আর কিছুদিন পরই ঈদ, মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। এখন চলছে রমজান মাস। প্রতি বছর ঈদ এবং রোজাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে অর্থপ্রবাহ বেড়ে যায় অনেকগুণ। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত দুই বছর থমকে ছিল উৎসবমুখর এই অর্থনৈতিক প্রবাহ। এবার ঈদ অর্থনীতি ফিরেছে আবার আগের রুপে। সবখানে জমে উঠেছে জমজমাট ঈদ বাজার। ঈদকে কেন্দ্র করে পোশাক, পরিবহন, রেমিটেন্স, ভোগ্যপণ্য, ই-কমার্সসহ সকল খাত হয়েছে চাঙ্গা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বলছে, এবার ঈদে পোশাকসহ যাবতীয় পরিধেয় খাতে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার কোটি, জুতা-কসমেটিকস ৩ হাজার কোটি, ভোগ্যপণ্য ২৮ হাজার কোটি টাকা, জাকাত-ফিতরা ও দান–খয়রাত ৩৮ হাজার কোটি, যাতায়াত বা যোগাযোগ খাতে ১০ হাজার কোটি, স্বর্ণ-ডায়মন্ড ৫ হাজার কোটি, ইলেকট্রনিকস ৪ হাজার কোটি, ওমরাহ পালনে ৩ হাজার কোটি, আইনশৃঙ্খলাসহ অন্যান্য খাতে লেনদেন হবে ১ হাজার কোটি টাকা। এসব ছাড়াও অর্থনীতির আরও যেসব খাত রয়েছে, সেসবেও ঈদকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের বাণিজ্য হবে এবার।
দেশে চাকুরিজীবীরা ঈদে বোনাস পান। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই নিয়মানুযায়ী সবাইকে উৎসব ভাতা দেওয়া হয়। এবার চাকরিজীবীরা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ঈদ বোনাস তুলছেন। এর বাইরে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাবে, দেশে ২৫ লাখ দোকান, শপিং মল ও বাণিজ্য বিতান রয়েছে। গড়ে একটি দোকানে ৩ জন করে ৬৫ লাখ জনবল কাজ করছে। সংগঠনটির হিসাবে একজন কর্মীকে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বোনাস দেওয়া হয়। ওই হিসাবে গড়ে বোনাস ৮ হাজার টাকা ধরে ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা দেওয়া হবে। বলতে গেলে এর পুরোটাই যাবে ঈদবাজারে। এভাবে ঈদ অর্থনীতির আকার বাড়াতে এই টাকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
প্রতি বার ঈদে দেখা যায়, বাস, ট্রেন কিংবা প্লেনের টিকেট, লঞ্চের কেবিন সবই আগাম বুকিং হয়ে যায় ঈদের দুই সপ্তাহ আগেই। জানা যায়, এবার ঢাকা থেকে অন্তত ৩০ লাখ মানুষ গ্রামে ঈদ করতে যাবেন। আর করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর ঈদে অনেকেই দেশের বাইরে ঘুরতে যেতে পারেননি। এবার তাদের কেউ কেউ যাবেন। পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, কমপক্ষে ৫ লাখ মানুষ এই ঈদের ছুটিতে ভারতে যাবেন। অন্যান্য দেশেও অনেকে ঈদে ঘুরতে যান। এভাবে দেশের পর্যটন শিল্প যথেষ্ট লাভবান হয় ঈদকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে পরিবহনশ্রমিক আছেন প্রায় ৭০ লাখ। গত অর্থবছরে পরিবহন খাত থেকে অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে অন্তত ২ লাখ ৪১ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। বিবিএসের এক হিসাব বলছে, বাংলাদেশের পরিবহন খাত অর্থনীতিতে আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা বা ১০ শতাংশের বেশি মূল্য সংযোজন বা সেবা দিয়েছে, যা অত্যন্ত আশার বিষয়।
দেশের বাজারে ঈদে অর্থপ্রবাহ বাড়াতে প্রবাসী আয়ের একটা বড় প্রভাব রয়েছে। যারা প্রবাসে থাকছেন তারা দেশে থাকা পরিবারের আপন মানুষদের ঈদ উপলক্ষে বাড়তি টাকা পাঠান। ফলে অন্য সময়ের তুলনায় বেড়ে যায় নগদ অর্থপ্রবাহ। জানা যায়, এ বছর ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স এসেছে ১৪৯ কোটি ডলার আর মার্চে ১৮৬ কোটি ডলার। এর মানে ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে ৩৭ কোটি ডলার বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। এই অংক বেড়েছে রোজা এবং ঈদকে কেন্দ্র করে। ঈদকে সামনে রেখে চলতি মাসে রেমিট্যান্স আরও বাড়বে বলে আশা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশি প্রবাসে থাকেন। এদের অনেকেই ঈদের সময় দেশে পরিবারের কাছে অর্থ পাঠান। এভাবে দেশের ঈদ বাজার জমে উঠে।
এক গবেষণা বলছে, ঈদ অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি প্রায় কোটি লোকের কর্মসংস্থান যুক্ত, আর পরোক্ষভাবে উপকারভোগী অন্যরাও। ওই এক কোটি লোকের মধ্যে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রয়েছেন। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির দেওয়া তথ্য মতে, সারা দেশে প্রায় ২৫ লাখ দোকান রয়েছে। আর এসব দোকানে বছরের অন্য সময় প্রতিদিন ৩ হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হলেও রোজার মাসে সেটি তিন গুণ বেড়ে হয় ৯ হাজার কোটি টাকা। ওই হিসাবে রোজার এক মাসে এই ২৫ লাখ দোকানে ঈদপোশাক থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্য বিক্রি হবে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার।
ঈদকে ঘিরে দেশের ব্যাংকিং খাতে লেনদেন অনেক বেড়েছে। জানা যায়, এবার ঈদ বাজারে কেনাকাটায় এটিএম বুথে প্রতিদিন ১৫ কোটি টাকার বেশি উত্তোলন করছেন গ্রাহকেরা। এ ছাড়া মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হচ্ছে হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট আমানত ও ঋণের অংশ হিসেবে গ্রামের অংশ শহরের তুলনায় অনেক কম। গ্রাম থেকে যতটুকু আমানত নেওয়া হচ্ছে, এর অর্ধেক বিনিয়োগ হচ্ছে শহরে। কিন্তু ঈদ উপলক্ষে এ চিত্র একেবারে উল্টে যায়। শহরের মানুষ হয় ঈদ করতে গ্রামে যায়। ফলে জমজমাট হয়ে উঠে গ্রামের হাটবাজার।
ঈদে কর্মব্যস্ত মানুষের ভরসা এখন ই-কমার্স। ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত রমজানের শুরু থেকে অনলাইনে বিক্রি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বাড়ে। তবে এবার শুরু থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ বা তার থেকে বেশি বিক্রি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারী হিসাবে দেশের ই-কমার্স বাজারের পরিমাণ প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। মানুষের কর্মব্যস্ততা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই অনেকেরই সময় হয় না মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করার। আবার অনেকে ভিড় ঠেলে শপিং করা পছন্দ করেন না। তারা প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে ফেলছেন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম থেকে। এজন্য দিন দিন বড় হচ্ছে ই-কমার্স বাজার। ই-ক্যাব থেকে জানা যায়, রোজার আগে প্রতিদিন ২ লাখ ৭০ হাজার অর্ডার ছিল। যা বর্তমানে সাড়ে তিন লাখ হয়েছে।
ঈদের বাজার শুরু হয়ে যায় রোজার ঠিক আগে আগে। এক সমীক্ষা বলছে, এবারের শুধু রোজায় খাদ্যপণ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সাধারণত ঈদে সব ধরনের নিত্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে। এবার রোজা ও ঈদে ভোজ্যতেলের চাহিদা হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ টন, চিনি সোয়া ২ লাখ টন থেকে পৌনে ৩ লাখ টন, ডাল ৬০ হাজার টন, ছোলা ৫০ হাজার টন, খেজুর ১৩ হাজার টন, পেঁয়াজ ৩ লাখ ২৫ হাজার থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন এবং রসুনের চাহিদা প্রায় ৮০ হাজার টন। এসব পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের নিজস্ব টাকার পাশাপাশি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকার জোগান দেওয়া হয়। এভাবে ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ ঘন ঘন হাতবদল হয়। বেড়ে যায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ফলে চাঙ্গা হয় দেশের গোটা অর্থনীতি।