মাধ্যমিক শিক্ষায় দুর্গতি ঠেকাবে কে?

হাসান হামিদ

মা-বাবা আর পরিবারের বাকিদের সাথে একটা শিশু প্রাথমিক শিক্ষার শুরুটা করলেও পদ্ধতি আর প্রাতিষ্ঠানিক মূল শুরুটা হয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চৌকাঠে। আর এ কারণেই মানুষের জীবনে শিক্ষা নেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার সবচেয়ে  গুরুত্বপূর্ণ হলো মাধ্যমিক স্তর। একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এই স্তরে অব্যবস্থাপনা ও খাম খেয়ালিপনা থাকলে দেশের শিক্ষা  কাঠামো দুর্বল ও ভঙ্গুর হওয়া স্বাভাবিক। তবে আশার কথা হলো, মাধ্যমিকের তুলনায় প্রাথমিকের অবস্থা অনেকটা ভালো। এর বড় কারণ, প্রাথমিক শিক্ষাকে সরকার মোটামুটি জাতীয়করণ করে ফেলেছে। বেশ যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এখানে শিক্ষক নিয়োগ করা হয় এবং তাদের ট্রেনিং দেয়া হয়। সরকারি স্কেলে বেতন-ভাতা পাওয়ার ফলে তাদের আর্থিক অভাব-অভিযোগও কম। ফলে শিক্ষাদানের কাজটি যথেষ্ট উন্নতমানের না হলেও মোটামুটি ভালোভাবেই চলছে বলা যায়। কিন্তু বড় সমস্যা হচ্ছে মাধ্যমিক বা সেকেন্ডারি পর্যায়ে।

আমাদের দেশে বারবার শিক্ষানীতির অযথা পরিবর্তন হচ্ছে।  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গ্রাম শহর বৈষম্য যেমন রয়েছে তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভালো খারাপ চিহ্নিত করে সুবিধার ব্যবধান করার কারণে নতুন কিছু সমস্যা তৈরি হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, ভালোগুলোতে মেধাবীদের ভর্তি হওয়া নিয়ে চলে যুদ্ধ। অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের সন্নিবেশ ঘটে প্রান্তস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এভাবে বিভাজিত করে গ্রাম থেকে শহরমুখী প্রবণতা তৈরী করা হচ্ছে। ফলে দুইটি ধারা চলে আসছে। এর ফল টের পাচ্ছি পরবর্তী পর্যায়ে গিয়ে।

পত্রিকায় কিছুদিন আগে একটি খবর ছিল, সরকারি হাইস্কুল এবং কলেজে আট হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য। বেসরকারি হাইস্কুলগুলোতে এ অবস্থা আরও করুণ। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয় নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা দফতরের (মাউশি) উদ্যোগে আয়োজিত এক সভায় রাজধানীর ৪৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকদের অভিমত এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের মতে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ। দেশজুড়ে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪০ হাজারের বেশি শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে। ফলে মানসম্মত শিক্ষাদান দূরের কথা, শিক্ষা কার্যক্রমই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

হাইস্কুলগুলোয় উপযুক্ত দূরে থাকুক, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষকের যে নিদারুণ অভাব, এসব তথ্য-উপাত্ত থেকে তা সহজেই অনুমেয়। উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন এবং ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাবের ফলে মাধ্যমিক স্কুলগুলোর বেহাল অবস্থা দেশের শিক্ষিত সচেতন মানুষ অবগত। সরকার যে এটা জানে না তা নয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সরকার তাই সেকেপ (ঝঊছঊচ) বা ‘মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মানবৃদ্ধি’ নামক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু সমস্যাটি এত বিরাট যে, সেকেপের বিশেষ কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য ফলাফল মাঠ পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে না। মাধ্যমিক স্তরে পর্যাপ্তসংখ্যক উপযুক্ত শিক্ষক না পাওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ আছে। এর অন্যতম হলো, বেতন ভাতা নিম্ন হওয়া।

শিক্ষককে রাষ্ট্র ন্যায়সঙ্গত বেতন-ভাতা দিক; এটা শিক্ষার স্বার্থেই দরকার। শিক্ষা চাইবেন, অথচ শিক্ষককে ন্যায্য আর্থিক সুবিধা দেবেন না- এটা হয় না। বিষয় বিবেচনায় মাধ্যমিক স্কুলে ইংরেজি এবং অঙ্কের শিক্ষকের অভাব অতিশয় প্রকট। প্রয়োজনে অতিরিক্ত বেতন এবং যথাযথ ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে এ দুটি বিষয়ে শিক্ষকের অভাব দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোর দিকে। সেখানকার মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে যেমন নেই পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক, তেমনি নেই যথোপযুক্ত শিক্ষক। বিশেষ করে ইংরেজি এবং অঙ্কের শিক্ষক নেই বললেই চলে।

আরেকটি চিন্তার ব্যাপার হলো, বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহ হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ‘বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষা‘ নামক গবেষণামূলক একটি বইয়ে উল্লেখিত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত আট বছরে বিজ্ঞান শিক্ষার্থী কমার হার ৩১.৩৩ শতাংশ। শতকরা ৬৫ জন মনে করে বিজ্ঞানে বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই, ৬৯ জন মনে করে বিজ্ঞানে পড়লে প্রাইভেট পড়তে হয় এবং ৫৭ জন প্রাইভেট পড়ে, ৬৫ জন মনে করে বিজ্ঞানের জন্য আলাদা গবেষণাগার নেই, ৫৮ জন মনে করে ব্যবহারিক ক্লাসে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই, ৯৪ জন বলেছে কোনো বিজ্ঞান মেলা হয় না।

আসলে আমাদের দেশে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিটি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধা মূল্যায়ন করতে পারছে না। কোনো পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীর শতভাগ সঠিকভাবে মেধা মূল্যায়ন সম্ভব না হলেও বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি অনেকটা সঠিকভাবে এই কাজ করতে সক্ষম। আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে মুখস্থ করতে যারা পারদর্শী তারাই বেশিরভাগ সময় ভালো ফলাফল করে। অনেক প্রকৃত মেধাবীর শিক্ষা জীবন সঠিক মূল্যায়নের অভাবে খারাপ ফলাফল করে পর্যদুস্ত হচ্ছে। প্রচলিত এই পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে ছাত্র–ছাত্রীরা অধিক হারে নোট বই ও কোচিং নির্ভর হচ্ছে। আর কিছু অসাধু কোচিং ব্যবসায়ী এর সুযোগ নিচ্ছে। পাঠ্যবইগুলো পড়লেই বুঝা যায় কোন সরকার ক্ষমতায়। সরকার বদলের সাথে সাথে সরকারি দলের অনুকূলে বইয়ে ভেজাল মিশ্রণ, তথ্যের বিকৃতি সাধন করা হয় অত্যন্ত নগ্নভাবে।

এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র যে স্কুলগুলো সেগুলোতে মাত্র ৭০ থেকে ৮০ দিন শিক্ষা কার্যক্রম চলে। আর যে সব উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়না সেগুলো বছরের মাত্র ১০০ থেকে ১১০ দিন শিক্ষা কার্যক্রম চলে। মন্ত্রণালয় ঘোষিত ছুটি প্রায় ৮৮ দিন, সাময়িক পরীক্ষাগুলোর জন্য সর্বনিম্ন ১২ দিন করে মোট ৪৮ দিন, সাপ্তাহিক ছুটি ৫২ দিন, নভেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে পুরো ডিসেম্বর মাসই বন্ধ থাকে। ফল প্রকাশের পর সব শিক্ষার্থীর হাতে বই এসে পৌঁছাতে লাগে আরো দেড় থেকে দুই মাসের মতো। এছাড়া এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র যেসব স্কুল সেগুলোতে আরো অন্তত ১ মাস ক্লাস বন্ধ থাকে। নানা উপলক্ষে অনেক সময় বিদ্যালয় খোলা থাকলেও ক্লাস চলে না। কলেজগুলোতেও প্রায় একই অবস্থা। যেসব কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সেগুলোর অবস্থা আরো করুন। পরীক্ষার জন্য স্বতন্ত্র হল না থাকায় ক্লাস বন্ধ রেখে কলেজের ২টি বর্ষের পরীক্ষা, এইচএসসি পরীক্ষা, অনার্স ৪টি বর্ষের ফাইনাল, ডিগ্রী ৩টি বর্ষের ফাইনাল, মাস্টার্স ২টি বর্ষের ফাইনালসহ ভর্তি কার্যক্রমের দরুন এসব কলেজে ক্লাস হয় না বললেই চলে।

বাংলাদেশে সবচেয়ে উপেক্ষিত শিক্ষা হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা। এ শিক্ষায় শিক্ষিতের হার মাত্র ৩ শতাংশ। অথচ উন্নত দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ। দেশের কারিগরি শিক্ষা খুবই নাজুক অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে যে সকল বিষয়ে হাতেকলমে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা একেবারেই বাস্তবতাবিবর্জিত। ওই শিক্ষা না দেশে না বিদেশে কোথাও কোনো কাজে আসছে না। ফলে কারিগরি শিক্ষার প্রতি ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। উৎপাদনমুখী ও স্বনির্ভর অর্থনীতির জন্য দরকার দক্ষ জনশক্তি। আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের অর্থনীতি মোটেও উৎপাদনমুখী নয়। উৎপাদনমুখিতা না থাকায় কারিগরি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থাকে বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা। অথচ বিদেশ গমনেচ্ছু বিশাল একটি অংশই কিন্তু অদক্ষ শ্রমিক। এই অংশকেও সঠিকভাবে কারিগরি শিক্ষার আওতায় আনা যাচ্ছে না।

কারিগরি শিক্ষায় অন্যতম সমস্যা হচ্ছে তীব্র শিক্ষক সঙ্কট এবং নিম্নমানের শিক্ষা ব্যবস্থা। কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের সূত্রমতে, স্থায়ী অস্থায়ী মিলিয়ে বর্তমানে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতেই ৪৬ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। অন্যদিকে ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটগুলোতে শিক্ষকদের শূন্য পদ ৬৪ শতাংশ। লোকবল সংকটও চরম। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদেও ৫৬ শতাংশ খালি রয়েছে। বিজ্ঞান শিক্ষার সমান্তরালভাবে কারিগরি শিক্ষার বিস্তার ছাড়া আধুনিক বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় আমরা টিকে থাকতে পারবো না। কিন্তু এই শিক্ষা নিয়ে এক ধরনের অবহেলা দৃশ্যমান। মেধাবীদের আকৃষ্ট করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেই। অভিভাবক মহলে বরং এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। সবকিছু বিবেচনায় এনে অচিরেই পদক্ষেপ না নিলে এর মাশুল আমাদেরকেই দিতে হবে। আমরা তা চাই না, আমরা সঠিক ও মানসম্মত আধুনিক শিক্ষা চাই।

প্রকাশিত পত্রিকা- দেশবার্তা, ২ জানুয়ারি, ২০২০

মাধ্যমিক শিক্ষায় দুর্গতি ঠেকাবে কে?
Scroll to top