প্রশ্ন ফাঁসের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল হবে না?

হাসান হামিদ

গত ২৪ ও ৩১ মে  অনুষ্ঠিত প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার  প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আমরা স্বাভাবিকভাবেই সেই খবর পড়েছি। আর কয়েক দিন আগে ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে এ নিয়ে কিছু মানুষের কাছে এ তথ্যটি আবার জেনেছি। তারা বলছিলেন, এবার প্রশ্ন কেনার লেনদেন ২০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত নাকি হয়েছে। এই খবর মিথ্যা হোক, তা মনে প্রাণে চাই। হয়তো মিথ্যাই, তবু শুনে আমি আঁতকে উঠেছি।

আমার এই উদ্বিগ্ন হবার মূল কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরিটি সাধারণ অন্য দশটা চাকরির মতোন নয়। আর এই পেশায় আসার আগেই যদি প্রক্রিয়াটির কেনাবেচার খরিদদার হয়ে চাকরিপ্রার্থী এখানে নিয়োজিত হন, তাহলে তিনি অসৎ পথেই শুধু নিয়োগ পেলেন তা নয়; যে যোগ্য তাকে পেছনে ফেলে টাকায় প্রশ্নকেনা ব্যক্তিটি এ পদে যোগ দিয়ে এই ব্যবস্থাকে কলংকিত হবার পাশাপাশি ভয়ানক এক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিলেন।

অদ্ভূত বিষয় হলো, আমাদের দেশে শিক্ষকতা পেশাকে অন্য অনেকগুলোর থেকে একটু নীচু ভাবা হয়। সরকারি চাকরিতে একটি ছেলে বা মেয়ে যখন অন্য চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্ছিত হয়, তখন সে শিক্ষক হয়। তাতেও শোনা যায়, ‘দেখি, অন্যদিকে ট্রাই করছি’ এমন বাক্য! শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলায় কিছুটা আলাদা, যদিও আজকাল সেখানে দলীয় রাজনীতির হস্তক্ষেপ ভয়াবহভাবে পড়ে তাও নষ্ট হবার পথে। অথচ উন্নত দেশগুলোতে  শিক্ষকতা খুবই সম্মানের। আর হবে না কেন? সেখানে শিক্ষক হবার জন্য যে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়, তা মোটেও সহজসাধ্য নয়। সেই দেশগুলোতে যারা শিক্ষক হতে চায়, স্কুল পাশ করার পরই শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা শুরু করতে হয় তাদের। আর শিশুশিক্ষায় নিযুক্ত হতে চাইলে শিশুশিক্ষার সংশ্লিষ্ট এক বা একাধিক বিষয়ে ডিপ্লোমা নিতে হয় সবার আগে। সেজন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশেষায়িত কলেজে ভর্তি হতে হয়। এই ডিপ্লোমা বা আরও উচ্চতর অ্যাকাডেমিক যোগ্যতা থাকলে তবেই ‘টিচিং লাইসেন্স’ পাওয়া যায়। উন্নত সেসব দেশে অ্যাকাডেমিক যোগ্যতা ও ব্যবহারিক দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের ‘টিচিং লাইসেন্স’ দেওয়া হয়, যার মেয়াদও বিভিন্ন রকমের। এই ‘টিচিং লাইসেন্স’ সময়ে সময়ে নবায়ন করা লাগে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে। ‘টিচিং লাইসেন্স’ পেলে তবেই নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যায়। এরপর কোনো অভিজ্ঞ শিক্ষকের সাথে এক বছর শিক্ষানবীশ হিসেবে কাজ করতে হয়। ওই শিক্ষক এক বছরের কাজের ওপর নির্ভর করে প্রত্যয়ন দেন শিক্ষক হতে পারবেন কিনা। তারপর নিয়োগ দেওয়া হয়।

নিয়োগের পর নির্দিষ্ট সময় পরপর নিয়মিতভাবে তাকে যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হয়। একজন শিক্ষক কোনোপ্রকার অসততার দায়ে দোষী হলে তার ‘টিচিং লাইসেন্স’ বাতিল করা হয় এবং তিনি আর কখনোই শিক্ষক হতে পারেন না। উন্নত দেশগুলোতে এই হলো মোটাদাগে শিক্ষক হওয়ার প্রক্রিয়া। সেখানে আমাদের দেশের মতো সহজে বৃত্ত ভরাট করেই শিক্ষক হওয়া যায় না।

আর এবার আমাদের দেশে যা ঘটেছে তা যদিও খুব নতুন নয়, কিন্তু শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে হওয়ায় এবং পরীক্ষাটি এখন পর্যন্ত বাতিল না হওয়ায় আমাদের আশংখা হচ্ছে অযোগ্য ও অসৎ চাকরিপ্রার্থীরা এবার নিয়োগ পেয়ে যান কিনা! গত ২৪ মে  প্রথম ধাপে ১১ জেলায় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এমনকি সাতক্ষীরায় চক্রের ২৯ সদস্য আটক, ব্যাংক কর্মকর্তা ও শিক্ষকসহ ২১ জনকে দণ্ড, ১০-১২ লাখ টাকার বিনিময়ে মোবাইলে প্রশ্ন বলে দেয়া হচ্ছিল, পটুয়াখালীতে স্ত্রীকে নকল সরবরাহ করতে গিয়ে ধরা পুলিশ কর্মকর্তা এই খবরগুলো আমরা পত্রিকায় পড়েছি। কিন্তু বিভিন্ন এমাউন্টে একাউন্ট পূর্ণ করে যারা প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা দিয়েছেন, তাদের কয়জনের খবর কে জানে! এরপর ৩১ মে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপেও প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে এবং আটক হয়েছেন ৩৩ জন। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, পটুয়াখালীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে ৩৩ জনকে আটক করেছিল পুলিশ।

আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এবার নাকি একটি প্রশ্নপত্র করা হলেও বিন্যাস পরিবর্তন করে সেট করা হয়েছে ৮টি। ওই প্রশ্ন এনক্রিপ্ট ফরমেটে দুই ভাগে একটি ডিসি এবং আরেকটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়। পরে দু’জনে একত্রিত হয়ে বিশেষ পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে ডাউনলোড করে পরীক্ষার আগের রাতে ছাপানোর ব্যবস্থা নেন। কিন্তু আমার মনে হয়, প্রশ্ন যদি আগেই ফাঁস হয় আর প্রার্থী উত্তর মুখস্থ করে আসে, সেক্ষেত্রে শুধু আলাদা সেট করে কোনো লাভ আছে কি?

এবারের পরীক্ষার তত্ত্বাবধান করছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম-আল-হোসেন। তিনি পত্রিকাগুলোকে বলেছেন, একটি বড় কমিটি প্রশ্ন তৈরির কাজ করে। তাদের মধ্যে ৮ জন মিলে যদি ৫টি করে প্রশ্নও মুখস্থ করেন তাহলেও ৪০টি প্রশ্ন হয়ে যায়। তবে এবারের অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতে আরও ত্রুটিমুক্ত পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। সেটি না হয় নেয়া গেল, কিন্তু এবার যারা প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা দিল, তাদের কী হবে?

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয়। আর প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু হয় রাষ্ট্রপতি এরশাদের আমল থেকে। সামরিক শাসনের প্রথমদিকে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান ড. আ. মজিদ খান। তিনি নাকি প্রার্থীদের আবেদনের ওপর স্বাক্ষর করে দিলেই শিক্ষকরা নিয়োগপত্র পেয়ে যেতেন। পরবর্তীকালে উপজেলা পরিষদ শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা পেয়ে শুরু হয় প্রাথমিকে অবাধ শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য।

এরশাদের আমলে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি সম্মেলন হয় বর্তমান সচিবালয়ের অপর পাশের বিশাল খালি জায়গায়; রমনা রেলওয়ে ময়দানে। আগের রাতে ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কাদা-পানিতে ঐক্যবদ্ধভাবে লাখ লাখ শিক্ষক অবস্থান করেছিলেন। সেদিনের সমাবেশ সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি এরশাদ বলেন, ‘আপনাদের নেতা সমাবেশ-মহাসমাবেশ কাকে বলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।’ সেদিন প্রাথমিক শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট, পোষ্য কোটাসহ প্রাথমিক শিক্ষকদের অসংখ্য দাবি বাস্তবায়িত হয়।

সেসময় বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক আবুল কালাম আযাদ। তিনি ১৯৭৫ সালের পর রাজনীতিতে বিতর্কিত ব্যক্তি হওয়ায় ধীরে ধীরে বিশাল ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মরহুম আযাদ তার বক্তব্যে উপজেলা কর্তৃক শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতির কথা রাষ্ট্রপতি এরশাদের সমীপে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘একজন ঠিকাদার লাখ লাখ টাকা দুর্নীতি করলেও সাধারণ মানুষের অজানা থাকে। অথচ শিক্ষক নিয়োগের ঘুষের টাকা জোগাড় করতে গ্রামের মানুষ জমি-পশু-গাছ বিক্রি করে। গ্রামের পর গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, অমুকের সন্তান ঘুষ দিয়ে মাস্টারির চাকরি পেয়েছে।’ সম্মেলনের পর থেকে উপজেলার কাছ থেকে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা মহাপরিচালক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে ন্যস্ত হয়। তৎকালীন মহাপরিচালক ড. জহিরুল ইসলাম ভূঞা ও আজিজ আহম্মেদ চৌধুরীর কঠোর ব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ একটি কাঠামো পায়।

আমাদের দেশের সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের সময়ে সুষ্ঠু ও কড়াকড়ি নজরদারির ফলে প্রশ্নফাঁস শূন্যের কোঠায় চলে আসে। বর্তমানে শিক্ষক সংকটে অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় বেহাল। সর্বোপরি প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যাগুলো দূরীকরণে সংশ্লিষ্টদের মারাত্মক অবহেলা চোখে পড়ার মতো। সম্প্রতি ২৪ ও ৩১ মে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে মূল চক্রকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং পরীক্ষাটি আবার নেওয়া জরুরি। প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর চার নম্বর ধারায় এই শাস্তির বিধান রয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের নজির রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোন গ্রেফতারকৃত অপরাধীর শাস্তির রায় পাওয়া যায়নি একথা ভাবলে খারাপ লাগে।

আমাদের এই সুন্দর বাংলাদেশ অযুত সম্ভাবনার এক সোনালি দেশ। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও উন্নতির স্বর্ণশিখরে উঠতে পারিনি আমরা। এর মূল কারণ আমাদের অপরিকল্পিত শিক্ষা কাঠামো ও শিক্ষাব্যবস্থা। সমৃদ্ধ দেশ গঠনে প্রয়োজন দক্ষ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক ও সুশিক্ষিত জনসমষ্টি। কিন্তু এভাবে প্রশ্ন ফাঁস হওয়া পরীক্ষায় শিক্ষক নিয়োগ হলে সেই জনসমষ্টি আমরা কোথায় পাব?

প্রকাশিত পত্রিকা-  শিক্ষাবার্তা, ১০ জুন, ২০১৯

প্রশ্ন ফাঁসের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল হবে না?
Scroll to top