নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বার বার কেন আন্দোলনে নামতে হবে?

হাসান হামিদ

দেশের সড়ক-মহাসড়কের সর্বত্রই চলছে মৃত্যুর মহোৎসব। একের পর এক তাজা প্রাণ হারিয়ে যাচ্ছে। থমকে যাচ্ছে বহু পরিবার। এর ভয়াবহ দৃশ্য দেখা যায় পঙ্গু হাসপাতালে গেলে। অবস্থা ‘মহামারী’ আকার ধারণ করেছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। একটি ঘটনার রেশ না কাটতেই আরেকটি ঘটছে। প্রতিদিনই দুর্ঘটনার খবর থাকছে গণমাধ্যমে। সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসানের মৃত্যুতে শিক্ষার্থীরা ৯ দফা আন্দোলনে নামেন। এর মধ্যে ২৯ নভেম্বর রাতে রামপুরায় বাসচাপায় মারা যায় এসএসসি পরীক্ষার্থী মাইনুদ্দিন ইসলাম। এরপর নিরাপদ আন্দোলনের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। তখন ছাত্রদের আন্দোলনের চাপে সড়ক পরিবহন আইন হয়েছিল ঠিক, কিন্তু পুরোপুরি প্রয়োগ করার আগেই উদ্যোগ নেওয়া হয় সেই আইন শিথিল করার। অনেকগুলো কারণেই সড়কে দুর্ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১১ মাসে মোট ৪ হাজার ২৬৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ১৪৪ জন। এর মধ্যে শিক্ষার্থী ১৪ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৩৭ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে নভেম্বর মাসে মারা গেছেন ৫৪ জন শিক্ষার্থী। এর আগে গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১১৮ শিক্ষার্থী। পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর সড়কে মৃত্যু ও দুর্ঘটনা দুই-ই বেড়েছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে ২ হাজার ২৯১ দুর্ঘটনায় ২ হাজার ২২১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে ৩ হাজার ২৫৯টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনা বেড়েছে ৪২ শতাংশ। মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।

বিগত ৬ বছরে সারা দেশে ৩১ হাজার ৭৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৯১ হাজার ৩৫৮ জন। এ ছাড়া ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণে বছরব্যাপী লকডাউনে পরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায়ও ৪ হাজার ৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত ও ৮ হাজার ৬০০ জন আহত হয়েছেন। (তথ্যসূত্র- বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রকাশিত প্রতিবেদন, ২০২১) যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৬ হাজার ৬৮৬ জনের মধ্যে ৭০৬ অর্থাৎ সাড়ে ১০ শতাংশের বেশি ছিলেন শিক্ষার্থী। পেশাওয়ারি হিসোবে চালক শ্রমিকের পর দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় শিক্ষার্থীদের। দুর্ঘটনায় নিহতদের ২৪ মারা গেছেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়, যাদের ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী।

প্রায় সারা দেশের সড়কগুলোই লক্কর-ঝক্কর মার্কা গাড়ির দখলে এখন। ফিটনেসবিহীন এ গাড়িগুলোই যেন কাঁপাচ্ছে শহরের রাজপথ থেকে শুরু করে সব রাস্তা। এ রকম গাড়ি দেশে  ঠিক কী পরিমাণ আছে তার সঠিক কোনো হিসাবও বিআরটিএ-এর কাছে নেই। তবে গত বছর প্রায় দেড় লাখ ফিটনেস নেই এমন মোটরযান চলাচল বন্ধের জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এরপর ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে বিআরটিএ অভিযান চালায়। এতে কিছু যান কমলেও এখনও রাস্তায় এমন লক্কর-ঝক্কর মার্কা গাড়ি চলছে লাখের কাছাকাছি। পরিবহন মালিক সমিতির হিসাব মতে, ঢাকায় ১৯৩টি বাস রুটে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বাস-মিনিবাস চলাচল করে। এর মধ্যে ১৫ বছরের পুরনো বাস ১ হাজারের বেশি। সেইসব ঝুকিপূর্ণ বাসগুলোকে চলাচলের জন্য আর রুট পারমিট দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু অনুমোদন ছাড়াই চলছে এসব বাস। বিআরটিএ বলছে, লক্কর-ঝক্কর মার্কা বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া অনেক দিন থেকেই বন্ধ। কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে পুরনো বাসগুলোকে আর ফিটনেস দেওয়া যায় না। ভয়াবহ ব্যাপার হল, ফিটনেসবিহীন বাসগুলোর সার্টিফিকেট না থাকলেও চলাচল কিন্তু বন্ধ হয়নি। ট্রাফিক পুলিশকে ম্যানেজ করে এসব চলাচল অনোপযোগী যান সড়কে ব্যাপকভাবে চলছে। 

সড়ক দুর্ঘটনার একটি অন্যতম কারণ হাইওয়েতে মিশ্র যানবাহন চলাচল বেড়েছে। একই সড়কে বেবী ট্যাক্সি, অটো রিকশা, টেম্পু, ভটভটি, স্যালো ইঞ্জিন চালিত গাড়ি চালানোর ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে। কঠোর হস্তে হাইওয়েতে এ ধরনের যান চলাচল বন্ধ হওয়া জরুরী। আর বর্তমানে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে যুব সমাজ হেলমেট বিহীন বিশেষ স্টাইলে লুকিং গ্লাস ব্যতীত দ্রুতগতিতে অধিক সিসি যুক্ত মোটর সাইকেল চালাচ্ছে। ফলে ঘটে যাচেছ মারত্মক দুর্ঘটনা। অনেক মা-বাবা হারাচ্ছে তাদের প্রিয় সন্তানদের। বুয়েটের গবেষণা বলছে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০ বছরের নিচে তরুণ প্রজন্মের মৃত্যুহার বেশি। কারণ তরুণদের বেশির ভাগই মোটরসাইকেল আরোহী। গবেষণা বলছে, মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার পরিমাণ ২০১৯ সালে ছিল ২০ দশমিক ২ শতাংশ। সেটা এখন ২৩ শতাংশে চলে গেছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ক্যান্সারের সেলের মতো এই যানের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু মোটরসাইকেল চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। ২০১৬ সালে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল ৮ লাখ, ২০২০ সালে সেটা ৩২ লাখে দাঁড়িয়েছে। চার বছরে মোটরসাইকেলের সংখ্যা চারগুণ বেড়েছে।

সম্প্রতি দুর্ঘটনা মহামারির আকার ধারণ করার জন্য যেসব কারণকে দায়ী করা হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চালকের অসতর্কতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো। এই সমস্যা বার বার চিহ্নিত হলেও এর কোন প্রতিকার নেই। গাড়িচালকের সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকা, দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো, ওভারটেক করাসহ বিভিন্ন কারণে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার বাড়ছে। দেশের বেশিরভাগ চালক লেখাপড়া জানে না, তাদের রোড সাইন সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা নেই। গাড়ী চালানোর সময় কোথায় ওভারটেক করা যাবে এবং কোথায় যাবে না সে বিষয়ে তাদের জানাশোনা নেই। দুর্ঘটনার আরো একটি অন্যতম কারণ হলো ঘুম ঘুম অবস্থায় গাড়ী চালনা। একজন চালকের কোন অবস্থাতেই একটানা ০৫ ঘন্টার উপর গাড়ী চালানো নিষেধ। অথচ আমাদের দেশের বাস এবং ট্রাকের চালকরা একটানা ১৫/১৬ ঘন্টা গাড়ী চালাচ্ছে। বিশ্রাম ব্যতিত কান্ত অবস্থায় গাড়ী চালানোর ফলে তাদের চোখে অনেক সময় ঘুম চলে আসে। ফলে ঘটে যায় মারাত্মক দুর্ঘটনা।

২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি ৩৮ হাজার কোটি টাকা। যা আমাদের জিডিপির দেড় শতাংশ। ২০২০ সালে এই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটেছে তার অর্থনৈতিক ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা।

সড়ক দুর্ঘটনা হয় না এমন দেশ নেই। উন্নত দেশগুলোয় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেসব পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তা খুবই সুনির্দিষ্ট হয়। কিন্তু বাংলাদেশে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দায়সারা গোছের। কত বছরে কী পরিমাণ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমানো হবে, কীভাবে তা অর্জিত হবে, কারা তা সফল করবে সেটাও ভেবে দেখা দরকার। দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতি যত কমিয়ে আনা যায় সেটিই লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভাল যান, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক, সড়ক ব্যবস্থা উন্নতকরণ, সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিক ও যুগোপযোগী করার বিষয়গুলো তো রয়েছেই। এর সঙ্গে দুর্ঘটনায় পতিতদের ত্বরিত চিকিৎসা পাওয়ার বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি। অনেক সময় আইনি জটিলতার কারণে আহতদের চিকিৎসা দিতে সমস্যা হয়। এ সমস্যাটি সমাধানেও ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করতে হলে সরকারের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে গাড়ির চালক, মালিকসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু শুধু একটি পরিবারে গভীর শোক, ক্ষত সৃষ্টি করে না, সেই সাথে ওই পরিবারকে আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে ফেলে। প্রতিবার দুর্ঘটনার পর পরই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই তদন্ত প্রতিবেদন কোনোদিন আলোর মুখ আর দেখে না। আর সঙ্গত কারণেই দোষীদের শাস্তিও হয় না। সমাজের উঁচু স্তর থেকে নিচু শ্রেণির মানুষ- যারাই দুর্ঘটনার শিকার হন না কেন, কোনো একটি ঘটনার বিচার হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত মেলা ভার। আর বিচারহীন, প্রতিকারহীন অবস্থায় কোনো কিছু চলতে থাকলে সেটির পুনরাবৃত্তি ঘটবে, এটাই স্বাভাবিক।

প্রকাশিত পত্রিকা- দেশবার্তা, ২১ নভেম্বর ২০২১

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বার বার কেন আন্দোলনে নামতে হবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top