বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে বাড়ছে কেন?

হাসান হামিদ

গত পরশু বাজারে গিয়ে দেখি কাঁচা মরিচ ৩২০ টাকা কেজি। এই দাম শুনে কিছুটা অবাক হলাম। কারণ এর কয়েক দিন আগে এই মরিচ কিনেছি ২০০ টাকা কেজি ধরে। শুধু কি মরিচ, এমন কোনো জিনিস নেই যার দাম বাড়েনি। দেড় কিংবা দুই বা কয়েক গুণ বেশি দাম দিয়েই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বাধ্য হচ্ছে লোকজন। দেশে যেন দাম বাড়ানোর হিড়িক চলছে। এ নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দাম বৃদ্ধির কথা। কিন্তু অনেক কিছুর দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমতে শুরু করলেও বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে। গত সপ্তাহে জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই খবর পড়ে শেষ করাই সাথে সাথে দেখি পানির দাম ২৫ শতাংশ বাড়াতে চায় ঢাকা ওয়াসা। আবার শুনলাম চলতি মাস থেকেই বাড়ানো হতে পারে বিদ্যুতের দাম। শুধু জিনিস নয়, আপনি লাশ হয়ে কবরে যাবেন- সেটার দামও অনেকখানি বেড়েছে। ঢাকা শহরে সংরক্ষিত কবর দেওয়ার জন্য ফি বাড়িয়েছে ডিএনসিসি। এই ফি ২০ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে বনানী কবরস্থানে ৫০ হাজার টাকা এবং অন্য কবরস্থানে ৩০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই হলো অবস্থা!

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন কমতে শুরু করেছে, ঠিক তখন এর মূল্য দেশে বাড়ছে বলেই এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর পড়ে জানলাম, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)-এর শর্তের কথা সেখানে বলা হচ্ছে। অনেকের মতে, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল থেকে ঋণ পেতেই সরকার তাদের শর্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছে। কিন্তু ভয়ানক ব্যাপার হলো কিছুদিন পর পর দাম বাড়ালে তো সমস্যা। আর দাম বাড়ালেই কি সমাধান হয়ে গেল? মাত্র নয় মাস আগে ২৬ শতাংশ হারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করেছিল সরকার। এবার আরো এক দফা বাড়ল ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ। এদিকে তেলের দাম বাড়ার খবর শুনেই ব্যবসায়ীরা সব জিনিসের দাম দেড় দ্বিগুণ করে ফেলেছেন। ডিমের ডজন যেখানে গত সপ্তাহে ছিল ১৩০ টাকা, এই সপ্তাহে ১৮০ টাকা। এই যে ধাক্কা সবকিছুতে, যারা মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী তারা পড়েছেন বিপাকে। অর্থনীতির মাপে এর চেয়ে নিচের যারা তাদের কথা না-ই বলি!

তেলের দাম নিয়ে ‘বিশ্ববাজার’ বলে যারা লাফাচ্ছেন তাদের জানা উচিত, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার শঙ্কায় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমেছে। আর এখন সেটি আগের সময়ের কাছাকাছি নেমে এসেছে। আগের সময় বলতে বিভিন্ন যুদ্ধের কারণে তেলের দাম বেড়েছিল, এখন যে দাম তা যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ের দামের সমান কিংবা একেবারে কাছাকাছি। ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে একপর্যায়ে ব্যারেলপ্রতি ১৩৯ ডলার হয়ে গিয়েছিল। ইউএস ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৬৭ সেন্ট কমে ৮৮ দশমিক ৩৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে। পত্রিকার খবর বিশ্লেষণ করে বলা যায়, গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের পর এবারই সবচেয়ে দ্রুত তেলের দাম কমছে। এর মানে বিগত ৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে জ্বালানি তেলের দাম। বৃদ্ধি পেয়েছে লিবিয়া থেকে তেলের সরবরাহ। বিশ্ববাজারের ২৩ মে ও ৩১ জুলাইয়ের একটি তুলনামূলক দামচিত্র কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, ২৩ মে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন গমের দাম ছিল ৫০৬ ডলার; ৩১ জুলাই তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫৩ ডলারে। অর্থাৎ প্রায় ৩০ শতাংশ দাম কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে আটার দাম কমেছে মাত্র ৭ শতাংশ। দুই মাস আগে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৯৭০ ডলার, যা জুলাইয়ের শেষে কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৫৬ ডলারে। শতকরা হিসাবে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমেছে ৩১ শতাংশ; পাম অয়েলের দাম কমেছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। অথচ সয়াবিন তেলের দাম কী হয়েছে আমরা সবাই জানি! আসলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বর্তমান বাস্তবতা হলো, বিশ্ববাজারে জিনিসের দাম যতই বাড়ুক বা কমুক, এখানে কমে না। বাজার মনিটরিংয়ের দুর্বলতা এর জন্য দায়ী।

বাংলাদেশের মানুষের চাহিদা পূরণে যা যা লাগে তার অনেক কিছুই কিন্তু বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের দেশ যেসব জিনিস আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করে, সেসব জিনিসপত্রের স্থানীয় দামের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের দামের একটা প্রভাব থাকে। তাই কোনো সময় কোনো পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এরপর যেটি ঘটে তা হলো ভোক্তাকে তা বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। লক্ষণীয় সমস্যা হচ্ছে, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলে সেই অনুপাতে এর প্রভাব বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে পড়তে দেখা যায় না। যেমন চিনির দাম বিশ্ববাজারে ৬ শতাংশ কমলেও আমরা যে চিনি আগে ৭০ টাকায় কিনতাম, তা এখন ৯০ টাকা হয়েছে! আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছিল করোনা অতিমারি ও পরবর্তী সময়ে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে। কিন্তু এখন অনেক দেশই রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে দামও কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশে দিন দিন আরও বাড়ছে। এর লাগাম টানবে কে?

দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা আর জোগানের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কিছু পণ্য আমাদের বার্ষিক চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হয়, আবার কিছু পণ্যের সিংহভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে উৎপাদিত চালের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ৩ কোটি ৯৫ লাখ টন, যা আমাদের নিজস্ব চাহিদার চেয়ে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টন বেশি। এ বছর উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ ২৫ লাখ ৫০ হাজার টন। সংরক্ষণজনিত ক্ষতি ৬ লাখ টন বাদে বাজারজাত পেঁয়াজের পরিমাণ ১৯ লাখ ৫০ হাজার টন। গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত আমদানীকৃত পেঁয়াজের পরিমাণ ৪ লাখ ৩৬ হাজার টন। দেশে উৎপাদিত ও আমদানীকৃত পেঁয়াজসহ মোট পেঁয়াজের পরিমাণ ২৪ লাখ টন প্রায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ টন। ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১১ লাখ টন, যার ৩০ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয় আর বাকি ৭০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। দেশে গমের চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন, যার শতকরা ৫ ভাগের এক ভাগ দেশে উৎপাদন হয়, বাকিটুকু বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ভোজ্যতেলের মতো অনেক পণ্য আছে যেগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর এসব পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে বেড়ে গেলে দেশীয় বাজারেও বাড়তে থাকে। এজন্য খবরের কাগজে প্রায়ই দেখা যায়, কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার টন চাল অবৈধভাবে মজুদ করে রাখছে, হিলি সীমান্ত বন্দরে শত শত ট্রাক পেঁয়াজ আটকা পড়ে আছে। এইসব কারণে দেশীয় বাজারে তৈরি হয় কৃত্রিম সংকট। কিন্তু এখন বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশীয় বাজারে দাম কমছে না।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতি ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ নিয়ে শেষ হয়েছিল, ২০১৯-২০ অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে এর পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মধ্যস্বত্বভোগী, অসাধু ব্যবসায়ী, অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানের অসক্রিয়তা, সরকারের কঠোর পদক্ষেপের অভাব, সর্বোপরি সাধারণ মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করা যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, করোনা মহামারির কারণে গত বছর থেকে এ পর্যন্ত বেকার হয়েছেন ২৬ লাখের বেশি মানুষ। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে কর্মজীবীদেরও আয়। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেশে নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে দিশেহারা মানুষ। সব কিছুর দাম বাড়লেও বাড়ছে না কেবল মানুষের আয়। এ অবস্থায় স্বল্প আয়ের মানুষের টিকে থাকা দায় হয়ে গেছে।

বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে বাড়ছে কেন?
Scroll to top