হাসান হামিদ
কয়েক দিন আগে খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের লেখা ভাসানী যখন ইউরোপে নামে একটি বই পড়ছিলাম। সেটির প্রেক্ষাপট ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট থাকায়, আমি এ নিয়ে আরও কিছু লেখা পড়ি। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ৯ নম্বর দফাটিতে বলা হয়েছিল, শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতন দেয়া হবে। অথচ সেই দাবি কখনোই আমলে নেয়া হয়নি, এমনকি ২০১৯ সালে এসেও। আর কম বেতন দেবার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছেলেমেয়েগুলো শিক্ষকতা পেশায় আসে না। মেধাবী শিক্ষার্থীরা অন্যের টাকার হিসাব রাখতে ব্যাংকের চাকরিতে যায়; তবু শিক্ষকতার মহান পথে তাদের পা পড়ে না। আর ভুলে এই পেশায় আসাদের নিয়ে সমাজকে আফসোস করতে যখন দেখি, তখন কেমন যেন কষ্ট লাগে। আমি এখনও অনেক তরুণকে বলতে শুনি, এরা আমার বন্ধু বা ভাই; যারা শিক্ষতায় আছেন, তারা বলেন, ‘আছি আর চেষ্টা করছি; ভালো কিছু হলে চলে যাবো’। সেই ভালো কিছুটা অন্য যে কোনো কিছু হলেও শিক্ষকতা অন্তত নয়। আমি মনে করতাম, এরচে ভালো আর কী সন্ধান করে সবাই। আজ শিক্ষকদের ওপর লাঠিচার্জ হলো, অনেকেই চুপ। এখন মনে হচ্ছে, এরা ঠিকই করেছে। আর যাই হোক, পুলিশের মার তো খেতে হয়নি! অথচ আজ যারা বড় চেয়ারগুলোতে সরকারি সেবা দেবেন বলে বসেছেন, তারা কিন্তু কারো না কারো ছাত্র। শিক্ষামন্ত্রী এ নিয়ে বিবৃতি দেবেন বলে আমরা আশা করি।
খবরে দেখলাম, বেতন বৈষম্য নিরসন তথা সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে এবং প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডে বেতন বাস্তবায়নের দাবিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের মহাসমাবেশে পুলিশের বাধা ও লাঠিচার্জের প্রতিবাদে আজ মুখে কালো কাপড় বেঁধে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান করেছেন শিক্ষকরা। কী হয়েছিল তাদের সাথে? গত ২৩ অক্টোবর রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিক্ষকদের মহাসমাবেশ করতে দেয়নি পুলিশ। তাই আগামী ১৩ নভেম্বরের মধ্যে বেতন বৈষম্য নিরসনের দাবি না মানলে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বর্জনসহ লাগাতার কর্মবিরতিতে যাওয়া ঘোষণা দিয়েছেন আমাদের শিক্ষকরা। এটাই তাদের অপরাধ। আর এ ভয়াবহ অন্যায়ের জন্য রাষ্ট্রের পুলিশ, যারা আমাদের স্বস্তি ও নিরাপত্তা দেবেন বলে শপথ নিয়েছে, তারা সম্মানিত শিক্ষকদের লাঠিপেটা করেছে।
চীনা প্রবাদে আছে, If you are planning for a year, sow rice; if you are planning for a decade, plant trees; if you are planning for a lifetime, educate people. শিক্ষক শব্দটার মধ্যে অমিত শক্তি ও মর্যাদা লুকিয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে আপনি যদি ভাবেন, কোন পেশার মানুষগুলো একটি দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? হেনরিএডামস-এর একটি কথা আপনার মনে আসবে। তিনি বলেছেন, একজন শিক্ষক সামগ্রিকভাবে প্রভাব ফেলেন, কেউ বলতে পারে না তাঁর প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হয়। বাট্রাণ্ড রাসেল আরো এক পা এগিয়ে এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, মানুষের সুখী হওয়ার জন্যে সবচেয়ে বেশি দরকার বুদ্ধির এবং শিক্ষার মাধ্যমে এর বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব। আর সেই কাজটি করেন একজন শিক্ষক।
আমি বাজি ধরে বলতে পারি; একজন শিক্ষক যেভাবে শেখাবেন, যতটুকু স্বপ্ন রচনায় উৎসাহিত করতে পারবেন আমাদের প্রজন্মকে, ততোটা কেউ পারবেন না; আর সেকারণেই তারা মানুষ গড়ার কারিগর। আমাদের দেশ ডিজিটাল হয়। পাল্টে যায় অর্থনীতির সূচক। সেই সাথে দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে আমাদের চাওয়া-পাওয়া। শিক্ষার আলো সময়ের প্রয়োজনেই প্রতিটি মানুষের দ্বারে দ্বারে। শুধু পাল্টায় না শিক্ষকদের জীবনমান। বেতনস্কেলে তাদের জন্য থাকে না সম্মানিত কোনো স্কেল। শিক্ষক নীতিমান হবেন, আদর্শকে ধারণ করবেন; জ্ঞানে, প্রজ্ঞায় অন্যদের চেয়ে একধাপ এগিয়ে থাকবেন, সেইসঙ্গে দারিদ্র্যের দায়ও বহন করবেন, এটাই যেনো এদেশের সবার ধারণা। ফলে স্বাধীনতার এতগুলো বছর পার হওয়ার পরযখন বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ দেশে পাল্টে গেছে অনেক চিত্র, তখন সনাতন চিত্র ধারণ করে ঠায় দাঁড়িয়ে শিক্ষকতা পেশা। কিন্তু কেনো?
উপরের প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার আগে আমরা তাকাবো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে। কি দেখতে পাচ্ছি? সেখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন আমাদের দেশের শিক্ষকদের চারগুণ। আমাদের দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের চেয়ে একটি ‘এ’ ক্যাটাগরির সংবাদপত্রের পিয়ন বা দারোয়ানের বেতন বেশি। এ নিয়ে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুনতাসীর মামুন স্যার একবার বলেছিলেন, “একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের বেতন কেন একজন দারোয়ানের মতো হবে? কেন তাঁদের সঙ্গে আপনারা পিয়নেরমতো আচরণ করবেন? যদি তাঁদের সঙ্গে দারোয়ানের মতো আচরণ করেন, আপনার ছেলেমেয়েদেরও দারোয়ানের মনোবৃত্তি হবে।” কয়েকদিন আগে একটি স্কুলের নিয়োগ পরীক্ষায় অন্য সবার চেয়ে, এমনকি নাইটগার্ডের চেয়ে শিক্ষকদের বেতন কম দেখেছি।
আমাদের এদেশে বারবার শিক্ষানীতিতে পরিবর্তন আসে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়, শিক্ষার প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি আর চাহিদার পরিবর্তন আসে, তাহলে যুগ যুগ ধরে শিক্ষাগুরুরা অবহেলিত কেন থাকেন আমি বুঝি না। অনেকেই বলবেন, বেতন তো অনেক বেড়েছে। আর প্রাইমারিতে এখনো অনেক এসএসসি পাশ হেনতেন শিক্ষকরা আছে। তাদের বলি, যদি আপনি এটা নিয়ে বসে থাকেন, তাহলে আরও ৫০ বছর পরও কিন্তু আপনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা সেরা ছেলেমেয়েকে এই পেশায় পাবেন না। এটি আরও অনেক আগেই করা দরকার ছিল। দেরি হয়ে গেছে। এখন কি আরও দেরি করতে চায় সরকার? কেউ কেউ বলেন, শিক্ষকরা স্কুলে না পড়িয়ে কোচিং এ ঝুঁকে পড়েছেন। কিন্তু কেন সেটা তারা করছেন? বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে শিক্ষক যখন রাষ্ট্রীয় আর সামাজিকভাবে দিনের পর দিন অবহেলার শিকার হয়েছেন, তখনই কিন্তু তিনি খুঁজেছেন বিকল্প পথ। করেছেন কোচিং বা ব্যাচ পড়াচ্ছেন বাসায়।
গুরু দ্রোণের মতো রাষ্ট্রীয় অপক্ষমতার কাছে যুগে যুগে শিক্ষককে নীরবতা পালন করতে হয়েছে। কিন্তু শুধু আদর্শকে ধারণ করে জীবনের সব ভোগ-বিলাস থেকে মুখ ফিরিয়ে জ্ঞানের আলো বিতরণের কাল এখন আর নেই। শিক্ষকের সংসার-সন্তান আছে। গতিময় সমাজে সে স্বপ্ন দেখে উন্নত সম্মানিত এক জীবনের। সমাজের ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। আর্থিক মাপকাঠিতে মূল্যায়িত হয় মানুষ। সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে চলার মতো সংস্থান এবং উন্নয়ন মানসম্মত এক জীবনের স্বপ্নই পারে একজন মানুষকে শিক্ষকতা পেশায় আসার অনুপ্রেরণা দিতে। যুগের পর যুগ আর্থিক অবহেলা এবং অর্থনৈতিক দৈন্যের কারণে সামাজিক অবমূল্যায়ন শিক্ষকদের বিকল্প পথ খুঁজে নিতে বাধ্য করেছে।
এবার একটু অতীতের কথা বলি। ১৯৭৩ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারের পক্ষ থেকে বেতন-ভাতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে নানা ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংকট থাকলেও তিনি এমন সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা শিক্ষকদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও সারা দেশে নানা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট সত্ত্বেও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানী এবং শিক্ষকদের সম্মানী বাড়িয়ে তাদের জীবনমান উন্নত করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। তার এ ধরনের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষকদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থার অবসানে যথেষ্ট নয়।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বহুবার শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্রবেতন কাঠামো প্রণয়ন ও উচ্চ বেতন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে। ‘সংকট মোচন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আওয়ামী লীগের রূপকল্প ২০২১ সাল কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই’ শীর্ষক প্রবন্ধে ‘শিক্ষা’ উপ-শিরোনামেও বিষয়টি বলা হয়েছে। প্রবন্ধটিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে যে: ‘‘২০১৪ সালে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণ দূর, শিক্ষার মানোন্নয়ণে, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা এবং শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।’’ [ভিশন ২০২১, ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ঢাকা: ২০০৯,পৃ. ৫১] ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ও জাতীয় শিক্ষানীতিতেও ওই ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতেও বলা হয়েছে: “আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সকল স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে।” [পৃ.৫৮]
এইসব প্রতিশ্রুতির সঙ্গে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর ‘অস্ত্র নয় শিক্ষায় বিনিয়োগ করার’ আহবান শিক্ষকদের আশান্বিত করেছিল যে, অচিরেই হয়তো তাদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারও জাতীয় শিক্ষানীতিতে থাকা সত্ত্বেও, পে-কমিশনের ‘স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করা যাবে না’ মর্মে সুপারিশ সকল স্তরের শিক্ষকদের হতাশ করেছিল। আর এবার তো শিক্ষকদের রীতিমতো লাঠিপেটা করা হলো। বর্তমানে যে আন্দোলন হচ্ছে তার মূল জায়গা হলো সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের জন্য দশম গ্রেড এবং সহকারী শিক্ষকদের জন্য ১১তম গ্রেডের ঘোষণা ২০১৭ সালে দেওয়া হয়েছিল। এখন পর্যন্ত সেই ঘোষণা বাস্তবায়ন না হওয়ায় সারা দেশ থেকে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকেরা ঢাকায় সমবেত হয়েছেন মহাসমাবেশ করার জন্য।
বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল হবে। কিন্তু আজো সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। বরং আমরা দেখেছি, আন্দোলনরত শিক্ষকদের ভাগ্যে জুটেছে মরিচের গুঁড়া অথবা লাঠিপেটা। আমাদের দেশের প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার প্রতিটি ধাপকে বিন্যস্ত করে সাজাতে হবে এবং সংস্কার করতে হবে। ‘থিওরি অ্যান্ড প্রবলেম’ নামের বইটির অন্যতম লেখক ক্রিস্টোফার জে ব্রডলির মৃত্যুর পর জানা যায়, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি শেষ ১০ বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, সুইজারল্যান্ডে শিক্ষকরা সর্বোচ্চ বেতন পান, আর সেটা ৬৮ হাজার ডলার। ওই দেশে এর পরের সর্বোচ্চ বেতন ৫০ হাজার ডলার। আমেরিকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নিযুক্ত হন বার্ষিক ৩৭ হাজার ৫৯৫ ডলার বেতনে। ১৫ বছর চাকরি করার পর ওই শিক্ষকের বেতন হয় ৪৬ হাজার ১৩০ ডলার।
আমি স্বীকার করছি, বাংলাদেশ আমেরিকা বা সুইজারল্যান্ড নয়। উন্নত দেশের মতো বেতন দেয়া এ দেশে সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশের পাশে আছে পশ্চিমবঙ্গ, কথায় কথায় যাদের উদাহরণ আমরা দেখাই। বাংলাদেশে একজন শিক্ষকের বেতন আর পশ্চিমবঙ্গের একজন শিক্ষকের বেতনের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। আসলে ব্রিটিশরা এদেশের শিক্ষকদের ললাটে অসম্মানজনক বেতনের যে অপমান লেপন করেছিল আজো তার অবসান হয়নি। সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত পাদটীকা গল্পে পণ্ডিতমশাই তার ছাত্রদের যে গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে দিয়েছিলেন আজো সে ছাত্ররা তার সমাধান দিতে পারেনি। পণ্ডিতমশাইয়ের ছাত্ররা মন্ত্রী হন, অর্থমন্ত্রীহন, দেশের কর্ণধার হন কিন্তু পণ্ডিতমশাইয়ের গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে পারেন না।
মনে রাখতে হবে, সমাজের সব পেশাই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। কিন্তু শিক্ষকতাকে সব পেশার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে হবে না। উন্নত দেশের শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সেসব দেশের শিক্ষকের সামাজিক অবস্থান এবং অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকেও আমাদের অনুসরণ করতে হবে। শিক্ষাকে আধুনিক রূপ দেয়ার আগে শিক্ষককে আধুনিক এবং যুগোপযোগী করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাহাতে নিতে হবে। নিয়োগ শিক্ষাগত যোগ্যতা, আচরণবিধি, বেতন স্কেল, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সবকিছু সমাজের অন্যান্য পেশাজীবীর থেকে আলাদা করতে হবে। সমাজকে যেমন বুঝতে হবে মানুষ তৈরির জন্য শিক্ষকের অবস্থান অন্যদের চেয়ে আলাদা, তেমনি শিক্ষকের নিজেরও তার অবস্থান এবং মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
দেশ ও জাতির প্রয়োজনেইদেশের সবচেয়ে মেধাবী তরুণ-তরুণীদের জন্য খোলা রাখতে হবে ‘শিক্ষকতা’ পেশার দ্বার। ঈর্ষণীয় বেতন স্কেল, উন্নত জীবনমান এবং মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থানই পারে মেধাবীদের এ মহানপেশায় আকৃষ্ট করতে। আর আমরা তো এটা সবাই জানি, শিক্ষার মানের ওপর শুধু একজন শিক্ষার্থীর নয়;একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের টিচার পেই অ্যারাউনড দ্য ওর্য়াল্ড প্রবন্ধে বলা হয়েছে : আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থা আজকের শিক্ষার্থীকে আগামী দিনের অর্থনীতির জন্য প্রস্তুত করে। একজন মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা প্রদান করতেপারে। আর মেধাবী শিক্ষার্থীরা তখনই শিক্ষকতায় আসবে, বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আগ্রহী হবে; যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচ্চপর্যায়ের সম্মান ও সম্মানী প্রদান করা হবে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো এ বিষয়টি বহু আগে উপলব্ধি করেছে বলেই তাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের থেকে বহু এগিয়ে রয়েছে।
এটাই সত্য যে, সামাজিক দায়িত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও জাতীয়ভাবে শিক্ষকদের তেমন সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় না। দেশে অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র মনোযোগী হলেও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে বেশ অবহেলা আর উদাসীনতার পরিচয় দেয়। যুগের পর যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু শিক্ষকদের নির্মম ভাগ্য আজও বদলায়নি। শিক্ষাদানের পাশাপাশি আদমশুমারি, ভোটার তালিকাভুক্তি, টিকাদান, শিশু জরিপ, উপবৃত্তি বিতরণ, স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রমে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষকরা দেশ বিনির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রাখার পরও শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের নজরে দেখা হয়। শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব, এ দুর্মূল্যের বাজারে বেতন-ভাতার অপ্রতুলতা, শিক্ষাকে রাজনীতিকরণ এবং বাণিজ্যিকীকরণের উদ্ভট মানসিকতা, শিক্ষকদের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সীমাহীন ঔদাসীন্য ও অবহেলাই যেন এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বহুলাংশে দায়ী। বলতে লজ্জা হয়, দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত ও শারীরিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার খবর আমি অনেক সময় পত্রিকায় পড়ি। এটা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও অমানবিক কাজ।
শেষ কথা হলো, শিক্ষকরা পাঠদানে আরও বেশি করে মনোযোগী তখনই হবেন, যখন তাদের আর্থিক দুর্দশা থাকবে না। এটা কেউ চাইবে না যে, শিক্ষা খাতে অদক্ষদের লালন-পালন করা হোক। সেরাদেরই আনতে হবে শিক্ষক হিসেবে। সমাজের অন্য সব ক্ষেত্রেও এটাই কাম্য। আর তার জোগান আসতে পারে কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেরা হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে। সহজ কথায় বলা যায়, শিক্ষাকে যুগোপযোগী এবং মানসম্মত করার জন্য, মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, সর্বোপরি সত্য কথা বলার মানুষ সৃষ্টির জন্য শিক্ষার আগে শিক্ষকের কথা ভাবতে হবে। শিক্ষকতা পেশায় দেশের সবচেয়ে মেধাবী এবং মননশীলদের সম্পৃক্ত করার জন্য এই পেশার মর্যাদা এবং বেতন স্কেল বাড়াতেহবে। আমাদের বর্তমান শিক্ষকরা যেটা চেয়েছেন, সেটা অনেক কম। তাদের দাবি মেনে নিন, ক্রিকেটারদের আন্দোলন করাই আগেই সব মেনে নেয়া যায়; আর তাদের চেয়ে অনেক উপরে থাকা শিক্ষকদের দাবি করার জন্য লাঠিচার্জ করা হয়; এ লজ্জা আমরা রাখবো কোথায়?
প্রকাশিত পত্রিকা- দেশবার্তা, ২৬ অক্টোবর, ২০১৯