মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষানবিস আইনজীবীদের আর্তনাদ কি শুনতে পাচ্ছেন?

হাসান হামিদ

শিক্ষানবিস মানে নবীন; আনাড়ি; নবব্রতী। আর আইনজীবী হলেন ‘আইন ব্যবসায়ী’; যিনি একজন এ্যাডভোকেট, ব্যারিস্টার, এটর্নি, সলিসিটর বা আইনি উপদেশক। আইনজীবী মূলত আইনের তাত্ত্বিক বিষয়গুলির বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তির বা সংস্থার আইনি সমস্যার সমাধানের কাজ করে থাকেন। বিভিন্ন দেশ তাদের নিজ নিজ আইনী ব্যবস্থা অনুযায়ী আইনজীবীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকে। আর আমাদের দেশে শিক্ষানবিস আইনজীবীদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই দেখলে মনে হবে, যেন তারা অপরাধ করেছে। এমন হলে এদেশে কেউ আর আইনজীবী হতে চাইবেন না। একটা সময় আসবে, আদালত থাকবে কিন্তু আইনজীবী পাওয়া যাবে না।

আমরা জানি, বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আইনের শিক্ষার্থী ছিলেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতিসহ দেশসেবায় নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তিই এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বা আছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মোক্তারদের অ্যাডোভোকেট হিসেবে উন্নীত করেছিলেন। এই ব্যাপারটি এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। আর বঙ্গবন্ধুকন্যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাজার হাজার শিক্ষানবিসের সমস্যার সমাধান করলে তিনিও ইতিহাসে নজির হয়ে থাকবেন।

আমাদের দেশে এখন আইনজীবি হতে গেলে দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order–1972 এর ২৭ অনুচ্ছেদের ১ উপঅনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের ওপর স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করতে হয়। এরপর তাকে একজন আইনজীবীর সাথে ছয় মাস শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে হবে। এই শিক্ষানবিশ কাল পার হবার পর বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের শর্ত অনুযায়ী এনরোলমেন্ট ফরম পূরন করে অংশ নিতে হবে এমসিকিউ পরীক্ষায়। এই এমসিকিউ পরীক্ষাতে পাশ করলে মিলবে লিখিত পরীক্ষার টিকিট। আর লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে ভাইভা। এরপর ভাইভা পাশ করলে তিনি সনদ অর্জন করেন। সনদ অর্জনের পর বাংলাদেশের যেকোন আদালতে আইনপেশা পরিচালনা করা যায়।

খোঁজ নিয়ে জেনেছি, বার কাউন্সিল আইন অনুযায়ী ছয় মাস পরপর পরীক্ষা গ্রহণ করার কথা। অথচ অজানা কারণে ২০১৭ সালের পর থেকে আর কোনো লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়নি। এ অবস্থায় মানবিক দিক বিবেচনায় আমাদের গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সনদ প্রদান নতুবা অবিলম্বে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিনের সৃষ্ট সমস্যার সুরাহা করা উচিত। তাছাড়া The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order,1972-এর ২৭(১)(ডি) অনুচ্ছেদমাফিক প্রাথমিক ধাপে উত্তীর্ণ ২০১৭ ও ২০২০ সালের শিক্ষানবিসদের, আদেশ ৪০(১) ও ৪০(২)(এম) অনুযায়ী গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা সনদ প্রদান করতে আইনি কোনো বাধা-নিষেধ নেই। অর্ডার ৪০(১)-এ বলা হয়েছে, ‘The Bar Council may, with the prior approval of the Government by notification in the official Gayette, make rules to carry out the purposes of this Order । Article ৪০(২)(এম)-এ বলা হয়েছে, ‘the examination to pass for admission as an advocate’। অতএব এটি বার কাউন্সিলের সংরক্ষিত ক্ষমতা। শুধু প্রণীত বিধিতে আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে। এটি আইন মন্ত্রণালয়ের রুটিন ওয়ার্ক। বার কাউন্সিল এ মর্মে রেজুলেশন গ্রহণ করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেবে, মন্ত্রণালয় সেটির অনুমোদন দেবে, এটিই আইনের বিধান। এক্ষেত্রে কাউন্সিল তার প্রণীত বিধির ৬০(৩)-এর যে কোনো জায়গায় সাপ্লিমেন্টারি আইন সংযুক্ত করলে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের আইনজীবী হতে কোনো আইনি বাধা থাকবে না।

শিক্ষানবিস আইনজীবীরা কোনো চাকরি চায় না। তারা মূলত চায় একটি সনদ, একটু সম্মান; যা তাদের প্রাপ্য। এবার একটি পরিসংখ্যান দেখি। ২০১৮ সালের মে মাসে বার কাউন্সিলের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃক প্রকাশিত ভোটার তালিকা অনুসারে আইনজীবীর সংখ্যা ৪৩ হাজার ৮ শত ৮৪ জন। ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বরে ৭ হাজার ৭ শত ৩২ জন আইনজীবী তালিকাভুক্ত হয়। মোট আইনজীবীর সংখ্যা ৫১ হাজার ৬ শত ১৬ জন। এর মধ্যে অনেক বিজ্ঞ আইনজীবী মৃত্যুবরণ করেছেন। বিশাল জনসংখ্যার এদেশে আইনজীবীর এ সংখ্যা অপ্রতুল বলা যায়।

গত সপ্তাহে কাগজে দেখলাম, প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণ শিক্ষানবিস আইনজীবীদের লিখিত পরীক্ষা মওকুফ করে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা যাচাই করে অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্তির বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে দেখা করেছেন অনশনরত শিক্ষানবিস আইনজীবীরা।  ১৪ অক্টোবর রাতে আইনমন্ত্রীর বনানীর বাসায় প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষানবিস আইনজীবী উপস্থিত হন এবং তাদের প্রতিনিধিরা দেখা করেন।  এ সময় মন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেন। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, শিক্ষানবিস আইনজীবীদের আন্দোলনের ১০০তম দিনে ১২ অক্টোবর থেকে রাজধানীর প্রেসক্লাবের সামনে তিন দিনের আমরণ অনশনে বসেন তারা।

শিক্ষানবিস আইনজীবীদের দাবিটি যৌক্তিক। বিগত চার বছর ধরে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেট তালিকাভুক্তির পরীক্ষা না হওয়ায় তারা চরম হতাশাগ্রস্ত এবং মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণদের মধ্যে ইতোমধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ জন নানা কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন। এছাড়া বর্তমানে প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষানবিস আইনজীবী করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। করোনা মহামারীর সংকট চলছে। তাদের সংকট আরও বড়। তাদের দাবি, ৯০ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১২ হাজার ৮৭৮ জন প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাদেরকে পরিস্থিতি বিবেচনা করে লিখিত পরীক্ষা থেকে অব্যাহতি দিয়ে ভাইভা পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা যাচাই করে অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্তির সবিনয় আবেদন তাদের।

সুনামধন্য আইন পেশাকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু এই পেশার শিক্ষানবিশরা কতোটা অবহেলিত, উপেক্ষিত তা ভোক্তভোগী ছাড়া কেউ জানেন না। শিক্ষানবিশ কালে সিনিয়র আইনজীবীরা একজন শিক্ষানবিসকেদিয়ে মুহুরী পিয়ন থেকে শুরু করে চা আনার বয় পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেন। সকাল থেকে শুরু করে রাত দশটা পর্যন্ত বিরতিহীন ভাবে কাজ করতে হয় শিক্ষানবিসদের। কিন্তু দিনশেষে কখনো একশ টাকা, কখনো দুইশ টাকা জুটে। অথচ বর্তমান বাজারে একজন শ্রমিক সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কাজ করেও চারশ টাকা মজুরি পায়।

কেউ কি একবার ভেবেছেন, শিক্ষানবিশ আইনজীবীদেরও পরিবার আছে। স্ত্রী, স্বামী, সন্তান, বাব-মা আছে। পরিবারের কর্তা ব্যক্তি হওয়ার বয়সে শুধুমাত্র আইনজীবী হতে চাওয়ার অপরাধে সে বোঝা হয়ে গেছে। এভাবে আর কতোদিন থাকতে হবে শিক্ষানবিসদের? কেউ কি জবাব দেবেন?

বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে সব বন্ধ। এজন্য বার কাউন্সিলে প্রাথমিক ধাপে উত্তীর্ণ ১২,৫০০ শিক্ষানবিসের তিন বছরের অপেক্ষার দরজায় তালা। আর এদিকে প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষার্থী এমসিকিউ পরীক্ষার প্রতীক্ষায় ব্যাকুল। আবার প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মানবিক বিবেচনায় শিক্ষানবিস সনদ প্রদানের দাবি তো আছেই। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে শিক্ষানবিস আইনজীবীদের এ সংকট থেকে রক্ষার জন্য সবাই এখন প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি এ জাতির আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রতি রাত নির্ঘুম কাটানো শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের আর্তনাদ কি শুনতে পান?

প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক মানবকণ্ঠ, ৩ অক্টোবর ২০২০

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষানবিস আইনজীবীদের আর্তনাদ কি শুনতে পাচ্ছেন?
Scroll to top