; যা এ ধরনের অন্য কোটের বোতামের চেয়ে কম । এসময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কোটের বোতাম ৬টি কেন? উত্তরে বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এমন প্রশ্ন এর আগে আমাকে আর কেউ করেনি । তুই প্রথম । এই ৬টি বোতাম আমার ঘোষিত ৬ দফার প্রতীক।’

বঙ্গবন্ধু ঠিক কত সাল থেকে কালো কোট পরা শুরু করেছিলেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা পাওয়া যায়নি । তবে মওলানা ভাসানী এবং শামসুল হক যখন আওয়ামী মুসলীম লীগ করলেন তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মোস্তাক আহমদ সংগঠনটির যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন । তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুকে এই কোট পড়তে দেখা যায়। তবে এই কোটটির প্রচলন ‘নেহেরু কোট’ থেকে। ভারত উপমহাদেশ স্বাধীনের সময় জওহরলাল নেহেরুর (স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী) বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে এই নেহেরু কোটের প্রচলন শুরু হয়। পরে সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধু এই কোটটি পড়তেন বলেই এর নাম দেয়া হয় ‘মুজিব কোট’। বঙ্গবন্ধুর স্বভাবতই তার পছন্দের সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবির মতই কোটটি ব্যবহার করতেন ।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আগরতলা মামলার পর জেল থেকে যখন দেশে আসেন বঙ্গবন্ধু তারপরই নিয়মিত এই কালো কোট পরতে থাকেন । পরবর্তী সময়ে তার অনুসারী ও সহযোদ্ধারা এই কোট পরতে শুরু করেন । এক জনপ্রিয় রাজনৈতিক দেশীয় ফ্যাশন আমাদের সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়। তখন এই মুজিব কোট শুধুমাত্র একটি ফ্যাশন হিসেবে নয়, বরং রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রতীক হিসেবেও বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মাঝেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই ‘মুজিব কোট’। 

রাজনৈতিক মতাদর্শের মিল না থাকলেও বিশ্বে যেসব রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিত্ব ও তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ আজও আমাদের মনের ভেতরে গেঁথে আছে তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর পোশাক অন্যতম। পায়জামা-পাঞ্জাবির সাথে কালো কোট, মোটা ফ্রেমের চশমা হাতে বাঁ ঠেঁটে পাইপ—এমন ব্যক্তিত্ব বিশ্ব রাজনীতিতে বিরল। যেমন জহরলাল নেহেরুর ক্যাপ, লম্বা কোট ও বুক পকেটে গোলাপফুল, মহাত্মা গান্ধীর খাদি কাপড়ের ধূতি ও চাদর, চেগুয়েভারার মিলিটারি কোট ও ক্যাপের স্টাইল আজও ‘ফ্যাশন আইকন’ হিসেবে আমাদের মনের মধ্যে রয়ে গেছে । ৫০০ বছরে মোগল, পাঠান, ইংরেজ—কারও পোশাকের প্রভাব এই বাংলায় স্থায়ী হতে পারেনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পোশাকে অর্থাত্ মুজিব কোটে পরবর্তী প্রজন্মও আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেয়েছে। গায়ে খাদি জড়িয়ে গান্ধী যেমন একটি রাজনৈতিক আন্দোলন দাঁড় করিয়েছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধু মুজিব কোট পরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে নতুন এক বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিলেন।  হাতাবিহীন কালো কোট, হাইনেক, নিচে দুটি পকেট—এই পোশাক পরেই বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছেন, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে সাক্ষাত্ করেছেন সর্বোপরি নিজেকে বাঙালির ফ্যাশন আইকন হিসেবে বিশ্বের দরবারে হাজির করেছেন ।

আন্দোলন করে তিনি নিজেকে যেমন গণতান্ত্রিক নেতা রূপে গড়ে তুলেছিলেন, তেমনি তিনি  পোশাক-পরিচ্ছদ এনেছিলেন নতুন ধারা । নিজের দেশের মানুষের কৃষ্টি কালচার ও পোশাক-আশাক নিয়ে বঙ্গবন্ধু আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। এরই প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর হোটেল পূর্বাণীতে দেওয়া তার এক বক্তৃতায়, বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না বলেই বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ হয়নি। যে সংস্কৃতির সাথে দেশের মাটি ও মনের সম্পর্ক নেই তা বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। বঙ্গবন্ধু উপমহাদেশের একমাত্র নেতা যিনি নিজের দেশের মাটি ও মানুষের সাথে মিশে কৃষ্টি ও কালচারকে এমন দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছিলেন। তার মতো স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের এমন রাজনৈতিক নেতা বিশ্বে দুর্লভ।

দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায় ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট একটি খবর ছাপা হয়েছিলো । সেখানে বলা হয়, আটাত্তর বছর বয়সের মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মুজিব কোট

গায়ে দিয়ে পার করে দিয়েছেন টানা ৫০ বছর। ঈদের পোশাকের সঙ্গেও তিনি মুজিব কোট পরেন। বঙ্গবন্ধুর কক্সবাজার আগমন উপলক্ষে ১৯৬৪ সালে প্রথম মুজিব কোট তিনি সেলাই করেছিলেন। সেই মুজিব কোট গায়ে দিয়ে যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মঞ্চে উঠলেন তখন বঙ্গবন্ধু নাকি মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘তোকে বেশ মানিয়েছে, সব সময় পরবি’ । সেই থেকে দীর্ঘ ৫০ বছর মুজিব কোট আর ছাড়া হয়নি। আপাদমস্তক আওয়ামী লীগার নুরুল ইসলাম বললেন,  ‘মৃত্যুর সময়ও যাতে এটি আমার গায়ে থাকে-এটাই আমার কাম্য’!

প্রকাশিত পত্রিকা-

দৈনিক  ইত্তেফাক  ০৫/০৮/২০১৭

দৈনিক যুগান্তর  ১৪/০৮/২০১৭

(লেখাটির একাংশ  ই-মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভে সংরক্ষণ করা হয়েছে)

মুজিব কোটের গল্প
Scroll to top