নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা দিন দিন বাড়ছে : হাসান হামিদ

দেশে গত কয়েক মাস ধরে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। বাজার ঘুরে দেখা যায়, সয়াবিন তেল, আটা, চাল, ব্রয়লার মুরগি আর পেঁয়াজের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। দফায় দফায় এই যে দাম বাড়ছে তাতে সাধারণ মানুষের জীবনে কেমন প্রভাব পড়েছে তা বোঝা যায় টিসিবির ট্রাকের পেছনে লোকের ভিড় দেখলে। আর এই ভিড় বড় হচ্ছে প্রতিদিন। কেননা সরকারের ভর্তুকি নিয়ে টিসিবি ট্রাকে করে সাধারণ বাজারের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করে। সূত্র বলছে, সর্বশেষ আরেক দফা বেড়েছে সয়াবিনের দাম। সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ৭৬ দশমিক ৮২ শতাংশ! তাছাড়া চিকন-মোটা চাল ভেদে দাম বেড়েছে ৩০-৩৪ শতাংশ, পেঁয়াজের দাম বেড়েছে দেশী আমদানিভেদে ৬৬-৬৭ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে প্রায় ৪৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ, আটার দাম বেড়েছে ৪২ দশমিক ৮৫ শতাংশ, চিনির দাম বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত, ডিমের দাম বেড়েছে ৩৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ, গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ১৯ দশমিক ২৩ শতাংশ পর্যন্ত। তাছাড়া সবজি, মসলা, মাছ, মাংসসহ প্রায় সব রকম নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামই আগের চেয়ে বেড়েছে কয়েক গুণ।

বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্য ক্রেতাদের উচ্চমূল্য দিয়ে কিনতে হচ্ছে এখন। ক্রেতারা বলছেন, সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন করে দাম না বাড়লেও কেজিতে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৭০-২১০ টাকায়। ক্রেতারা আরও বলছেন, এক মাস ধরে ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতি সপ্তাহে ৫-১০ টাকা করে বাড়ছে। কিন্তু এই মুরগির দাম এক মাস আগে কেজিতে ১৪০ টাকা ছিল। এদিকে মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ার চিত্র সরকারি সংস্থা টিসিবির (ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) দৈনিক বাজার মূল্য তালিকায়ও লক্ষ করা গেছে। তালিকা অনুযায়ী সেখানে মাসের ব্যবধানে ব্রয়লারের দাম ৪৫ শতাংশ বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ তুলনায় গরুর মাংস, ডালসহ কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা স্থিতিশীল বলা যায়। আবার বাজারে সবজির সরবরাহ থাকার পরও দাম অনেক চড়া। আর গত সপ্তাহ থেকে সব ধরনের মাছও বিক্রি হচ্ছে উচ্চমূল্যে।

কেন এমন হুটহাট বাড়ছে জিনিসের দাম এই প্রশ্নের জবাবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিলে দাম কিছুটা হলেও কমে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বাজার অস্থির হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হল জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, সরবরাহ সঙ্কট, উৎপাদন কম হওয়া এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধি । ফলে এমন পরিস্থিতিতে শুধু টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রি ছাড়া দ্রব্যমূল্য কমানোর কোনো বিকল্প রাস্তা দেখছে না সরকার। কিছুই করার নেই বলে সম্প্রতি এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, তেল, চিনি ও ডাল এই তিনটি পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে বলেই দেশেও এর চাপ পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে, তা যারা কিনবে তারা তো আর লোকসানে বিক্রি করবে না। আর কনজ্যুমার এসোসিয়েশনের এক সমীক্ষা বলছে, বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের গড় দাম ২০১৯ সালে আগের দুই বছরের তুলনায় বেশ খানিকটাই কম ছিল, কিন্তু ২০২০ সাল থেকে সেটা আবার বাড়তে শুরু করে। ২০২১ সালে বেশ উচ্চ মূল্যবৃদ্ধি দেখা গেছে, যা ২০২২ সালের প্রথম কয়েক মাসেও অব্যাহত রয়েছে।

দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা আর জোগানের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কিছু পণ্য আমাদের বার্ষিক চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হয়, আবার কিছু পণ্যের সিংহভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে উৎপাদিত চালের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ৩ কোটি ৯৫ লাখ টন, যা আমাদের নিজস্ব চাহিদার চেয়ে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টন বেশি। এ বছর উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ ২৫ লাখ ৫০ হাজার টন। সংরক্ষণজনিত ক্ষতি ৬ লাখ টন বাদে বাজারজাত পেঁয়াজের পরিমাণ ১৯ লাখ ৫০ হাজার টন। গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত আমদানীকৃত পেঁয়াজের পরিমাণ ৪ লাখ ৩৬ হাজার টন। দেশে উৎপাদিত ও আমদানীকৃত পেঁয়াজসহ মোট পেঁয়াজের পরিমাণ ২৪ লাখ টন প্রায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ টন। ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১১ লাখ টন, যার ৩০ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয় আর বাকি ৭০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। দেশে গমের চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন, যার শতকরা ৫ ভাগের এক ভাগ দেশে উৎপাদন হয়, বাকিটুকু বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ভোজ্যতেলের মতো অনেক পণ্য আছে যেগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর এসব পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে বেড়ে গেলে দেশীয় বাজারেও বাড়তে থাকে। এজন্য খবরের কাগজে প্রায়ই দেখা যায়, কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার টন চাল অবৈধভাবে মজুদ করে রাখছে, হিলি সীমান্ত বন্দরে শত শত ট্রাক পেঁয়াজ আটকা পড়ে আছে। এইসব কারণে দেশীয় বাজারে তৈরি হয় কৃত্রিম সংকট। কিন্তু এখন বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশীয় বাজারে দাম কমছে না।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতি ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ নিয়ে শেষ হয়েছিল, ২০১৯-২০ অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে এর পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মধ্যস্বত্বভোগী, অসাধু ব্যবসায়ী, অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানের অসক্রিয়তা, সরকারের কঠোর পদক্ষেপের অভাব, সর্বোপরি সাধারণ মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করা যায়।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি বলেন, সব মিলিয়ে দেশে একটি নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে টিসিবির কার্যক্রম বাড়ালে সার্বিক বাজার পরিস্থিতিতে তেমন কোনো ফল না হলেও অন্তত কিছু মানুষ এতে উপকৃত হবে। এ ছাড়া পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, সরবরাহ সঙ্কট, উৎপাদন কম হওয়া, ডলারের মূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে দেশের বাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে। তাছাড়া আমদানি পণ্যের মূল্য বাড়লে ট্যাক্সের পরিমাণও বেড়ে যায়। এটি বাজারের অন্যান্য পণ্যের দামেও প্রভাব ফেলে। করোনা সঙ্কটও এর জন্য দায়ী। এ অবস্থায় সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, করোনা মহামারির কারণে গত বছর থেকে এ পর্যন্ত বেকার হয়েছেন ২৬ লাখের বেশি মানুষ। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে কর্মজীবীদেরও আয়। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেশে নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে দিশেহারা মানুষ। সব কিছুর দাম বাড়লেও বাড়ছে না কেবল মানুষের আয়। এ অবস্থায় বিশেষ করে শহরের স্বল্প আয়ের মানুষের টিকে থাকা দায় হয়ে গেছে।

নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা দিন দিন বাড়ছে : হাসান হামিদ

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top