হাসান হামিদ
টি এস এলিয়ট ইংরেজি ভাষার একজন প্রতিভাশালী কবি, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক। তিনি একবার অক্সফোর্ডে দেওয়া এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “Oxford is very pretty, but I don’t like to be dead.” গত কয়েক দিন ধরে আমি জ্বরে ভুগছি। অসুস্থ হলে জীবন সম্পর্কে এমন অনেক কিছুই সামনে আসে, যা সুস্থ অবস্থায় আসে না। আমাদের জীবন অত্যন্ত ছোট ও সামান্য। অথচ এই সামান্য জীবন নিয়ে আমাদের কত পরিকল্পনা। নানা কিছু নিজের মতো করে পেতে, আমরা অনেক সময় স্বাভাবিক ভাবনার বাইরে চলে আসি। একটি জেলায় প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হতে যাচ্ছে, আর সেটি সদর থেকে সরিয়ে করার চিন্তাটিও অদ্ভুত এবং অস্বাভাবিক।
আজকে খবরের কাগজে পড়লাম, সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সদরে না হয়ে শান্তিগঞ্জে হতে যাচ্ছে। আর সুনামগঞ্জ সদরে প্রতিষ্ঠা করতে এ নিয়ে মানববন্ধন করতে হচ্ছে। কিন্তু সুস্থ ও সাধারণ চিন্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কোনো একটি প্রতিষ্ঠান জেলা সদর বা পৌর এলাকায় হবে এটিই স্বাভাবিক। কারণ এর সাথে অনেক ব্যাপার যুক্ত আছে। কেউ চাইলেই সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান তার উঠোনে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না; বা করা উচিত না। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মত বিষয় নিয়ে চিন্তার সময় নিজের বাড়ির নম্বর মনে রাখলে হয় না। দুনিয়াজুড়ে যারা বড় বড় কাজ করে গেছেন, তারা সামগ্রিক বিষয়ে ভেবেছেন। আর ইতিহাস এ ভাবেই তাদের স্মরণ রাখে অনাদিকাল। উত্তর পুরুষের কাছে আমাদের পরিকল্পনা ও কাজ কতটা উপযুক্ততা নিয়ে আসবে, তা মাথায় রেখেই কিন্তু পা ফেলতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উঠলে আমরা প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামব্রিজ এবং অক্সফোর্ড এর কথা বলি। ক্যামব্রিজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১২০৯ সালে, আর অক্সফোর্ড ১০৯৬ সালে। তবে পুরো বিশ্বের তো বটেই, এগুলোর কোনোটিই ইউরোপেরও প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালির বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১০৮৮ সালে। তারও প্রায় একশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আল-আজহারেরও প্রায় একশ অনেক আগে, আজ থেকে প্রায় সাড়ে এগারোশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মরক্কোর কারাউইন ইউনিভার্সিটি। ইউনেস্কো এবং গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ডের রেকর্ড অনুযায়ী, কারাউইন ইউনিভার্সিটিই হচ্ছে বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিগ্রী প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, যা এখন পর্যন্ত একটানা চালু আছে। আর এই ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন মুসলিম নারী, ফাতিমা আল-ফিহরি। অথচ তিনি নিজের নামের জন্য একবারও ভাবেননি। এমনকি তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানাও যায় না।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে চলছে পরিব্যপ্ত বিশ্বায়ন, যার কবলে বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি আবর্তিত হচ্ছে। এই বিশ্বায়ন বিশ্বের দেশসমূহের জন্য সুযোগ হিসাবে অবির্ভূত হয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশের ব্যাপক প্রস্তুতি প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান পশ্চাৎপদ জ্ঞানীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে এই প্রস্তুতি গ্রহণ সম্ভব নয়। সেজন্য দেশে বিশ্বায়ন সম্পর্কিত জ্ঞানচর্চার অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। এসবের প্রেক্ষিতে বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা এক কথায় অপরীসীম ও বিস্তৃত এবং ব্যাপক। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, কলা, সামাজিক বিজ্ঞানের বিস্তৃত বিষয়াদিসহ এককথায় সবকিছুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। গবেষণার কাজে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অপরিসীম। নতুন নতুন জ্ঞান উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহার লাল নেহেরু বলেছিলেন “একটি দেশ ভালো হয়, যদি সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়।”
আমাদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন লাভ করেছিল ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর। সেদিন সকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প অনুমোদন লাভ করে। পরে ‘সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ বিল গত ২ মার্চ মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদিত হয়। এরপর এ বছরের ৭ সেপ্টেম্বর সংসদে “সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিল ২০২০” উত্থাপন করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিলটি উত্থাপন করেন। পরে এ–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বিশ্ববিদ্যালয়টি দক্ষিণ সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ এলাকায় স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সংশ্লিষ্ট কমিটিতে প্রেরণ করা হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে শুরু থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন আমাদের প্রিয় মানুষ বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি। তিনি অত্যন্ত সজ্জন ও ভালো মানুষ। এ ব্যাপারে তার সাথে কথা বলতে মোবাইলে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে বলেন, শান্তিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জকে আলাদাভাবে দেখেন না তিনি। তিনি চাচ্ছেন, শান্তিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ একসঙ্গে যুক্ত হয়ে যাক। এভাবে এটি একসময় হবে ভাটি এলাকার সবচেয়ে বড় শহর।
কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী, আপনাকে বলি; বিশ্ববিদ্যালয়টি সদরে না করে দক্ষিণ সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জে স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়াটা যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ সদর উপজেলার সঙ্গে সব উপজেলার যেরকম যোগাযোগ রয়েছে, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের সাথে তা নেই। সুনামগঞ্জ জেলার সব উপজেলার মানুষের প্রাণের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়টি সদর উপজেলায় হোক। আর এই দাবিতে আজ সুনামগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ এক হয়েছে। আপনিও আসুন সবার একজন হয়ে।
সরকার অনুমোদিত ‘সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় স্থাপনের দাবিতে গত রোববার মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে। সুনামগঞ্জবাসীর ব্যানারে জেলা শহরের আলফাত স্কয়ারে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার শান্তিগঞ্জে স্থাপনের কথা রয়েছে। মানববন্ধন ও সমাবেশে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ ও বিরোধীদলীয় হুইপ, সৎ রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের মানুষকে ভালোবেসে এ বিশ্ববিদ্যালয় উপহার দিয়েছেন। এটি কোনো মন্ত্রী বা এমপির দান নয়’। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের উদ্দেশে ফজলুর রহমান বলেন, ‘আপনি শুধু শান্তিগঞ্জের বা সুনামগঞ্জের নন, সারা দেশের মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী আপনাকে সম্মান দিয়েছেন, আমরাও সম্মান করি। তাই বলে আপনি সবকিছু শান্তিগঞ্জে করবেন, এটা দুঃখজনক। আমরা কোনো এলাকার উন্নয়নের বিরোধী নই। এর আগে সদর উপজেলার সীমানায় মেডিকেল কলেজ স্থাপনের কাজ হলেও আসলে এটিও শান্তিগঞ্জেই হচ্ছে। আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আপনি শান্তিগঞ্জে করছেন। এভাবে একের পর এক প্রতিষ্ঠান শান্তিগঞ্জের দুই কিলোমিটারের মধ্যে হলে একসময় সুনামগঞ্জ শহর অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।’
জানতে পেরেছি, চাঁদপুরের বিশ্ববিদ্যালয় সংশোধন করে সদরে স্থাপন করা হচ্ছে। এ চিন্তা থেকে সাংসদ পীর মিসবাহ সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন সুনামগঞ্জের বিশ্ববিদ্যায়টিও যেন যোগাযোগ সুবিধার দিক থেকে এগিয়ে থাকা সদরে স্থাপিত হয়। কিন্তু ব্যথিত হৃদয় নিয়ে সংসদ থেকে সাংসদ পীর মিসবাহ বের হয়ে আসেন। শিক্ষামন্ত্রী তাকে জানান, পরিকল্পনামন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়টি দক্ষিণ সুনামগঞ্জে স্থাপনের জন্য তাদের লিখিতভাবে অনুরোধ করেছেন। সেই সঙ্গে শান্তিগঞ্জের কোন মৌজায় সেটি হবে তাও পরিকল্পনামন্ত্রী উল্লেখ করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার জন্য শিক্ষামন্ত্রী সাংসদ পীর মিসবাহকে পরামর্শ দিয়েছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সাংসদ পীর মিসবাহ আমাদের সকলের প্রিয় এবং জেলার সব মানুষ সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের ব্যাপারে পীর মিসবাহ’র সাথে একাত্ন হয়ে আপনার হস্তক্ষেপ চায়। হাওরের মানুষ এমনি নানা অধিকারবঞ্চিত। সবাইকে বঞ্চিত করে শান্তিগঞ্জের দুই কিলোমিটারের মধ্যে সমস্ত মেগা প্রকল্প যদি নিয়ে যাওয়া হয় তবে সুনামগঞ্জ শহর আঁধারে ঢেকে যাবে। শুনেছি, টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট, বিআরটিএ অফিস কাম-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যুব মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, দুটি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র, মুজিব কেল্লা- সব প্রতিষ্ঠানই জেলা সদরকে বঞ্চিত করে হয় শান্তিগঞ্জ, না হয় শান্তিগঞ্জের পাশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এসব কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সরকারের উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে উপযুক্ত স্থানে প্রতিষ্ঠা হলেই জনগণ এর প্রকৃত সুফল পাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, হাওরবাসী আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। আপনি তাদের শেষ ভরসাস্থল।
প্রকাশিত পত্রিকা– দৈনিক মানবকণ্ঠ, ২৮ অক্টোবর ২০২০