হাসান হামিদ
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির সকাল বেলা। মুক্তধারা প্রকাশনীর কর্ণধার চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গনে বটতলায় এক টুকরো চট বিছালেন। তাতে রাখলেন ৩২টি বই। বইগুলো কলকাতা থেকে আনা। সেগুলোই সাজিয়ে সেদিন তিনি আজকের বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। আর এই ৩২টি বই ছিলো চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা। ভাবনা আসে মনে; সেদিন চিত্তরঞ্জন সাহা এক টুকরো চটের উপর কয়েকটি বই সাজিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে যে মেলার সূচনা করেছিলেন, সেই মেলা আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলা বইমেলাকে এখানে দাঁড় করিয়ে আমরা আরো একটু পেছনে তাকাবো এবার।
আসলে বই আমাদের খুব প্রয়োজনীয় ও বিশ্বস্থ; সভ্যতা বিকাশের একেবারে শুরু থেকে এটি মানবজীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বলা যায়, সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ নিজেকে প্রকাশ করার তাগিদে বইকে আঁকড়ে ধরেছে অন্যের থেকে নিজেকে আলাদা করতে। অক্ষর আবিষ্কারের পর থেকে মানুষ মনের ভাব লিখতে শুরু করে গাছের ছাল-বাকল, পাতা, পাহাড়-গাত্রে অথবা পাথরে।
সভ্যতার ইতিহাস বলে, মিশরীয়রা নল খাগড়া জাতীয় গাছের কাণ্ড থেকে প্রথম কাগজ বানাতে শিখে ফেলে। সেই কাগজের ওপর মিশরীয়রা লিখতো। প্যাপিরাস নামক গাছের বাকল থেকে এই কাগজ তৈরি হত। প্রাচীন গ্রিকে সাইপ্রাস পেপিরাস নামক উদ্ভিদ থেকে প্যাপিরাস শব্দটি এসেছে। গ্রিকরা তাই এই জিনিসের নাম দেয় প্যাপিরাস। আর এই প্যাপিরাস থেকে আসে বর্তমানে চালু ‘পেপার’ শব্দটি। তবে বইয়ের জগতের ধারণা বদলে যায় মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারের পর। খ্রিষ্টীয় পনেরো শতকে জার্মানির ইয়োহানেস গুটেনবার্গ বানালেন ছাপাখানা। ফলে দিন দিন বইয়ের প্রচার ও প্রসার বাড়তে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে ছাপাখানার বিস্তার ঘটে ১৭৭৮ সালে। পর্তুগিজ নাগরিক ন্যাথালিয়েন ব্রাসি হ্যালহেড এদেশে বসবাসকারী অভারতীয়দের বাংলা শেখার জন্য একটি বই লেখেন। পর্তুগিজ ও বাংলা ভাষার মিলিত ব্যাকরণ বই। সে বইয়ের বাংলা উদাহরণ দেওয়ার জন্যই প্রথম বাংলা হরফ ছাপা হয়। এরপর বাংলাদেশেও মুদ্রণশিল্প বিকাশ লাভ করে। ছাপা শুরু হয় বই।
ধারণা করা হয়, প্রথম বইমেলার আসর বসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে ১৮০২ সালে। ম্যাথু কেরির উদ্যোগে এই আয়োজন হয়েছিল। এর অনেক পরে প্রায় ১০০ জন প্রকাশক মিলে নিউইয়র্কে বইমেলার আয়োজন করে ১৮৭৫ সালে। সেই মেলায় প্রদর্শিত হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার বই। ১৯৪৯ সালে শুরু হয় জার্মানির ফ্রাংকফুর্টের বৃহৎ বইমেলা, যা পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক বইমেলায় রূপ নেয়। সেখান থেকেই আধুনিক বইমেলার শুরু হয়। বর্তমানে লন্ডন, কানাডাসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক মানের বইমেলার আয়োজন করা হয়।
১৯৭১ সালে আমাদের দেশে বড় একটা যুদ্ধ হলো। এ যুদ্ধের সময় অনেক লেখক, শিল্পী ও সাংবাদিককে শরণার্থী হিসেবে কলকাতায় অবস্থান করতে হয়েছিল। সেই শরণার্থী লেখকরা নিয়মিতভাবে একত্র হতেন জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের কলকাতার বাসায়। আর সেই আড্ডায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সাহা উপস্থিত থাকতেন । এভাবে একদিন ভাবলেন নির্বাসিত লেখকদের বই প্রকাশ করবেন। ঠিক সেই সময় চিত্তরঞ্জন সাহা ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ নামে কলকাতায় একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থাটি পরবর্তীতে ‘মুক্তধারা প্রকাশনী’তে পরিণত হয়। এরপর ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ থেকে বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়। চিত্তরঞ্জন সাহা কলকাতা থেকে সেই বইগুলো আনেন বাংলাদেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে বর্ধমান হাউজের বটতলায় শরণার্থী লেখকদের লেখা সেসব বই বিক্রি করা শুরু করেন। তিনি চার-পাঁচ বছর পর্যন্ত এই চর্চা একাই চালিয়ে যান। পরবর্তীতে অন্য প্রকাশনীরাও তার সাথে যুক্ত হয়। ১৯৭৬ সালে কিছু প্রকাশক আসেন এবং বাংলা একাডেমি এর সাথে যুক্ত হয় দুই বছর পরই। কালক্রমে সেই বইমেলা আজকের এই গৌরবময় অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
তবে ইতিহাস বলে এরও আগে বইমেলা হয়েছিল, অবশ্য সেটি ছিল বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ। এমন একটি বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সালে। সে সময়ে বই মেলার কথা মাথায় আসে সরদার জয়েনউদদীনের। তিনি ছিলেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক। এর আগে তিনি কাজ করতেন বাংলা একাডেমিতে। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের লেখা একটি প্রবন্ধে ওঠে এসেছে এ নিয়ে কিছু তথ্য। তিনি লিখেছেন, বাংলা একাডেমিতে সেই সময় প্রচুর ইংরেজি বইয়ের সংগ্রহ ছিল। একদিন ‘ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ন্ড অব বুকস’ নামে একটি বই সরদার জয়েনউদদীনের হাতে আসে। এই বইটি পড়তে গিয়ে চমৎকার দুটি শব্দের সাথে পরিচিত হন তিনি। শব্দ দুটি হচ্ছে ‘বুক’ ও ‘ফেয়ার’।
তিনি ভাবলেন, আসলেই তো! বইয়েরও তো মেলা হতে পারে। জগতে কত হাবিজাবি জিনিসের মেলা হয়, সেখানে বই কী দোষ করলো? তিনি বইটি পড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বইয়ের মেলার একটি সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেলে তা একটি জাতির জন্য কতটা ইতিবাচক হতে পারে। এই বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীর নীচতলায় বইয়ের ছোটখাটো একটি মেলা বা প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। এই আয়োজনের বইগুলো ছিল শিশুতোষ। শিশুতোষ হবার কারণ, ঐ সময়ে তিনি ইউনেস্কোর অধীনে শিশু-কিশোরদের গ্রন্থ বিষয়ক একটি কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এটি ছিল ১৯৬৫ সালের ঘটনা। রেকর্ড অনুসারে এটিই বাংলাদেশে বই বিষয়ক প্রথম মেলা। আর এর মূলে ছিলেন সরদার জয়েনউদদীন।
তবে বিশেষ এই বইমেলার ঘটনাটি ছিল ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে। ততদিনে চিত্তরঞ্জন সাহা সহ অন্যান্যরা বইমেলার আয়োজন করে ফেলেছেন। হতে পারে সেটা বাংলা একাডেমির সীমানার বাইরে, কিন্তু তাদের হাতে মেলার শুরু হয়ে গিয়েছিল ফেব্রুয়ারিতেই। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের একটি প্রবন্ধ অনুসারে, ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে বই সাজিয়ে চিত্তরঞ্জন সাহাই প্রথমে বই নিয়ে বসে যাননি। প্রথম এর শুরু করেন স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স-এর রুহুল আমিন নিজামী। তখনকার সময়ে রাশিয়ান বইয়ের খুব প্রচলন ছিল। রাশিয়ায় ছাপা প্রগতি ও রাদুগা প্রকাশনীর বই বেশ চলতো। উচ্চ সাহিত্যমানের এই বইগুলো ছিল বেশ স্বল্প মূল্যের। তাই চলতোও বেশি। সেসব বই নিয়েই বসেছিলেন রুহুল আমিন নিজামী। উনাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে আসেন মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা।
আমাদের দেশে বইমেলা সেই মেলাগুলো ‘বাৎসরিক বইমেলা’ বা ‘ঢাকার বইমেলা’ এরকম নামে চলছিল। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে একুশের চেতনার সাথে বইমেলাকে মোড়ানো হয়। বাংলা একাডেমির সেই সময়ের মহাপরিচালক মনজুরে মওলা ১৯৮৩ সালে বইমেলাকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ হিসেবে আয়োজন করার চেষ্টা করেন। একটি দুর্ঘটনার রেশ ধরে ঐ বছর ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। তবে এরপর থেকে গ্রন্থমেলা নিয়মিতই হয়ে আসছে।
আমাদের আজকের বইমেলা প্রথম দিকে হতো এক সপ্তাহব্যাপী। ফেব্রুয়ারির ১৫ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত। এই সময়ে বাংলা একাডেমির বইগুলোর উপর বিশেষ ছাড় থাকতো। পরবর্তীতে মেলা ১ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। মোট ২১ দিন। মাঝে একসময় ২১ দিন থেকে কমিয়ে ১৪ দিনেও আনা হয়। কিন্তু প্রকাশকদের দাবির মুখে পরের বছরই সেটি ২১ দিন পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়। পরবর্তীতে অমর একুশে গ্রন্থমেলা যখন শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়, তখন প্রকাশকরা চাইলেন মেলা মাসব্যাপী হোক। তাদের এ দাবির মুখে ২১ দিন থেকে বাড়িয়ে পুরো ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। ২০১৯ সালেও সবার দাবির ওপর ২ দিন বাড়ানো হয় বইমেলা।
একটা সময় ছিল মেলা বাংলা একাডেমির ভেতরেই হতো। একদম শুরুতে প্রকাশক ছিলেন কম। চুন দিয়ে মাটিতে ও দেয়ালে বিভাজক তৈরি করে প্রকাশকদের স্থান আলাদা করে দেয়া হতো। এখন অনেক প্রকাশকের সমাগম হয় একুশে বইমেলায়। তাছাড়া প্রচুর লোকসমাগমের কারণে বাংলা একাডেমিতে স্থানের সংকুলান হচ্ছিল না। এসব দিক বিবেচনা করে ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমির অদূরে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে মেলাকে স্থানান্তরিত করা হয়। এর ফলে মেলা বেশ সম্প্রসারিত হয়। বর্তমানে ফেব্রুয়ারি মাসে অনেক জেলা শহরেও মেলা আয়োজনের খবর পাওয়া যায়।
ভাবলে খুব ভালো লাগে, একদিন ফুটপাতে চটের উপর যে মেলা শুরু হয়েছিল, সেই মেলায় আজ কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, শত শত বর্ণিল স্টল, দেশ-বিদেশের হাজারো মানুষের ঢল এবং দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।
প্রকাশিত পত্রিকা- ম্যাগাজিন নান্দিক, ২য় সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১৯