নতুন সংকটের মুখে হাওরপাড়ের লাখো কৃষক

হাসান হামিদ

এক ফসলের ওপর নির্ভরশীল আমাদের ভাটির কৃষকরা, আমার ভাইয়েরা; তারা আমারই স্বজন। তারা অনেক দিন ধরেই আধপেট খেয়ে, কেউ কেউ না খেয়ে বেঁচে আছেন। এসবের মাঝে ফোনে যখন আরও একটি ভয়াবহ ব্যাপার জানলাম, আমার সামনে ভেসে ওঠলো কয়েক লাখ অর্ধপেটের শরীর, অসহায় অনেকগুলো চোখ; আমি ধপ করে নিভে যাওয়া কুপির মতো একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চলের কান্না টের পেলাম। খবর পেয়েছি, এবারও হাওরে আগামী বোরো মৌসুমে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন হাওরবাসী।

কিছুদিন আগে হাওর এলাকার মানুষের হতাশার চিত্র নিজের চোখেই দেখে এসেছেন আমাদের পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। মৌসুমি ফসলের ভবিষ্যৎ এই হাওরবাসী নিজেদের অনেকটাই ছেড়ে দিয়েছেন ভাগ্যের ওপর। তবে মাননীয় মন্ত্রী  তাদের আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, এ বছর  হাওর এলাকার বাঁধ নির্মাণ, হাওরসংলগ্ন নদী খননসহ স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়ন কাজে প্রয়োজন অনুযায়ী সব টাকাই দেওয়া হবে। এ কাজগুলোতে যেন দুর্নীতির সুযোগ না থাকে, সেজন্য সর্বোচ্চ স্বচ্ছতাও নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু এই মুহুর্তে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তার সমাধান কী?  গত দুই বছর ধরেই সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের কৃষকদের সামনে নতুন নতুন সংকট  আসছে। প্রতি বছর ডিসেম্ভর  মাসেই পুরোদমে চারা রোপনের কাজ শুরু হলেও এবছর তা হচ্ছে না। হাওরের পানি না কমার চিত্র দেখে বোরো  ধান রোপন নিয়ে কৃষকরা উদ্বেগ আর উৎকণ্টায় আছে। তাদের চোখ শুকনো। সারাবছর খেয়ে না খেয়ে গেছে। সেইসব ক্ষুধাতুর লাখো চোখে এখন ভর করেছে ভয় আর অসহায়ত্ব।

আমরা জানি, গত দুই বছর পানি উন্নয়ন র্বোডের অনিয়ম আর দূর্নীতির কারনে অকাল বন্যায় বাঁধ ভেঙ্গে ফসল হারিয়ে কৃষকরা বর্তমানে একবারে সর্বশান্ত। আর এবছরও পানি যে হারে কমছে, তাতে করে বীজতলা তৈরী করতে পারলেও বোরো জমি রোপন করতে পারবে  কিনা এই চিন্তায় রয়েছে হাওরপাড়ের লাখ লাখ কৃষক। তাছাড়া পিআইসি গঠনে বিলম্ব হওয়ার বিষয়টি নিয়ে এবছরও প্রশ্নবিদ্ধ করছেন হাওরপাড়ের কৃষক ও হাওর আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। আর দ্রুত পিআইসি গঠনের কাজ শেষ করতে না পারলে এবারও  বোরো ফসল ঝুঁকিতে পড়বে ।

সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, হাওরে বীজ বপনের সময় পার হয়ে গেলেও কোন কোন  হাওরের পানি নিষ্কাসনের নদী-খাল বা স্লুইসগেট, ভার্টিকেল গেট বা পাইপ  স্লুইসগেইট ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাসন হচ্ছে না। তাছাড়া সুনামগঞ্জ জেলার ছোট বড় ১৫৪টি  হাওরের বেশিরভাগ হাওরই চাষাবাদের উপযোগী হয়নি এখনও। এবার সময় মত বীজতলা না শুকানোয় উচুঁ জমিতে বীজ ফেলেছেন হাওরপাড়ের কৃষকগণ। কিন্তু বোরো ধান রোপনে বাদ সেধেঁছে সেই পানি। যে পানির মাঝেই হাওরপাড়ের মানুষ বসবাস আর বর্ষায় ৬মাস মাছ ধরে জীবন-জীবিকার পরিচালনা করে, সেই পানিই হাওরে কষ্টের ফলানো বোরো ধান ডুবিয়ে হাওরবাসীর স্বপ্নকে ডুবিয়ে দেয় চোখের পলকে। এবার সেই পানি এখন  লাখ লাখ হাওরবাসীর চিন্তা আর মহা সংকটের কারন হয়ে দাড়িয়েছে। এ পর্যন্ত  অন্যান্য বছর এই সময় বছরে ৬-৭ হাজারের বেশি হেক্টর বোরো জমি চাষাবাদ হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত এ বছর চাষ হয়েছে ৩ হাজার হেক্টরের কম। এই অবস্থায় বেশির ভাগ হাওরপাড়ের কৃষকরা বেকায়দায় পড়েছেন।

সুনামগঞ্জে হাওরের এ নতুন সংকট নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন এখন প্রায় সাড়ে তিন লাখ  কৃষক পরিবার। নিকট অতীতে তারা এমন সংকটের মুখোমুখি হয়নি। সরকার পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রথমবারের মতো প্রায় ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিলেও প্রাকৃতিক কারণে বিলম্বিত পানি নিষ্কাশনের কাজ করার সুযোগ নেই। তাই কৃত্রিম কারণে যেসব হাওরের পানি নামছে না, সেসব হাওরে বিচ্ছিন্নভাবে পানি নিষ্কাশনের কাজ চলছে। জেলার এবার ২লাখ ২২হাজার ৫৫২হক্টর বোরো জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করেছে, যার মূল্য প্রায় ১৫শ কোটি টাকা। কিন্তু জেলার বড় বড় হাওর গুলোর পানি এখনো কমছে না। হাওরের মাইলের পর মাইল চাষ যোগ্য জমিতে পানি একবারেই যেন স্থির হয়ে আছে। ফলে ঐ সব হাওরের বীজতলাও পানিতেই ডুবে আছে। ১লা পৌষ থেকে ১৫মাঘ পর্যন্ত বোরো আবাদের সময়। এই সময় ৪০-৪৫দিন বয়সী চারা লাগানো ব্যস্থ সময় পার করে কৃষকরা আর জলাশয় শ্রেনীর জমিতে ২ মাস বয়সী চারা লাগায়। আর তাই এভাবে কচ্ছপের গতিতে পানি কমলে চরম ক্ষতির শিকার হবে কৃষকগণ। সেই সাথে এবার লক্ষ্য মাত্রাও অর্জিত হবে না। আর এর প্রভাব পড়বে হাওরের প্রতিটি মানুষের পাকস্থলী, স্বপ্ন আর দেশের অর্থনীতির ওপর।

প্রকাশিত পত্রিকা-

দৈনিক  ইত্তেফাক  ০১/০১/২০১৮

নতুন সংকটের মুখে হাওরপাড়ের লাখো কৃষক
Scroll to top