দফায় দফায় দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে। এমন কোনো পণ্য নেই, সম্প্রতি যার দাম বাড়েনি। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন খেটে খাওয়া ও নিম্নআয়ের শ্রমজীবী মানুষজন। পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণিও কষ্টে পড়েছেন। সবকিছুর দাম কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে। আর এমন পরিস্থিতিতে আসছে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে রমজান মাস৷ সাধারণ মানুষ তাই চিন্তায় আছেন, রোজায় পণ্যের দাম আবারও বাড়লে এবার না খেয়ে থাকতে হয় কিনা। কেননা প্রতিবার রমজানে জিনিসের দাম বেড়ে যায় বাংলাদেশে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ বছর রমজানে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় রাখতে আগেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্যে ১২ সংস্থাকে নামানো হয়েছে মাঠে৷ এসব সংস্থার ব্যাপক নজরদারি থাকবে। তারা খেয়াল রাখবে যাতে রমজানকে পুঁজি করে কেউ অতি মুনাফা করে ভোক্তাকে ঠকাতে না পারে৷ এ সময় কোনো ধরনের অনিয়ম পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার কথাও বলা হচ্ছে৷
প্রতি বছর দেখা যায়, চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজসহ দ্রব্যমূল্য রমজান মাসে আরও এক দফা বাড়ে। এতে করে জনগণের নাভিশ্বাস উঠে। এবার সাধারণ মানুষ শঙ্কায় আছে, কারণ কয়েক মাস ধরে কয়েক দফায় জিনিসের দাম বেড়েছে। আর তা রমজান আসার আগেই। কয়েক মাস ধরে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন এই ঊর্ধ্বগতি মানুষকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে তা নিয়ে ভাবার যেন কেউ নেই। ফলে মানুষ ভাবছে, রমজানে মুনাফাখোর সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ, লবণ, চিনির দাম আরও যদি বাড়িয়ে দেয় তবে ভয়ানক কষ্টে পড়বেন অনেকে।
করোনাকালে দেশের অনেক মানুষের আয় কমেছে। আয় কমার সাথে সাথে এদিকে জিনিসের দাম বেড়েছে। এতে করে বাড়তি চাপে পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষ। এই করোনা সংকট পুঁজি করে ভোগ্যপণ্যের অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে কোনো কারসাজির সুযোগ না পায়, সে জন্য এবার শবেবরাতের পর থেকে সরকারি সংস্থাগুলো নিয়মিত বাজার তদারকি করবে বলে জানা গেছে। দেশের মানুষের আয় কমার পাশাপাশি করোনাকালে কমেছে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ। টাকার মান ধরে রাখতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে পণ্য ও সেবামূল্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দাম বৃদ্ধি নিয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, সবার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। নাভিশ্বাস উঠেছে স্বল্প আয়ের মানুষের। ভোক্তাদের সোচ্চার হতে হবে। নয়ত সরকার শুনবে না। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কয় দিন পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাবি তুলবেন তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য। সরকারও হয়তো মেনে নেবে। কিন্তু সরকারি চাকুরির বাহিরে সাধারণ মানুষের তো আয় বাড়ছে না। কষ্টটা তাদেরই বেশি হবে। সে জন্য নিত্যপণ্যের বাজারে এখনই লাগাম টানতে হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে এখানে তো বাড়বেই৷ কিন্তু অনেকের অভিযোগ, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও কিছু পণ্যের দাম বাড়বে, এটা সত্যি৷ কিন্তু যেসব পণ্য দেশে উৎপাদন হয়, বাজারে কোন ঘাটতি নেই সেটার দাম কেন বাড়বে? যেমন একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ধান উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ কোটি ৯৫ লাখ টন৷ আমন ও আউশ মৌসুমে বেশ ভালো ফলন হয়েছে৷ বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আমদানিও করা হয়েছে চাল৷ খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চালের মজুতও রয়েছে রেকর্ড পরিমাণে৷ এরপরও চালের দাম কেন বাড়ছে?
এদিকে সাধারণ মানুষ বলছে, জিনিসের দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় এবং অনেকের আয় কমে যাওয়াতে টিসিবির পণ্য কিনতে ভীড় জমাচ্ছে জনগণ। ট্রাকের পেছনে লাইন বড় হচ্ছে৷ অনেকে মনে করেন, প্রতি বছর সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না।
রমজানে বিশ্বের অনেক দেশে দ্রব্যমূল্য কমানো হয়। অথচ এর উল্টো চিত্র থাকে বাংলাদেশে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যাতে রমজানে নিয়ন্ত্রণে থাকে, এ জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ভোগ্যপণ্যের আমদানি ও মজুদ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার, যাতে পেঁয়াজ, ছোলা, ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল ও আটার মতো নিত্যপণ্য রমজানের সময় সহনীয় দামে ভোক্তারা কিনতে পারেন। জানা গেছে, ভোগ্যপণ্যসহ অত্যাবশ্যকীয় ১৭টি নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে নির্দেশনা রয়েছে প্রধানন্ত্রীর কার্যালয়ের। নিত্যপণ্যের ন্যায্যদাম ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে সমন্বিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করেছে। তাছাড়া সম্প্রতি রমজানের প্রস্তুতি নিয়ে দেশের ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারকদের নিয়ে একটি বৈঠক করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে রমজানে ব্যবহার হয়, এমন পণ্যের মজুদ ও আমদানি বাড়ানোর ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে বলে জানা যায়।