হাসান হামিদ
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রানজিট চুক্তিতে ভারতের ষোলআনা লাভের বিষয়টি যখন আলোচনায়, এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু খবর। গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের দ্বিতীয় দিন নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক হয়। সেই বৈঠক-পরবর্তী সময় প্রকাশিত হয় একটি যৌথ বিবৃতি। আর তাতে উঠে আসে প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কের বিভিন্ন দিক। পাশাপাশি বলা হয়, বৈঠকে আলোচনা হয়েছে অমীমাংসিত কিছু ইস্যু এবং চলমান ও ভবিষ্যৎ সহযোগিতার বিষয়গুলো নিয়ে। যৌথ সেই বিবৃতি থেকে জানা যায়, ভারতের স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশকে বিনা মাসুলে ট্রানজিট দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। আর এই প্রস্তাব কার্যকর হলে ভারতের স্থলপথ ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানিতে বাড়তি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। ভারতের ট্রানজিট বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ট্রাকগুলো নেপাল ও ভুটানের সীমান্তে পণ্য রপ্তানি ও আমদানি করার সুযোগ পাবে। শুধু তাই নয়, বলা হয়েছে স্থলপথ ছাড়াও পণ্য পরিবহনে ভারতের বিমানবন্দরও ব্যবহার করতে পারবে বাংলাদেশ। আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিটের ভারতীয় এ প্রস্তাবকে বাংলাদেশের জন্য বড় প্রাপ্তি হিসেবে দেখছেন অনেকেই। ফলে আবারও নতুন করে আলোচনায় এসেছে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ট্রানজিট চুক্তি। এর মধ্যে গত ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যায় ভারতীয় জাহাজ এমভি ট্রান্স সমুদেরা। এতে কার্গো হিসেবে ছিল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয় থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড হয়ে যাওয়া ভারতীয় ট্রানজিট কনটেইনার। আর এই চালানের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির অধীনে সব অনুমোদিত রুটে ট্রায়াল শেষ হয়। এবার পণ্যের নিয়মিত চলাচলকে কার্যকর করার জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রয়োজনীয় স্থিতিশীল স্থায়ী আদেশ বা বিজ্ঞপ্তি জারি করবে বলে জানা যায়। সূত্র বলছে, গত সেপ্টেম্বরে শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে এ প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছিল।

অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশের নৌরুট ও সড়কপথে ট্রানজিট পেয়ে আসছে ভারত। বাংলাদেশের যখন জন্ম হয়নি, তখন ভারত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে নৌ-ট্রানজিট পেত। অবশ্য ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর তা একসময় বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো ‘অভ্যন্তরীণ নৌ-ট্রানজিট ও বাণিজ্য’ প্রটোকল স্বাক্ষর হয় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে। এর আওতায় ভারতীয় নৌযানগুলো বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ ও বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করতে পারে। এরপর কেটে যায় দীর্ঘ সময়। বাংলাদেশের সড়কপথ ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি হয় ২০১০ সালে। আর এই চুক্তির পর থেকেই নানা মহলে সমালোচনা শুরু হয়। সমালোচনার মুখে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৩টি রাজ্যে নিয়মিত পণ্য পরিবহনে বহুমুখী ট্রানজিট ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে আরও একটি চুক্তি হয়। ওই চুক্তিতে একইসঙ্গে নদী ও সড়কপথে বহুমুখী ট্রানজিটের মাধ্যম ব্যবহার করার বিষয় উল্লেখ করা হয়। সেই চুক্তিতে বিশেষ করে সংযোগ স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল কলকাতা ও মুর্শিদাবাদকে আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সঙ্গে।
পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ভারতের নিজ ভূখণ্ড ব্যবহার করে কলকাতা থেকে ত্রিপুরা রাজ্যে পণ্য পরিবহনের জন্য পাড়ি দিতে হয় অন্তত ১৬০০ কিলোমিটার পথ। অথচ বাংলাদেশের নৌপথ ও স্থলপথ ব্যবহার করে আগরতলায় পণ্য পৌঁছানো যায় মাত্র ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে। আর পণ্য পরিবহনের জন্য এই রুটে টনপ্রতি মাসুল নির্ধারিত হয় ১৯২ টাকা। তাছাড়া নিরাপত্তা ও নৌবন্দর শিপিং মাসুলসহ প্রতি টন পণ্যে বাংলাদেশের আয় ২৭৭ টাকা। বাংলাদেশের সড়ক ব্যবহারের জন্য ২০১৬ সালে নামমাত্র মাসুল ধার্য করার পর তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এই ঘটনার প্রায় দুই বছর পর ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার ভারত সফরে এক চুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে সড়কপথে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের অনুমতি দেয়া হয়। এর ঠিক এক বছর পর ২০১৯ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অভ্যন্তরীণ ও তৃতীয় দেশের পণ্য পরিবহনের জন্য প্রতিবেশী দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের রূপরেখা বিষয়ে এসওপি সই হয়। তবে এসবের মধ্যে নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহনের জন্য ভারতের করিডর ব্যবহারের জন্য দীর্ঘদিনের দরকষাকষির পরও ভারতের কোনো সদিচ্ছা দেখা যায়নি। আর এই বিষয়গুলো ভারত-বাংলাদেশ ট্রানজিট নিয়ে সমালোচনার আগুনে ঘি-এর কাজ করেছে বলে মনে করেন অনেকে।

সূত্র বলছে, গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকালে ভারত পশ্চিমবঙ্গের হিলি থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ পর্যন্ত একটি ট্রানজিট রুট চেয়েছে। জানা গেছে, এই রুটে পণ্য পরিবহনের জন্য অন্তত ১০ কিলোমিটার ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। এই একই বৈঠকে সদ্য উদ্বোধন হওয়া চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুটের মাধ্যমে ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ চেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে সেই সময় প্রকাশিত দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ভারত তার ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে বিশেষ স্থল শুল্ক স্টেশন, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য বিনামূল্যে ট্রানজিট সুবিধার প্রস্তাব দিয়েছে। এ বিষয়ে তৃতীয় দেশে ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য বন্দর অবকাঠামো ব্যবহার করার জন্য বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারত। নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশকে ভারত বিনা মূল্যে ট্রানজিট দিয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সদ্য উদ্বোধন হওয়া চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রুটের মাধ্যমে ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগের অনুরোধ করেছে। আর সেই অনুরোধ কার্যকারিতা ও সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে বিবেচনা করতে সম্মত হয়েছে ভারত। বিবৃতির এক জায়গায় উল্লেখ করা হয়, দুই দেশের নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল) মোটরযান চুক্তি দ্রুত কার্যকর করার মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক সংযোগ উন্নত করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করতে সম্মত হয়েছেন। ভারত পশ্চিমবঙ্গের হিলি থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ পর্যন্ত একটি মহাসড়কসহ নতুন উপআঞ্চলিক সংযোগ প্রকল্প শুরু করতে সহযোগিতার জন্য অনুরোধ করেছে বাংলাদেশকে।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তির সুবিধা পেতে হলে বন্দর অবকাঠামো উন্নয়ন, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, সড়ক যোগাযোগ সহজ করা এবং কাস্টমস ও শুল্ক আদায়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা বৃদ্ধি এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। তাতে একইসঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যও সম্প্রসারিত হবে। পাশাপাশি ভারতের করিডর ব্যবহারের সুযোগ পেলে নেপাল ও ভুটান কলকাতার পরিবর্তে বাংলাদেশের মোংলা বন্দরের মাধ্যমে পণ্য আমদানি করলে তাদের পরিবহন খরচ এবং ট্রানজিট মাসুলও কমবে। আর উভয় পক্ষই লাভবান হওয়ায় বাংলাদেশী পণ্য আমদানিতে নেপাল ও ভুটানের আগ্রহ বাড়বে। সেইসঙ্গে পরিবহন সহজ হওয়ায় দেশ দুটিতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে। এতে ভারতের সঙ্গে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি, বিবিআইএন প্রভৃতি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সংযুক্তি বাড়বে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখবে।
বাণিজ্যিক এমনকি রাজনৈতিক কারণেও ভারতের কাছে বাংলাদেশ অতি সাম্প্রতিক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নিজস্ব অর্থনৈতিক বিকাশ এবং বহির্বিশ্বে প্রভাব সৃষ্টির পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়ে যাওয়ার কারণে এ মনোযোগ আরও বেড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বলা যায়, বাংলাদেশ এবং ভারত এই দুই দেশের স্বার্থ এখন জড়িত হয়ে পড়েছে আঞ্চলিক শক্তি এবং অর্থনৈতিক অংশীদার হওয়ার কারণেই। তাই কূটনৈতিক দর-কষাকষির মাধ্যমে এই সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে ভারত-বাংলাদেশ উভয় দেশই লাভবান হবে।