সিনেমা মাঝেমধ্যে দেখলেও এ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ একসময় আমার ছিল না। ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন আমার মাথায় সিনেমা বিষয়ে বোধটি ছিল স্লোভেনীয় দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী স্লাভয় জিজেকের সেই কথার মতো, ‘‘Cinema is the ultimate pervert art. It doesn’t give you what you desire – it tells you how to desire’’ আমি টুকটাক পড়তাম, প্রথমত কবিতা কিংবা প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাস কম। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার প্রবল আগ্রহ এবং অল্প বিস্তর লেখালেখি আছে। আমার মনে পড়ছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে জাতির ধারণা কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তা নিয়ে ২০১৫ সালে অস্ট্রেলীয় চলচ্চিত্রবোদ্ধা জন হুড একটি বই লিখেন। বইটির নাম ‘দ্য ব্লিডিং লোটাস: নোশনস অব নেশন ইন বাংলাদেশি সিনেমা’ (রক্তাক্ত পদ্ম: বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে জাতির ধারণা)। সেটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয় কলাবাগানে অবস্থিত বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের মিলনায়তনে। আমি সেই অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিক বন্ধুর সাথে গিয়েছিলাম। ঘটনাক্রমে বইটি আমি পাই; এবং পড়ি। এরপর টানা কয়েক রাত জেগে আমি অনেকগুলো ফিল্ম দেখি। এর কয়েকটি আমার আগেই দেখা ছিল। কিন্তু আবারও দেখি। কিন্তু মনে হচ্ছিল, কোনো কোনো সিনেমার কিছু জায়গা আমার একেবারেই অন্য রকম লাগছে। বুঝতে পারছিলাম, এ নতুন বোধের কারণ সিনেমাভিত্তিক পাঠ। সম্প্রতি ঐতিহ্য প্রকাশিত কবি ও প্রাবন্ধিক পিয়াস মজিদের লেখা ‘আমার সিনেমাঘর’ পড়েও আমার একই বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, দেখা অনেকগুলো চলচ্চিত্র আমাকে আবার দেখতে হবে। যেসব ব্যাপারে আমি আদতে আধা অন্ধকারে ছিলাম, ঠিক সেখানে আলো ফেলছে এই বইয়ের লেখাগুলো।
‘আমার সিনেমাঘর’ বইয়ে দেশী-বিদেশী চল্লিশটি মুভি নিয়ে কবি ও প্রাবন্ধিক পিয়াস মজিদের ভাবনা ও পর্যালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণভাবে দেখলে বলে দেওয়া যায়, ‘আমার সিনেমাঘর’ বইটি মুভি রিভিউয়ের সংকলন। কিন্তু এ বইয়ে আসলে ঠিক চলচ্চিত্রের প্রচলিত রিভিউ যে রকম হয় বা এ সংক্রান্ত যেসব লেখা কিংবা সংকলন আমরা যেমন দেখি, এটি ঠিক তেমন নয়। এখানে উপভোগ করা সিনেমাকে কেন্দ্র করে পিয়াস মজিদ লিখেছেন তার নিজের অনেক গল্প এবং অনুভুতির কথা। বর্ণিত সবগুলো চলচ্চিত্র নিয়ে তার নিজস্ব ভাবনা ও উপলব্ধি রচনা করেছেন ঢলঢলে ভাষায়, একেবারে আপন ভঙ্গিতে। যা পড়লে পাঠককে চলে যেতে হয় অনেক দূরের গভীর কোনো রাজ্যে, হতে হয় মন্ত্রমুগ্ধ। প্রতিটি লেখায় বর্ণিত হয়েছে কাহিনির ভিতর আরেক কাহিনি। সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বইটিতে পিয়াস মজিদ লিখেছেন প্রিয় কয়েকজন নির্মাতা এবং অভিনেত্রীকে নিয়েও।
বইটি কীভাবে লেখা হলো, তা জানতে পারি লেখকের দেওয়া পত্রিকায় প্রকাশিত এক বয়ান থেকে। সেখানে পিয়াস মজিদ বলেছেন, ‘প্রিতম আদনান এক করোনা-কুটিল বিকেলে একটি মুভি দেখার অভিজ্ঞতা জানাতেই আমাকে বলেছিল, ঘরে বসে থাকার সময়টা যেন প্রিয় ১০০ মুভি নিয়ে নিজের ভাবনা লিখে রাখি। আমার তো আকাশ থেকে পতিতের দশা; মুভি ভালবাসি তাই বলে এত এত লেখা! কিন্তু সে-ই আমি-ই শুরু করলাম; দেখতে দেখতে বেশকিছু লেখা জমে গেল।’ লেখকের সেই জমা লেখাগুলোই ‘আমার সিনেমাঘর’।
সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “চলচ্চিত্রের অন্যতম দক্ষতা হলো মানুষের মন বোঝার এবং তার সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা এর রয়েছে।” তিনি এও বলেছেন, “আমি অনুভব করি যে নায়কের ছাঁচে থাকা মানুষের তুলনায় রাস্তায় থাকা একটি সাধারণ মানুষকে বিষয় হিসেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। তাঁদের অস্পষ্ট শব্দগুলোই আমি ধরতে চাই, আবিষ্কার করতে চাই।” আসলেই ঠিক তাই, সিনেমা হলো একেবারে অস্পষ্ট কিছু আলাদা করে আবিষ্কার করা। আবার সেই আবিষ্কারও আমরা অনেক সময় ধরতে পারি না। আমাদের কাছে অনেক দৃশ্যই কেবল একটি খণ্ডিত কাহিনি মনে হয়। কিন্তু এর ভিতরে যে জীবন, কাহিনির ভিতরে যে বক্তব্য তা অধরা থেকে যায় প্রায় সময়ই। আর পিয়াস মজিদের ‘আমার সিনেমাঘর’ পড়লে আমি নিশ্চিত বলতে পারি, পাঠক তার দেখা সিনেমাটি আবার দেখতে চাইবেন, চেনা পথ আবারও হেঁটে এমন কিছু পাবেন তা তার বোধে আগে ছিল না। লেখক পিয়াস মজিদ এখানেই সার্থক।
প্রাবন্ধিক ও গবেষক পিয়াস মজিদ চল্লিশটি সিনেমা নিয়ে দারুণ ও দুর্দান্ত ভাবনা এবং অভিজ্ঞতা লিখেছেন ‘আমার সিনেমাঘর’-এ। লেখাগুলো হলো- চেরির স্বাদ, জীবনদ্বীপ মৃত্যুদ্বীপ বা ময়নাদ্বীপ, জাদুকরের মৃত্যুকামী জীবনপ্রণালি, গুলোবো সিতাবো কিংবা পুতুলনাচের ইতিকথা, ম্যাডলি বাঙালি আর আমাদের গান তানিয়া, আগুনের বাগান, ছাইয়ের করবী; লোরকা ও দালি, মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে, বেদনার বীজ বোনা, মায়া রহিয়া যাওয়া, অলিভের ছায়া, বাড়িওয়ালির অন্তরবাড়ি, দত্ত ভার্সেস দত্ত কিংবা আমি ভার্সেস আমি, বিচ্ছিন্নতা, ভালোবাসা, বেঁচে থাকার ইতিকথা, স্মৃতি ও সত্তার সজীব ঘাসফুল, বেঁচে থাকা যখন হেরে যাওয়ার মুহুর্মুহু মহড়া, মৃত কবিদের গোত্র কিংবা নিষিদ্ধ সুন্দরের গন্ধ জীবন হোক ব্যর্থতারও, মাটির ময়নার আকাশে উড়তে চাওয়া, বোবা রাত্রি, নিঃসঙ্গতার ধ্বনি, কথা ও নীরবতার ঘ্রাণ, জীবন ও মৃত্যুর পারাপার, মৃত্যু, মার্চ ও মায়া, স্বাপ্নিকদের সাথে আগুনও নাচে, সুন্দরের নিঃশব্দ অশ্রুগল্প, মা-ছেলের মেঘের সংসার, কুরোসাওয়ার স্বপ্নের কোলাজ, সন্তানের হাসি, কান্নাপিতা চ্যাপলিন, রূপকথার ভাষা, চালচিত্রের খুঁটিনাটি, আত্মদর্পণের অনিঃশেষ ভাঙচুর, সত্যজিতের নায়ক; চেনা উত্তমের নতুনায়ন, পাখিপুর, অনন্তপুর, মহল্লার মাত্রাগুচ্ছ, স্মৃতিহীন জীবনের মানেহীনতা, আনন্দনগরের বেদনাগাথা, একটু লোডশেডিং ও অনন্ত আলোর গল্প, প্রথা-পুতুল রাজকুমারীর স্বাধীনতার স্বাদ, একাত্তরের অগ্নি-বর্ণমালা, ভুল ট্রেনে ঠিকঠাক গন্তব্যে, ঘেটুপুত্রের রক্তধারা, কান্নাবতী জলগাথা, ভগ্ন দেশ আর রক্তাক্ত হৃদয়। তিন অভিনেত্রীকে নিয়ে লিখেছেন- এবং শাবানা আজমি, দীপুর মা থেকে গ্রাম-পালানো গোলাপি নামের মেয়ে, মৌনমুখর জয়া আহসান। লিখেছেন পাঁচ পরিচালকের কথা ও কাহিনি- বোনের শাড়িতে ভাইয়ের সিনেমার স্ক্রিপ্ট, জীবনের জয়গান ও জহির রায়হান, ঝিলটুলি থেকে ‘মহাপৃথিবী’র মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কৃজনবাহার, তারেক মাসুদ: কাছের মানুষ, দূরের দেখা।
আমরা যারা সাধারণ, তারা সহজ সুন্দর সুখী একটা জীবন প্রত্যাশা করি। এক্ষেত্রে Francois Truffaut এর সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে করতে পারি, “Three films a day, three books a week and records of great music would be enough to make me happy to the day I die.” সংখ্যায় কম হোক; আসুন, বই পড়ি, সিনেমা দেখি। করোনাকালীন ঘরে বসে নিজেকে আবিষ্কার করি ভিন্ন ধারায় এবং বোধে।