হাসান হামিদ
ছোটবেলায় আমরা শুনতাম, ইংরেজি বা গণিতটা ঠিকমতো করো, নইলে চাকরি পাবে না! কিংবা ক্লাসের ভালো ছাত্র হলে তাদেরই কেবল বিজ্ঞানে পড়ার অদ্ভুত রেওয়াজ আমাদের দেশে অনেক দিন ধরেই প্রচলিত। তারপর দেখা গেল, বিজ্ঞান বিভাগের ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো কেমেস্ট্রি নিয়ে পড়লো। স্নাতকোত্তরের পর সে চাকরি নিল ব্যাংকে। টাকা পয়সার হিসাব রেখে আর ব্যাংকিং খাতের কর্মী হিসেবে জীবন পার করে দিল। তাহলে কেমেস্ট্রি পড়ে তার কী লাভ হলো, আর দেশের কী লোকসান হলো। এই চক্র বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে চলছে। কিন্তু এর অবসানে কোন খাতে কত লোক দরকার তার একটা মোটামুটি হিসাব করে সেভাবেই শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সবকিছু সাজানো উচিত। নইলে বাড়বে বেকারত্ব, দেশ পিছিয়ে থাকবে সব জায়গায়।
কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত আমার এক বড় ভাই তার ছোট ভাইয়ের সিভি আমার কাছে পাঠালেন। তিনি সেই সাথে বললেন, ছেলেটির কোনো একটা চাকরির যেনো ব্যবস্থা করে দিই। আমি মোটেও কাউকে চাকরি দিতে পারি এমন কেউ নই। বারবার ব্যাপারটি বলার পরও আমাকে তিনি সিভি দিলেন; এবং কোনো সুযোগ থাকলে চেষ্টা করতে বললেন।
আমি খুব সামান্য বেসরকারি চাকুরে। তবু পরিচিত বড় ভাইয়ের জবরদস্তির কারণে সিভিটি আমি রিসিভ করলাম। দেখলাম ছেলেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছে। আমি ধরেই নিলাম, ছেলেটি বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর আমাদের দেশে একটা মেধাবী তরুণকে আমরা কীভাবে তৈরি করছি, কোন খাতের জন্য, আগামী শিল্পবিপ্লবে এই শিক্ষা নিয়ে আমরা প্রতিযোগিতায় যেতে পারবো কিনা এসব আমাদের কর্তাদের ভাবনায় সম্ভবত নেই। বিভিন্ন সময়ে নানা বিষয় খুলে ছেলেমেয়েদের এমএ পাশ করিয়ে চলছে দেশ? কী সেই এমএ-দের যোগ্যতা?
ছেলেমেয়েদের কিন্তু দোষ নেই। আমাদের বাবা-মা তথা অভিভাবকরা চা খেতে খেতে এখনো প্রাইভেট নাকি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো সেই তর্ক করছেন! আর শিক্ষা পরিকল্পনা আমাদের দেশে যে একেবারেই নেই, তা আপনি শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোতে বিভিন্ন বিষয় খুলে স্নাতকোত্তর হওয়ার পরিসংখ্যান দেখলেই টের পাবেন!
এই মুহুর্তে এদেশে স্নাতক পর্যায়ে পড়ছেন মোটামুটি ৩৫ লাখ ছেলেমেয়ে। তারা উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। তারপর? সেই উচ্চশিক্ষা কীভাবে কাজে লাগাবে দেশ; কোন খাতে, ছেলেমেয়েরা দক্ষ হচ্ছে কীসে? এসব ভাবনায় নেই। সবাই ঝুঁকছে সরকারি চাকরিতে। হ্যাঁ, সরকারি সেবা মানুষের কাছে পৌছানোর কাজের সুযোগ পেলে আপনার বিশেষ দক্ষতার দরকার হবে না এটা ঠিক। কিন্তু দেশের অর্থনীতির ৮২% যেখানে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে শুধু সরকারি খাতের চিন্তা করলে তো হবে না। সরকার আপনাকে বেতন দেবে, সেই টাকা আসবে কোথা থেকে? সবচেয়ে বড় কথা, ৫০ বছরেও আগে যা হয়নি, তা মাত্র ৪ বছরে করেছে ইন্টারনেট। সেই দিন খুব বেশি দূরে নয়, যখন আপনি এমএ না এমবিএ তা নয়; জিজ্ঞেস করা হবে আপনি কী পারেন? সুইডেন ও ডেনমার্ক কাগুজে নোটের ব্যাংক বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। আপনি না চাইলেও, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কিন্তু কড়া নাড়ছে। আমাদের যে শিক্ষা, সেই শিক্ষা লাখ লাখ কম প্রয়োজনীয় বিষয়ে স্নাতকোত্তর জন্ম দিচ্ছে। এই শিক্ষা কি আসন্ন শিল্পবিপ্লব মোকাবিলার জন্য উপযুক্ত?
‘দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন’ নামে একটা বই আছে। বইটি লিখেছেন বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা শোয়াব। আমাদের এই পৃথিবী একসময় আদিম সাম্যবাদী সমাজ ছিল। লাঙ্গল আবিষ্কার হলো, কৃষির প্রচলন ঘটল, সেখান থেকে এলো সামন্ততন্ত্র পৃথিবীকে চমক লাগানো জেমস ওয়াটের স্টিম ইঞ্জিন। লেখকের মতে, এসব প্রথম শিল্পবিপ্লব। তারপর বিদ্যুৎ, রেডিও, টেলিভিশন এসব দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। তারপর ডিজিটাল যুগ ও ইন্টারনেট। এটা তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। আবার বর্তমান সময়ের ফেসবুক, টুইটার অনেকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ধরলেও অর্থনীতিবিদরা এসবকে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সংস্কার বলে অভিহিত করছেন। মজার ব্যাপার হলো, কস শোয়াব তার বইয়ে ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীতে কী কী নতুন বাস্তবতা দেখা দেবে সেসবের একটি তালিকা দিয়েছেন। তার মধ্যে কিছু হলো ২০২৫ সালের মধ্যে শরীরে মোবাইল ফোন বসানো হবে। বর্তমানের প্রেসমেকারের মতোই অনেকটা। তাতে আমাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে কিন্তু ক্ষতি হবে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের একাধিক ডিজিটাল ঠিকানা থাকবে, তাতে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাড়বে। তেমনি বাড়বে এ সংক্রান্ত অপরাধ, থাকবে চশমার সাথে ইন্টারনেট যুক্ত, পোশাকের সাথে ইন্টারনেট যুক্ত, ‘ইন্টারনেট অব থিংস।’ ইন্টারনেট অব থিংস’ সব জিনিসই ইন্টারনেট যুক্ত থাকবে। সব ইন্টারনেটে যুক্ত থাকবে যেমন- চালকবিহীন গাড়ি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বা, বিটকয়েন ব্লকচেইন। বিকল্প টাকা। ত্রিমাত্রিক প্রিন্টারের মাধ্যমে মানুষের চিকিৎসা হবে। থ্রি-ডি প্রিন্টারের থেকে নেয়া যকৃত মানুষের শরীরে বসানো হবে। প্রথম মানব শিশু জন্ম নিবে, যার জিনোম কৃত্রিমভাবে উন্নতর করা হয়েছে। তার মানে বোঝা যাচ্ছে আগামী সাত বছরের মধ্যে পৃথিবীর হাজারও না ঘটা সব বিষয় ঘটতে যাচ্ছে। যার মধ্যে অনেকগুলো বিষয় এখনই চলে এসেছে। আর এগুলো পরিবর্তন হলে আমাদের কি হবে? ক্যাশিয়ার থাকবে না, থাকবে না এখনকার ব্যাংক ব্যবস্থা, থাকবে না আরও অনেক কিছু যা আমরা এখন বুঝতেছি না। আমরা শিখে চলেছি, কী শিখছি এবং কেনো সেই প্রশ্ন কেউ করছি না!
শোয়াব চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে নিজের লেখা একটি প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমরা চাই বা না চাই, এত দিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম এবং চিন্তা-চেতনা যেভাবে চলেছে, তা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি’। বিশ্বব্যাংকের ‘ডিজিটাল ডিভিডেন্ডস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনেও ডিজিটাল বিপ্লব সম্পর্কে নানা বিষয় উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন একদিনে বিশ্বে ২০ হাজার ৭০০ কোটি ই-মেইল পাঠানো হয় এবং গুগলে ৪২০ কোটি বার বিভিন্ন বিষয় খোঁজা হয়। একযুগ আগেও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনগুলো ছিল অকল্পনীয়।
আপনি আশেপাশে তাকালেই টের পাবেন, ডিজিটালাইজেশন এরই মধ্যে সর্বক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আগামী ১০ বছরে ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে এমন সব পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে হবে, যা এর আগে কখনো সম্ভব হয়নি। বিশ্বের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কী প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে দুই ধরনের মত পাওয়া যাচ্ছে। একদল বিশেষজ্ঞ বলছেন, এতে সব মানুষেরই আয়ের পরিমাণ ও জীবনমান বাড়বে। বিশ্বের পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়ায়ও ডিজিটাল প্রযুক্তি আনবে ব্যাপক পরিবর্তন। এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য পাঠানোর খরচ অনেক কমে আসবে এবং ইতিবাচক প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। আবার অন্য একদল অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ডিজিটাল বিপ্লব বিশ্বের অসাম্য ও দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে আরো দুর্বিষহ পর্যায়ে নিয়ে যাবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে মানুষের অনেক কাজ রোবট ও যন্ত্রপাতি দিয়ে করা হবে। ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তা সমস্যা তৈরি করবে। এছাড়া শ্রমবাজারে অল্প কর্মদক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা ও বাজার কমে যাবে যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সমস্যায় ফেলবে।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস প্রবাসী শ্রমিকদের আয়। আজ আমরা লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে যাচ্ছি গ্যারেজ কিংবা কলকারখানায় কাজ করতে, তখন ওই কাজ তো যন্ত্র করবে। অটোমেশন সর্বত্র হবে। নির্মাণ খাতেও হবে। আমাদের এই মানুষগুলো কাজ হারাবে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে ২০২৫ সালের মধ্যেই বাংলাদেশে বেকারত্ব আরও বাড়বে, সাথে আসবে একটি বিপর্যয়। যদি না আমরা এ বিষয় মাথায় রেখে অগ্রসর হই।
তাহলে আমরা কী করবো? আমাদের বিজ্ঞাননির্ভর আগামী বাজারের উপযোগী শিক্ষা দিতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ঝড়কে মোকাবিলা করতে হলে আমাদেরকে বিজ্ঞানের আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং নির্ভর হতে হবে ইন্টারনেটভিত্তিক কাজে, তথ্য প্রযুক্তি খাতে দক্ষ মানব সম্পদ গড়তে হবে এবং অবশ্যই আগামী এক দশক পর কোন খাতে কী পরিমাণ দক্ষ লোক লাগবে সেই হিসেব করে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। এইসব প্রচলিত ধারণা, ভুল সামাজিক বার্তা এবং পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে থাকার সর্বনাশা বিষয় আমাদের পাশ কাটিয়ে যেতে হবে।
নইলে ডিজিটাল বিপ্লবের পুরোধা জুড়ে থাকা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা এবং তথ্য-প্রযুক্তির সকল অনুষঙ্গ আমাদের বোকা ও অপ্রয়োজনীয় করে তুলবে। বাড়বে বেকার, কাজ পাবে না; আর এইসব অপ্রয়োজনীয় শিক্ষা, চাকরির নামে অযথা গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করা ফালতু প্রস্তুতি দেশ এগিয়ে নিতে পারবে না।
একসময় সারা পৃথিবীতেই মানুষ কোনোকিছু জানতে অন্য মানুষের দ্বারস্থ হত, চিঠি পাঠাত মনের ভাব প্রকাশ করতো। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, কিভাবে মানুষের জীবনধারার পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি, সমাজ, বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদির ওপর যে বিশাল প্রভাব পড়বে তা খুব স্বাভাবিক।
আপনি নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বলতে যেটি বোঝানো হচ্ছে তা হলো সমাজ এবং অর্থনীতির বিভিন্ন অনুষঙ্গের নিরবচ্ছিন্ন প্রযুক্তিগত রূপান্তর। প্রতিটি ক্ষেত্রে রোবটিক্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার কীভাবে মানুষের কল্যাণে আসতে পারে। প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা-প্রশাখা কীভাবে মানবজীবনকে বদলে দিতে পারে ও কীভাবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হতে পারে এ সব কিছুই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের ইন্টারনেট আলোড়নের ছোঁয়া আমাদের দেশেও লাগছে। বাংলাদেশ যদি এখন থেকেই যথাযথ পরিকল্পনা নিতে না পারে তবে ভবিষ্যতের জন্যে অনেক সমস্যা হবে। ভবিষ্যতে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে কিনা, প্রযুক্তি উন্নতির সাথে সাথে চাকরির বাজারে কোনো সমস্যা হবে কিনা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যত কী এসব নিয়ে ভাবতে হবে। আর শিক্ষাব্যবস্থা সামনের এ বিপ্লব মোকাবিলা করতে পারবে কিনা, তা ভেবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে।
সবশেষে আমি সেই ছোট ভাইটিকে আউট সোর্সার হিসেবে একটি কাজে লাগিয়ে তার বর্তমান সমস্যার কিছুটা সমাধান করতে পেরেছি। ছেলেটি সরকারি কর্ম কমিশনে ভাইবা-টাইভা দিছে অবশ্য। কিন্তু ছেলেটি আমায় যখন বলে, ভাই, বিসিএস না হলে কী করবো? আমি কী উত্তর দেবো তাকে? বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেবার পরও সে এটা বুঝতে পারছে না, দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে যারা জাতির জন্য কাজ করছেন তাদের বেশিরভাগ বিসিএস ক্যাডার নয়। আর আগামীর পৃথিবী হবে প্রযুক্তিতে ও এরকম নানা খাতের দক্ষ মানুষদের। আমাদের শিক্ষা কি সেই পৃথিবীতে নিজের জায়গা করার উপযোগী?
প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক মানবকণ্ঠ, ১১ আগস্ট, ২০২০