বাংলা ভাষা চর্চায় অনাগ্রহ ও কর্পোরেট প্রজন্ম

হাসান হামিদ

ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের ছড়াটা আমরা মোটামুটি সবাই পড়েছি। তিনি সেখানে বলেছেন,
‘ইংলিশ ওর গুলে খাওয়া, ওটাই  ফাস্ট  ল্যাঙ্গুয়েজ
হিন্দি সেকেন্ড, সত্যি বলছি, হিন্দিতে ওর দারুণ তেজ।
কী লাভ বলুন বাংলা প’ড়ে?
বিমান ছেড়ে ঠেলায় চড়ে?
বেঙ্গলি ‘থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’ তাই, তেমন ভালোবাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না’।

আমাদের দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশ পাওয়া  গিয়েছিল ২০১৪ সালে। সেই আদেশে বলা হয়েছিল: ইংরেজিতে থাকা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন, গাড়ির নামফলক, সব ধরনের সাইনবোর্ড ও নামফলক বাংলায় লিখতে হবে। একই সঙ্গে বাংলা ভাষা প্রচলন আইনানুসারে সব ক্ষেত্রে অবিলম্বে বাংলা ভাষা ব্যবহারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও দিয়েছিল আদালত। আগেও আমরা এমন নির্দেশনা দেখেছিলাম। কিন্তু যে দেশে আড্ডা বা চায়ের দোকানে বসে নিজের যোগ্যতা প্রকাশ করতে যার যা সাধ্যমতো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করাটা নিত্য-নৈমিত্ত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, খাবারের বা কাপড়ের দোকানের নাম হয় ইংরেজি বা অন্য ভাষায়, সেলুনের নাম হয় অন্য ভাষায়; সে দেশে সেই আদেশ কতোটা কীভাবে কাজে লাগবে তা ভাবনার বিষয়।

বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এদেশ স্বাধীন ছিল না কোনো সময়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিদেশি কর্তৃক শাসিত হয়েছে বাংলাদেশ নামক জনপদটি। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশটি স্বাধীন হয়। স্বাধীন সার্বভৌম্ব বাংলাদেশটি কি তার নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ভাষার মাধ্যমে দৈনন্দিন কার্যকলাপ পরিচালনা করতে পারছে? এখনো এ দেশের মানুষের ঘাড়ে বিদেশি সংস্কৃতি এবং ভাষার ভূত চেপে বসে আছে। প্রায়ই দেখা যায়, কোথায় গল্প বা আড্ডায় অনেকেই নিজের আভিজাত্য প্রকাশের জন্য কথাগুলো ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করেন, আসলে কি এতে নিজের আভিজাত্য প্রকাশ পায়?

আমাদের দেশের মানুষের মনস্ত্মাত্ত্ব্বিকতায় ঢুকে আছে বিদেশি ভূত, কারণ রাজতন্ত্র বা উপনিবেশিক শাসন উভয়টাতে ক্ষমতায় বসে ছিল বিদেশিরা, এই শাসকদের ভাষা আয়ত্ত নিয়ে শাসকশ্রেণির সান্নিধ্য লাভ করতো অনেকেই। তাই নিজেদের উচ্চশ্রেণি বা শাসকগোষ্ঠীয় সমপর্যায়ের মানুষ হিসেবে প্রকাশ করতে তারা বিদেশি ভাষা ব্যবহার করতেন ।

ইংরেজি না জানলে ভালো কর্মসংস্থান হতো না, এই প্রচলিত প্রথাটা এখনো বহাল আছে, যদিও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি কম জানলেও তেমন কোনো সমস্যা নেই তবে বেসরকারি চাকনির ক্ষেত্রে ইংরেজি জানাটা দরকার। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সব কার্যক্রম ইংরেজি ভাষাতেই চলে।
কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের বাংলা শব্দগুলো ইংরেজি স্টাইলে উচ্চারণ করাটা অনেকটা মেনিয়ায় পরিণত হয়ে গেছে। যেসব পড়ুয়া ইংরেজি স্টাইলে বাংলা বলতে পারে না তাদের ক্ষেত হিসেবে সতীর্থ চিহ্নিত করে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নতি হয়েছে, যার ফলে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছোট-বড় খাবারের দোকান গড়ে উঠেছে। এই খাবারের দোকানগুলোর খাবারের তালিকাটিও ইংরেজি অক্ষরে লেখা। বড় হোটেলগুলোরও বেলায় তো কথাই নেই সবাই মেনু্য কার্ড ইংরেজিতে লেখেন। তাছাড়া দেশীয় খাবারগুলোকে বিদেশি শব্দের মাধ্যমে নানা স্টাইলে পরিবেশন করা হয় বড় বড় খাবারের দোকানগুলোতে। ভুল শুদ্ধ যাই হোক স্টাইল করে ইংরেজি বলতে পারলে দেখবেন অফিসের কর্তাব্যক্তিটি আপনাকে মূল্যায়ন একটু বেশি করছেন। অফিসিয়াল কিছু নির্দেশনাও সাধারণের মধ্যে বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন অফিস কর্তারা, কারণ নিজেকে বড় মাপের কর্তাব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরার জন্য তা ইংরেজিতে বলেন।

আমরা জানি, কিছুদিন আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সরকার আইন করে রাজ্যের সব বিলবোর্ডে বাংলা লেখা বাধ্যতামূলক করেছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালে দুই বছর আগে তাদের সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক সরকারি প্রজ্ঞাপনে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম বিদেশি ভাষা পরিত্যাগ করে স্থানীয় ভাষায় রাখার আদেশ জারি করেছে। দুই মাসের মধ্যে নাম পরিবর্তন না করলে অধিভুক্তি বাতিলসহ শাস্তি প্রদানের কথাও বলা হয়েছে। সেখানে ‘ইস্টার্ন স্কুল’ যদি হিমালয় বিদ্যালয় হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশে প্রায় ৯০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেগুলোর মাত্র কয়েকটি বাদে সবই ইংরেজি নামে চলছে, সরকার চাইলেই সেগুলোর (মন্ত্রণালয় বা মঞ্জুরি কমিশন প্রস্তাব করতে পারে) বাংলা নাম দেওয়া সম্ভব।সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে দেশ ও জাতি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে অহংকার করে, সে দেশে ভাষাচর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য কোনো রাষ্ট্রীয় নীতি নেই। এটা দুর্ভাগ্যজনক।আমরা চাই এটা এই সংক্রান্ত একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা হোক এবং সবাই মিলে সেটা বাস্তবতার নিরিখে দৈনন্দিন জীবনের সমান্তরালে নিয়ে আসুক। ভালো থাকুক আমার দুঃখিনী বর্ণ মালা, হাজার কোটি বছর বেঁচে থাকুক আমার বাংলা মা।

প্রকাশিত পত্রিকা-

দৈনিক শিক্ষা  ১১/০২/২০১৮

শিক্ষাবার্তা  ১২/০২/২০১৮

বিডি টুয়েন্টিফোর লাইভ ১৪/০২/২০১৮

পূর্ব-পশ্চিম বিডি  ১২/০২/২০১৮

বাংলা ভাষা চর্চায় অনাগ্রহ ও কর্পোরেট প্রজন্ম
Scroll to top