দেশে ফেরত আসা বেকার প্রবাসীদের খোঁজ কে নেয়?

হাসান হামিদ

অনেকেই আছেন যারা এ দেশ ছেড়ে বিদেশ যান রোজগার করতে, আমরা তাদের প্রবাসী বলি। তারা নিজের জীবনকে বলতে গেলে উৎসর্গ করেন পরিবারকে ভালো রাখতে, দেশকে ভালো রাখতে। যারা প্রবাসে কাজে যান, তারা কেউ হাসতে হাসতে সেখানে যান না। অনেক কষ্ট নিয়েই যান, তবে ভিতরে একটা স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্নের তাড়নায় তারা আরেকটু ভালো থাকার জন্য ভিনদেশে পাড়ি জমান। সেই অচেনা দেশ, অজানা পরিবেশে গিয়ে কি ভালো থাকেন কেউ? আসলে ভালো থাকার সুযোগ অনেকেরই থাকে না। প্রবাসে গিয়ে একেতো কথায় কাজে মিল না পেয়ে তাদের মন বিপর্যস্ত হয়, তার ওপর দেশে পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের রেখে একা থাকায় তার কষ্ট আকাশ ছাড়িয়ে যায়। তারপরও একজন প্রবাসী সেখানেই থেকে তার স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করতে থাকেন।  তার হয়তো ইচ্ছা করে, সব ফেলে পরিবারের কোলে ফিরতে, দেশে চলে আসতে; কিন্তু সময় এবং পরিস্থিতির কারণে তা আর হয় না। আপন মানুষগুলো যেন অর্থকষ্টে না ভুগে সেজন্য অন্য দেশের মাটিতে অনেক কষ্ট করে আয়-উপার্জন করেন একজন প্রবাসী। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ১৬২টি দেশে এক লাখ বাংলাদেশি কর্মী আছেন৷

প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৩ ভাগ৷ পোশাক খাতকে ছাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রার জন্য এটিই শীর্ষ খাত৷ কিন্তু তারা অনেক ক্ষেত্রেই নানা ভোগান্তির শিকার। সমস্যায় জর্জরিত প্রবাসীদের নিয়ে তেমন করে কেউ ভাবেন না। পত্রিকায় পড়লাম, চলতি অর্থবছরের গত ১০ মাসে আমাদের প্রবাসী রেমিট্যান্স ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এটা খুব আশার কথা যে, এই রেমিট্যান্স বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে গেছে। আমরা দেখেছি এই করোনার সময়েও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ভূমিকা রাখছে অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায়। তবে করোনায় প্রবাসী শ্রমিকেরা চাকরি হারিয়ে যারা দেশে ফেরত এসেছেন, তাদের খবর নেয়নি কেউ। প্রবাসীদের কেউ কেউ আবার করোনায় চাকরি হারিয়ে সেখানেই কষ্টে আছেন। আর এই সংকট বাড়ছে দিনের পর দিন। এসব নিয়ে পরিকল্পনা এখনই করতে হবে।

কয়েক দিন আগে লিবিয়ায় পাচার হওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন পড়লাম পত্রিকায়। সেই খবরে বলা হয়েছে সমুদ্র থেকে উদ্ধার হওয়া তরুণদের মর্মান্তিক জীবনকাহিনি। প্রতি বছর লাখ লাখ তরুণ বিদেশে চাকরির জন্য গিয়ে সমুদ্রে ডুবে যান, মরুভূমি ও গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যান, এসব খবর আমরা কাগজে পড়ি। এই ঘটনাগুলোর পেছনে আছে অসহনীয় বেকারত্ব এবং দারিদ্র্যতার গল্প। দেশে ন্যূনতম কিছু করার থাকলে এইসব তরুণেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিত না। লিবিয়া, ইতালি, গ্রিক, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই, সিঙ্গাপুর, লেবানন, মালদ্বীপ, সৌদি আরব, ইরাক, জর্ডান— যেখানে সামান্য কাজের সুযোগ আছে, সেখানেই আমাদের দেশের বাংলাদেশি নারী-পুরুষরা জমিজমা বিক্রি করে পাড়ি জমান। কেউ কেউ টিকে যান। আর বেশিরভাগই দালালদের খপ্পরে পড়ে অনেকে দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা নিয়ে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরে আসেন।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির ‘বিদেশ ফেরতদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি অন্বেষণ এবং বিশ্লেষণ’ শীর্ষক একটি জরিপের প্রতিবেদন তারা প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, করোনাকালে চাকরি হারিয়ে বিদেশফেরত কর্মীদের ৪৭ শতাংশ এখনো বেকার। বিদেশ থেকে দেশে ফিরে তারা আর কোনো কাজ পাননি। তারা দৈনন্দিন খরচ মেটাচ্ছেন পরিবারের আয় থেকে অথবা আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, করোনার সংক্রমণ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে ১৪ মাসে প্রায় পাঁচ লাখ প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরে এসেছেন। ব্র্যাকের জরিপে অংশ নেওয়া উত্তরদাতাদের ৩৫ শতাংশ ছুটিতে দেশে এসে করোনার কারণে বিদেশ ফিরতে পারেননি। ১৯ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছে, তারা চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। আর ১৬ শতাংশ বলছেন, তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। ১২ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, তারা একেবারেই চলে এসেছেন। দুই শতাংশ বলেছেন, তারা অসুস্থতার কারণে দেশে ফিরে এসেছেন।

জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতবছর বিদেশফেরতদের ৮৭ শতাংশ বলেছিলেন তাদের আয়ের উৎস নেই। এবার দেখা গেছে, উত্তরদাতাদের প্রায় ৫৩ শতাংশ কোনো না কোনো কাজে নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছেন। তাদের মধ্যে ২৪ দশমিক ১৯ শতাংশ কৃষি কাজে, ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ দিনমজুরী বা একই ধরনের কাজ করছেন। ৩৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেছেন। বাকি ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ অন্য কাজ করছেন। উত্তরদাতাদের মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ জানিয়েছেন, গত এক বছরেও তারা কাজ জোগাড় করতে পারেননি। পরিবারের আয় বা ধার দেনা করে চলছেন। উত্তরদাতাদের ২৮ শতাংশ বলেছেন, তারা ইতোমধ্যেই ধারদেনায় জর্জরিত। ৭২ শতাংশ বলেছেন, আবার তারা বিদেশ ফেরত যেতে চান। গত বছর জরিপে অংশ নেওয়া ৭৪ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছিলেন তারা ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন। এবার ৯৮ শতাংশ উত্তরদাতাই বলেছেন, অপর্যাপ্ত আয় বেকারত্ব, বিদেশ ফিরে যেতে না পারা, পারিবারিক কারণে মানসিক চাপের মধ্যে আছেন। ব্র্যাক, ইউএন ওমেন ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে একটি যৌথ গবেষণা করেছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের এপ্রিল-নভেম্বর সময়কালে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের প্রায় ৭৭ শতাংশই দেশে চাকরি খুঁজেছেন। ফেরত আসা প্রবাসীদের জন্য সরকার প্রণোদনা প্যাকেজসহ নানা উদ্যোগ নিলেও তার সুফল যে মিলছে না।  প্রবাসীদের সহায়তার প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের তাই নতুন করে ভাবতে হবে, এবং সেটি এখনই।

করোনার থাবায় চাকরি হারিয়ে অনেক প্রবাসী দেশে ফেরত এসেছেন। তাদের জন্য সরকার প্রণোদনার ব্যবস্থা করলেও তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমস্যা রয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক ঋণ সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক কাগজপত্রেরর অভাবে প্রবাসীরা ঋণের জন্য আবেদন করতে পারছেন না। অনেকক্ষেত্রে তথ্যের ঘাটতি থাকার কারণে ব্যাংকও ঋণ দিতে দ্বিধান্বিত থাকছে। বেশকিছু সংখ্যক প্রবাসী ছুটিতে দেশে আসার পরে লকডাউনের কারণে এখন আর কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে পারছে না। যার ফলে তাদের জীবনযাত্রায় তার ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যদিও বর্তমানে দেশের বৈদেশিক আয়ের ক্ষেত্রে বেশ ভালো  প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিন্তু দেশে ফিরে আসা এই প্রবাসীরা নানা ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। আর অনেক দিন ধরেই প্রবাসী ও বিদেশে যেতে আগ্রহী শ্রমিকদের বিশেষ বিশেষ কাজের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সম্পৃক্ত করার কথা বলা হচ্ছে। ফেরত আসা প্রবাসীদের সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলছেন অনেকে। দেশে চলমান বৃহৎ নির্মাণ প্রকল্পেও প্রবাসফেরত শ্রমিকদের নিয়োজিত করা যায়। প্রবাসীদের কেউ কেউ আবার বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা ও আধুনিক জ্ঞান অর্জন করেছেন। তাদের সেই বিশেষ দক্ষতা কাজে লাগিয়েও দেশ উপকৃত হতে পারে।

প্রকাশিত পত্রিকা- সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল, ১০ জুলাই, ২০২১

দেশে ফেরত আসা বেকার প্রবাসীদের খোঁজ কে নেয়?

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top