পরিচালক ও মালিক পক্ষের নিজেদের লোকজনের ক্রমাগত লুটপাটের কারণে গ্রাহকদের আস্থা হারাচ্ছে অনেক ব্যাংক। বাড়ছে নামে বেনামে খেলাপি ঋণের অঙ্ক। সব দেখেও উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এভাবেই দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দুর্নীতির কারণে ব্যাংক ব্যবসায় খুব শীঘ্রই বৃহৎ ধসের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্যাংক ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে একে অন্যের ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন কোনো নিয়ম নীতি না মেনেই। কেউ আবার নিজের নামে লোন না নিয়ে স্ত্রী কিংবা পরিবারের অন্য সদস্য, কখনো তার নিয়ন্ত্রণাধীন নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়েছেন। প্রভাবশালী এসব ব্যক্তিকে অনেকটা বাধ্য হয়ে যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণের অনুমোদন দিয়ে দেন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। আর এসব পর্ষদেও তাদের পরিবারের সদস্যরাই পরিচালক হিসেবে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন। তাই দুর্নীতি করে সুবিধা নিতে তেমন বেগ পেতে হয় না!
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট-এর একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতে সংঘটিত ৯০ শতাংশ দুর্নীতিতে জড়িত থাকেন ব্যাংকের নিজেদের লোকজন। কেননা ব্যাংকের পরিচালকদের হাতেই রয়েছে বেশিরভাগ ক্ষমতা। এভাবেই তারা ভাগিয়ে নেন নানা সুবিধা। লোন নিয়ে তা দেওয়ার কথা ভুলে যান। ঋণ খেলাপি হলেও শাস্তির বদলে তারা উল্টো প্রণোদনা পেয়ে থাকেন। আর এসব দেখে হতাশ হচ্ছেন ভালো গ্রাহকরা। বিভিন্ন ব্যাংক মালিক বা পরিচালকরা অন্য ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণে ঋণ নিয়ে থাকেন সহজেই। ফলে অন্য ঋণগ্রহীতারা বঞ্চিত হন নানা ভাবেই।
জানা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে তফসিলি ব্যাংক আছে ৬০টি। এসব ব্যাংকে ঋণগ্রহীতা ১ কোটি ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৪৫৯ জন। আর পরিচালক আছেন প্রায় ১ হাজারের মতো। এর মধ্যে ৫৫টি ব্যাংকের পরিচালকরা অন্য ব্যাংক থেকে এবং ২৫ ব্যাংকের পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। দেশে বর্তমানে মোট আমানতকারী ১০ কোটি ৩ লাখ ৩৭ হাজার ১৯৬ জন। মোট আমানতকারীর চেয়ে পরিচালকের সংখ্যা একেবারে সামান্য। অথচ ঋণ গ্রহণে তারাই শীর্ষে। মাত্র কয়েকজন ব্যাংক পরিচালক বিভিন্নভাবে ঋণ নিয়েছেন ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর এসব ঋণের বড় অংশ এখন খেলাপি!
বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল সম্প্রতি দেশের ব্যাংকিং খাতে ৪ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে। সংস্থাটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। সিএজি হিসাবে দেখা গেছে, এর আগের বছর ব্যাংকিং খাতে অনিয়মের অঙ্ক ছিল ১০ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। তবে অনিয়ম হ্রাস পাওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, করোনার কারণে দীর্ঘ সময় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, এরপর খোলা ছিল সীমিত পরিসরে। ওই সময়ে ব্যাঘাত ঘটেছে সিএজির নিরীক্ষা কার্যক্রমে।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ১০ কোটি আমানতকারীর ব্যাংকে জমানো লাখ লাখ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নিয়ে নিজেদের পকেটে পুরেছেন মাত্র কয়েক শ’ ব্যাংক পরিচালক। অথচ দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার বাহানায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে এই দুষ্কর্মটি চালিয়েছেন তারা। এসব ঋণের বড় অংশ খেলাপি হলেও বছরের পর বছর তা নিয়মিত হিসেবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। পত্রিকায় এসেছে, সম্প্রতি দেশ ছেড়ে পালানো সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে খুলনা বিল্ডার্স লিমিটেডসহ কয়েকটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে এক হাজার ২৫৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। তবে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর রহস্যজনক কারণে তার নামে মামলা করে দুদক। ২০২১ সালের নভেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের পরিচালক ও কর্মকর্তাদের নামে পাঁচটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। তাদের বিরুদ্ধে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে জাল রেকর্ডপত্র প্রস্তুত করে ঋণ পেতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়। তাছাড়া ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে একইভাবে ৩০টি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে অন্তত ২ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে আলোচিত পিকে হালদারের বিরুদ্ধে। আবার জাল দলিল জামানত রেখে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তাছাড়া দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে ব্যাংক পরিচালকদের দ্বারা অনেকগুলো জালিয়াতি এবং দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কিছু পরিচালকের যোগসাজশে সোনালী ব্যাংকে ঘটেছে হলমার্ক কেলেঙ্কারি। ভয়াবহ লুটপাট হয়েছে বেসিক ব্যাংকে। কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালকদের সংশ্লিষ্টতায় ঘটেছে বিসমিল্লাহ গ্রুপের জালিয়াতি। পরিচালকদের হস্তক্ষেপে সরকারি ব্যাংকের সিএসআরের টাকা ‘নয়ছয়’ হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকে পরিচালকরা প্রভাব খাটিয়ে জামানতের সম্পদ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে কয়েকগুণ বেশি দেখিয়ে শত শত কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন নিয়েছেন। এ রকম শত শত ঘটনা আছে। সব পত্রিকায় আসেনি।
সিএজির প্রতিবেদনে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ১৬৯৯ কোটি টাকার অনিয়ম শনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়া রূপালী ব্যাংকের ৯৩৪ কোটি টাকার অনিয়ম নিয়ে বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যান্য ব্যাংকের অনিয়ম চিহ্নিত হয় আরও ১২৩৫ কোটি টাকার। অনিয়মের কারণ হিসেবে ঋণ বিতরণ নীতিমালা অনুসরণ না করা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন বিভ্রান্তিকে দায়ী করা হয়।
জানা যায়, সিএজি এবার রূপালী ব্যাংকের অনিয়মের ওপর বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে মেয়াদি ঋণ আদায় না করে ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে এলটিআর সৃষ্টি করা। এ কারণে ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে ১২৮ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংক ছাড়াও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ওপর নিরীক্ষায় দেখা গেছে, সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানে ইনভেস্টর হিসেবে ঋণসীমার অতিরিক্ত অর্থ দেওয়া হয়েছে। এতে আইসিবির ২১০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। এছাড়া ১৮২ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে আইসিবি সিকিউরিটিজ কোম্পানি লিমিটেডকে। কিন্তু সে ঋণ ফেরত আসেনি। আরও একটি বড় অনিয়ম ধরা পড়ে ২৭৬ কোটি টাকার। অস্বাভাবিকভাবে ইনভেস্টর মার্জিন ঋণ লেনদেনের মাধ্যমে এ অনিয়ম হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি শেষে দেশের সব ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ প্রায় ১৪ লাখ ১ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা, মোট অগ্রিমের পরিমাণ ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। এই সময়ে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করেছে ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অন্য সকল দেশে যেখানে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো বিবেচনায় বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেখানে আমাদের দেশে অনুমোদন দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত উপেক্ষা করে বাণিজ্যিক ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছে সরকার। ফলে অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হলেও সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আর এভাবেই ব্যাপক দুর্নীতি ও প্রভাব এবং সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট না থাকার কারণেই মূলত খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বর্তমানে ব্যাংকিং খাত ঋণখেলাপিদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বলা যায়।
সাম্প্রতিক দেশকাল
২৪ মার্চ ২০২২