হাসান হামিদ
অনেক আগে সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় পড়েছিলাম, “রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত- যৌবনা- যদি তেমন বই হয়। তাই বোধ করি খৈয়াম তাঁর বেহেশতের সরঞ্জামের ফিরিস্তি বানাতে গিয়ে কেতাবের কথা ভোলেন নি”। আসলেই তাই। কিন্তু আজকাল আশেপাশের বাচ্চাদের আমি বইয়ের চেয়ে মোবাইল বা ট্যাব নিয়ে সারাক্ষণ পড়ে থাকতে দেখি। অথচ বই পড়ার অভ্যাস আমাদের দেশে সবার আগে গড়ে তোলা জরুরি; কেননা বই পড়ে মানুষ জগত সম্পর্কে ধারনা লাভ করে, আর এভাবেই সে যোগ্য সুনাগরিক হয়ে ওঠে।
অবশ্য কালে কালে বই আর জ্ঞানচর্চার বিষয় বদলে যেতো। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপে যখন অন্ধকার যুগ নেমে এসেছিল তখন সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, সিসেরো, ওভিড ইত্যাদি গ্রিক-রোমান লেখকদের কথা সবাই প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। আরবেরা এই মনীষীদের রচনা আরবি ভাষায় অনুবাদ করে, টীকাভাষ্য রচনা করে প্রায় চারশ বছর ধরে ইউরোপের হারিয়ে যাওয়া জ্ঞানের চর্চা অব্যাহত রেখেছিল। একাদশ-দ্বাদশ শতকে ক্রুসেড যুদ্ধ করতে এসে ইউরোপীয়রা আরব মনীষীদের দ্বারা সযত্নে রক্ষিত গ্রিক-রোমান জ্ঞানশিখাটির সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হয়েছিলেন। এই পরিচয়ের সূত্রে ইউরোপে আবার পুরোদমে গ্রিক-রোমান জ্ঞানচর্চা শুরু হয়েছিল, যার ধারাবাহিকতায় পঞ্চদশ-ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে পুনর্জাগরণ এবং আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সমাজের সূচনা হয়েছে।
সে যাই হোক; আমাদের নিজেদের পড়তে হবে, ছোটদের আরও বেশি পড়ার জন্য উৎসাহ দিতে হবে। আজকাল টিভি দেখা, কার্টুন দেখায় যতোটা সময় দিতে দেখা যায় বাচ্চাদের, তার চেয়ে অনেক কম সময় তারা বইয়ের পেছনে দেয়। অথচ হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, নিজের নিকৃষ্ট কালে চিরশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়ার জন্য রয়েছে বই; আর সমকালের নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়ার জন্যে রয়েছে টেলিভিশন! আমরা এর থেকে যতোদিন না বাঁচাতে পারবো শিক্ষার্থীদের, ততোদিন পর্যন্ত স্বপ্ন পূরণ ঠিক জায়গায় হবে না।
আমার এক নিকটাত্মীয়কে দেখেছি বাচ্চাকে মাসে হাজার টাকার চিপস, খেলনা, চুইংগাম কিনে দিলেও কখনো একটি বই কিনে দেননি। এ বিষয়ে ভলতেয়ারের সেই কথাটি প্রাসঙ্গিক, ‘সেদেশ কখনো নিজেকে সভ্য বলে প্রতীয়মান করতে পারবে না যতক্ষণ না তার বেশিরভাগ অর্থ চুইংগামের পরিবর্তে বই কেনার জন্য ব্যয় হবে’। বর্তমান ই-টেকনোলজি, টুইটার, ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক ও অবাধ আকাশ সংস্কৃতিতে চরম আসক্তির কারণে শিশু-কিশোর-যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ পর্যন্ত সবার মাঝে বই পড়ার আকাঙ্ক্ষা ও উন্মাদনা ধীরে ধীরে কমে আসছে। অথচ চীনা প্রবাদে আছে, যে ব্যক্তি পর পর তিন দিন বই পাঠ থেকে বিরত থাকে, সে তার কথা বলার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে।
একথা সবাই জানি, বই মানুষকে ভাবতে শেখায়। তাছাড়া বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটায় এবং ভালো-মন্দ-ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করতে শেখায়। তাই আমাদের সবার বই পড়া দরকার, মানবিক সমাজ গড়তে এর বিকল্প নেই। বই পড়ার কর্মসূচি সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে, প্রিয়জনদের সবসময় বই উপহার দিতে হবে। আর আমরা এটা সবাই জানি যে, বই পড়ে কেউ দেউলিয়া হয় না; বরং আলোকিত মানুষ হয়। মোবাইলের মতো প্রত্যেকের হাতে হাতে বই পৌঁছে দিতে হবে আমাদের। সবাইকে বই কিনে পড়তে উৎসাহ যোগাতে হবে সবকিছুর আগে।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শৈশব-কৈশোরে যাদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠে তাদের জীবন সংগঠিত ও সুশৃঙ্খল হতে বাধ্য। দার্শনিক ভলতেয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যদি মানুষ তাদের বাজে খরচের পরিবর্তে বই কেনার পিছনে অর্থ ব্যয় না করে তা’হলে তারা নিজেদের সভ্য বলে কখনো দাবি করতে পারবে না। আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে লিও টলস্টয় বলেছেন মানুষের জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে, বই, বই এবং বই।
আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আমাদের দেশে যতোগুলো স্কুল-কলেজ, ততোগুলো গ্রন্থাগার যদি থাকতো; যাও আছে তার ঠিকঠাক ব্যাবহার নেই। প্রতিভা বসু বলেছিলেন, বই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আত্মীয়, যার সঙ্গে কোনদিন ঝগড়া হয় না, কোনদিন মনোমালিন্য হয় না। আমাদের সেই সেরা আত্নীয় বইকে আমাদের ভালোবাস্তে হবে। বাড়াতে হবে বই পড়া। তা সে যেকোনো ধরনের বই হতে পারে। কবিতা, গল্প, ছড়া অথবা প্রবন্ধের বই। যেকোনো বই, যার যেটা ভালো লাগে। শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবা, প্রবীণ এবং বৃদ্ধ যেকোনো বয়সের মানুষ বই পড়ার কাজটি করতে পারে। পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ জানার মাধ্যম হলো বই। কত সহজে কত কিছুই না জানা যায়। নতুনকে জানা এবং অচেনাকে চেনার মাধ্যম প্রধানত দুটি। প্রথমটি হলো ভ্রমণ আর দ্বিতীয়টি বই পড়া। ভ্রমণ হলো সময়সাপেক্ষ, শারীরিক শ্রম আর আর্থিক সক্ষমতার ব্যাপার। এই তিনের সমন্বয় না হলে ভ্রমণ করা কারো পক্ষে সম্ভব হয় না। একজনের পক্ষে বই পড়া খুবই সহজ। বই পড়ার অভ্যাস করতে হয় ছোটবেলা থেকেই। বলা যায়, প্রাইমারি এবং মাধ্যমিক পর্যায় হলো বই পড়ার অভ্যাস গড়ার ক্ষেত্রে উপযুক্ত সময়। বই মানুষের মনের দরজা খুলে দেয়। মানসিক শক্তি জোগায়।
বইপড়া অভ্যাসটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের অভিভাবকদের এগিয়ে আসতে হবে। শিশুকালেই যদি সন্তানের হাতে বই তুলে দেওয়া যায়, তবে এর চেয়ে ভালো কাজ আর কিছু হতে পারে না। এ পড়াকে অভ্যাসে পরিণত করতে পারলে সন্তান বিপথে যাবে না একথা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। সন্তানকে বই কিনে দেওয়ার জন্য অভিভাবকদের একটি ন্যূনতম বাজেট থাকা উচিত। আর এভাবে পারিবারিক পাঠাগার গড়ে উঠতে পারে। আর শিশু-কিশোর উপযোগী বই রচনার দিকে নজর দিতে হবে। সুন্দর সুন্দর ছবি আর মনকাড়া প্রচ্ছদের বই প্রকাশ করতে হবে। এক্ষেত্রে লেখক-প্রকাশক-শিক্ষাবিদদের নিয়ে বিশেষ টিম গঠন করা যেতে পারে।
বই আমাদের সামনে তুলে ধরে নানা ধরনের মানুষের গল্প। বই পড়ে জানা যায় কত কত জীবনের কথা, সেসব জীবনের হাসি-কান্না, ভালো থাকা, মন্দ থাকার কথা। অনেক বই আছে যেখানে সাহসী মানুষের জীবনের গল্প লেখা থাকে। কীভাবে একজন মানুষ একেবারে হেরে যাওয়া অবস্থান থেকে আবার ঘুরে দাঁড়ান, কীভাবে যার কিছুই নেই সেই মানুষটিও শক্তিশালী মানুষে পরিণত হন তার বাস্তব গল্পও আমরা জানতে পারি। এ গল্পগুলো আমাদের পথ দেখায়। জীবনের লক্ষ্য তৈরিতে সাহায্য করে।
পড়াশোনা আমাদের ব্যক্তিত্ব যতটা গঠন করতে সক্ষম ততটা কি আর কোনো উপায়ে সম্ভব? জীবনের ঘটনাগুলো আমাদের অভিজ্ঞ করে, কৌশলী করে। কিন্তু একটি আকর্ষণীয় দৃঢ় ব্যক্তি হিসেবে নিজেক প্রকাশ করতে চাইলে আপনার জন্য পড়ার কোনো বিকল্প নেই। জ্ঞান হার মানায় বয়স, পদবি, বাহ্যিক সৌন্দর্যসহ অন্য সবকিছুকে। আপনি যত পড়েন তত জানেন এবং জানার সঙ্গে বদলে যায় আপনার দেখার চোখ। বদলে যায় বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। প্রবাদ আছে, একজন অশিক্ষিত মানুষ কাদাকে দেখে শুধু ভেজা মাটি হিসেবে। আর এক জোড়া শিক্ষিত চোখ সেই কাদার মাঝে খুঁজে পায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু-পরমাণু।
মোটকথা বইয়ের বিকল্প একমাত্র বই। আর কিছু নয়, তাই নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে আমাদের। নিজেই আবিষ্কার করতে হবে যে, অন্য এক ব্যক্তিত্ববান মানুষকে আপনার মাঝে আছে। শুরু করেছিলাম সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা দিয়ে, শেষ করছি তাঁর কথা দিয়ে, ‘পৃথিবীর আর সব সভ্যজাত যতই চোখের সংখ্যা বাড়াতে ব্যস্ত, আমরা ততই আরব্য উপন্যাসের একচোখা দৈত্যের মতো ঘোঁত্ ঘোঁত্ করি, আর চোখ বাড়াবার কথা তুলতেই চোখ রাঙাই। চোখ বাড়াবার পন্থাটা কি? প্রথমতঃ বই পড়া এবং তার জন্য দরকার বই পড়ার প্রবৃত্তি’।
প্রকাশিত পত্রিকা-
শিক্ষাবার্তা ১১/০১/২০১৮