পিটিআইগুলোতে প্রি-সার্ভিস কোর্স (প্রাথমিক শিক্ষা) চালু করা যায় না?

হাসান হামিদ

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষাদান বিষয়ে এক জায়গায় বলেছেন, “বিদ্যা হল আহরণের বস্তু, শিক্ষা আচরণের”। আমরা এ-বিষয়টি মাঝেমধ্যে ভুলে যাই। আমরা মনে করি, আমাদের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেলেই তো হলো, আর বিশেষ কী যোগ্যতা দরকার? মূলত পরীক্ষার ফল ভালো করা এক জিনিস; আর প্রকৃত শিক্ষা লাভ করা আরেক জিনিস। এখন অবশ্য ফলাফলকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে শিক্ষাকে একেবারে বাজারি করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে আমাদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলেও হবে না। আমাদের এখানে যারা শিক্ষক হন, তারা আদৌ তা হতে চাননি এমন সংখ্যা বেশি; এবং প্রচলিত ভুল সামাজিক কিছু বার্তায় অভিভাবকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে উহ্য করে দিচ্ছে। আর সেজন্য একটি প্রজন্ম আজ সবচেয়ে হুমকির মুখে পড়েছে। আজকের লেখার বিষয় শিক্ষক হতে চাওয়া মানুষদের এই পেশায় আনতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর ধরন সংস্করণ।

আমাদের এখানে প্রচলিত অন্য সব আইন ও ব্যবস্থার মতো শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়টিও সেই ইউরোপ থেকেই পাওয়া। ১৬৮৫ সালে ফ্রান্সে টিচার্স ট্রেনিং-এর প্রথম সূচনা করেন সেন্ট জন ব্যাপটিস্ট ডি.লা স্যাল্লে। পরবর্তীকালে জার্মান প্রোটেস্টান্ট মন্ত্রী অগাস্ট হেরমান ফ্রান্চকের (১৬৬৩-১৭৭০) উদ্যোগে এবং সুইস রিফরমার যোহান পেস্তালজ্জির (১৭৪৬-১৮২৭) সক্রিয়তায় এটি ইউরোপে বিস্তার লাভ করে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ যোসেফ ল্যাঙ্কাস্টার এবং অ্যান্ড্রু বেল কর্তৃক প্রবর্তিত মনিটরিয়াল শিক্ষা পদ্ধতিও টিচার্স ট্রেনিং ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৭১৬ সালে ডেনিশ উপনিবেশ স্থাপনকারীদের দ্বারা দক্ষিণ ভারতের ত্রিবাঙ্কুরে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নর্মাল স্কুল) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ উপমহাদেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ইতিহাস সূচিত হয়।

পরবর্তী দশকে  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে কে উপমহাদেশে শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করবে তা নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। ১৮৩৫-৩৮ সময়কালে বাংলা ও বিহারের শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উইলিয়াম অ্যাডাম তিনটি রিপোর্ট জমা দেন। তার তৃতীয় রিপোর্টে উইলিয়াম অ্যাডাম শিক্ষকদের ভাল শিক্ষাদানে উৎসাহিত করার জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের পরামর্শ দেন। তিনি  নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী, এ সকল নর্মাল স্কুলে শিক্ষকদের বছরে এক থেকে তিন মাস হিসেবে মোট চার বছর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা আবশ্যক। বিভিন্ন সময়ে প্রতিটি শিক্ষা কমিশন রিপোর্টেই শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং এ লক্ষ্যে অনেকগুলি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। আর সেগুলোর আধুনিক ও সংস্কার রুপই আজকের প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো।

বাংলাদেশের শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলিকে শিক্ষার পর্যায় বিবেচনায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান উন্নত করেছে। প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমী এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমীক প্রশাসনের অধীন। শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর এবং বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়। এছাড়া বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় অনুরূপ প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে।

আমরা জানি, আমাদের দেশে বর্তমানে প্রায় দুই কোটির বেশি শিশু প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা নিচ্ছে। তাদের মধ্যে সমাপনী পরীক্ষায় (পিইসিই) পাশ করার পর জুনিয়র, মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক স্তর বা সমমান স্তর উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চস্তরে বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক পাশ করে একটা বড় অংশ। প্রতি বছর নতুন করে পাশ করা শিক্ষার্থীদের সাথে পুরানো মিলিয়ে অনেক ছেলেমেয়ে বেকার থাকে।

প্রথম আলো পত্রিকার এক সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশের যুবক শ্রেণির মধ্যে প্রায় ৮২ শতাংশ তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে চিন্তিত। আরেকটি জরিপে দেখা যায়, বেকারদের মধ্যে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্তরাই এদেশে সংখ্যায় বেশি। আর বেকারত্বের মূল কারণ হলো, শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মূল ভিত্তির দুর্বলতা। শুধু পাশ করার জন্য বিদ্যার্জনে লাভ নেই; বরং যে শিক্ষা অন্তর দিয়ে গ্রহণ করা যায় তা বাস্তবে কাজে লাগানো যায়। সেক্ষেত্রে চাকুরি না করলেও ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণ, সৃজনশীল কিছু কাজ যেমন, লেখালেখি, গবেষণা ইত্যাদি করা সম্ভব। কিন্তু সঠিক শিক্ষা না থাকায় সেটি হচ্ছে না বললেই চলে।

এবার আসি শিক্ষকদের বিষয়ে। বর্তমানে আমাদের দেশে কারা শিক্ষক হন? তারা কি আদৌ তা হতে চেয়েছিলেন? শিক্ষক হতে না চাওয়া ব্যক্তিটি যখন শিক্ষা দিচ্ছেন, তখন তার ফল কি ভালো হবে? বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষার কি টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এসডিজি, ২০১৬-২০২০)-এর  শিক্ষাবিষয়ক লক্ষ্যটি অর্জন করতে পারার সক্ষমতা আছে? শিক্ষক নিয়োগে শুধু ভালো একাডেমিক ফলাফল করাদের আনলেই হবে না; এর মধ্যে শিক্ষক হতে চাওয়াদের এখানে যুক্ত করতে হবে।

আমাদের দেশে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় চার লাখের মতো। তাদের বেশির ভাগেরই স্নাতক ডিগ্রি রয়েছে। আমাদের জাতীয় সংবিধানের সতেরো (১৭) নং অনুচ্ছেদে প্রাথমিক স্তরে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে, সাথে সাথে গুণী ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ দানের কথা বলা হয়েছে। আমরা প্রাথমিক স্তরে সার্টিফিকেটধারী শিক্ষক পাচ্ছি, হয়তো তারা শিক্ষক হতে চাননি সবাই। তারপরেও ধরে নিলাম, তারা শিক্ষকতায় আগ্রহী; কিন্তু তারা পাঠদানে যোগ্যতাসম্পন্ন বা পেডাগজিতে (শিশুদের পাঠদান পদ্ধতির বিজ্ঞান) দক্ষ নয়। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, অনেক শিক্ষক (৪৭%) এখনো শিক্ষার্থীদের জন্য সৃজনশীল প্রশ্ন প্রস্তুত করতে পারেন না। যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন তাহলে কীভাবে তারা করবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে।

মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য পিইডিপি-৩-এর আওতায় দেশের ৬৬টি প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (পিটিআই) দেড় বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) কোর্স চালু করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ২১ হাজার ৪৯ জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এই কোর্স সম্পন্ন করেছেন। তবে এখনও তিন লাখ ৩০ হাজার ১৬৪ জন শিক্ষক এই কোর্সের আওতায় আসেনি। এর পাশাপাশি নতুন আরও শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। তাহলে আমাদের এখন মূল ভাবনাটি হলো, কাদের শিক্ষকতায় নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বা হবে?

আমার মনে হয়, সময় এসেছে নতুন করে চিন্তা করার। বিশেষ করে যেসব শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করবেন বলে ভাবছেন তাদের জন্য প্রি-সার্ভিস কোর্সের ব্যবস্থা করা। একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার এবং একটা সময় শুধু এই ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা প্রি-সার্ভিস কোর্স করবে না, তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় আসতে পারবে না। এক সময় দেখা যাবে, নতুন যেসব মেধাবী শিক্ষকতা পেশায় আসবেন তাদের শিক্ষক জীবন শিক্ষা বিষয়ক ডিগ্রির মধ্য দিয়েই শুরু হবে; যা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলংকাসহ অনেক দেশে (অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, হংকং, জাপান, সিঙ্গাপুর) শিক্ষকতায় আসতে হলে শিক্ষা বিষয়ক ডিগ্রি নিয়েই প্রবেশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেসব দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষায় অনার্স কোর্স চালু রয়েছে, যার ফল তারা ইতিমধ্যে পাওয়া শুরু করেছে। আমাদের দেশেও পিটিআই-গুলোতে প্রাইমারি এডুকেশন বিষয়ে প্রি-সার্ভিস অনার্স/ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা যায়। এখানে অনার্স/ডিপ্লোমা কোর্স করে তারপর শিক্ষার্থীরা শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় বসবে। নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নও শিক্ষা বিষয়ক (ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, নৈতিক শিক্ষা, আইসিটি, শারীরিক শিক্ষা) হলে ভালো শিক্ষক বা অন্তত শিক্ষক হতে চাওয়া শিক্ষক আমরা পাবো।

বাংলাদেশে বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের মাধ্যমেই প্রি-সার্ভিস শিক্ষক শিক্ষা সম্পর্কিত অনার্স/ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ৬৬টি পিটিআইর মাধ্যমে এই কর্মকাণ্ড শুরু করা যায়। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) সে ক্ষেত্রে সার্বিক সমন্বয়ের ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্তমান চলমান ডিপিএড কোর্সের আলোকে বর্তমান অবকাঠামো ব্যবহার করে এই কোর্স চালু করা সম্ভব। শুধু প্রয়োজন নতুন জনবল নিয়োগ (শিক্ষায় ডিগ্রি রয়েছে এমন) করে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপন্থা নির্ধারণ।

সাসটেনেইবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা চার-এ বিধৃত গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে যোগ্য শিক্ষক প্রস্তুত করার পাশাপাশি তাদের যথাযথ মর্যাদা দিয়ে সমাজে স্থান দেয়া দরকার। সর্বোপরি সরকারকে শিক্ষকবান্ধব শিক্ষা-নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে। তাই এখনই সময় ঘুরে দাঁড়ানোর। সময় এসেছে পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের। এর জন্য প্রয়োজন একটুখানি উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার। যার শুরু হতে পারে প্রি-সার্ভিস অনার্স/ডিপ্লোমা কোর্স চালুর মধ্য দিয়ে। এভাবেই আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে পারি আলোকিত বাংলাদেশ গড়ার পথে, স্বপ্ন ও উন্নয়নের সমান্তরালে।

প্রকাশিত পত্রিকা-  শিক্ষাবার্তা, ২৪ মার্চ, ২০১৯

পিটিআইগুলোতে প্রি-সার্ভিস কোর্স (প্রাথমিক শিক্ষা) চালু করা যায় না?
Scroll to top