হাসান হামিদ
লেখা শুরুর আগে কবি মহাদেব সাহার একটি কবিতা উল্লেখ করছি,
‘‘আমাকে দেখাও তুমি দূরের আকাশ, ওই দূরের পৃথিবী
আমি তো দেখতে চাই কাছের জীবন;
তুমি চাও আরো দূরে, দূর দেশে
আমাকে দেখাতে কোনো রম্য দ্বীপ, স্নিগ্ধ জলাশয়
আমি চাই কেবল দেখতে এই চেনা সরোবর, কাছের নদীটি।
আমাকে দেখাতে চাও বিশাল জগৎ, নিয়ে যেতে চাও অনন্তের কাছে
আমার দৃষ্টি খুবই সীমাবদ্ধ- অতো দূরে যায় না আমার চোখ;
কেবল দেখতে চাই জীবনের কাছাকাছি যেসব অঞ্চল-
দূরের নক্ষত্র থাক, তুমি এই নিকটের মানচিত্র আমাকে দেখাও’’।
ঢাকা শহর নিয়ে নানা বড় বড় বুলি নানা জায়গা থেকে শুনি। এই শোনার বয়স কম নয়। আমার নিজের বত্রিশ বছরের জীবনের অন্তত চৌদ্দ বছর ঢাকায় কাটিয়েছি। এখনও ঢাকাতেই আছি; এবং মনে হচ্ছে বাকি যে ক’দিন পৃথিবী নামের গ্রহে বাঁচব সেই ক’দিন এই নগরীতেই থিতু হব। আমি ভয়ানক অলস মানুষ। এই সামান্য জীবনে বেশি ছুটোছুটি আমায় দিয়ে হবেও না। তবে বিগত দুই দশকে ঢাকার কোনো উন্নতি হয়নি, তা নয়। নানা দিকে আমাদের ভালোবাসার এই ঢাকা শহর এগিয়েছে। কিন্তু গুরত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে উদাসীনতাও সেই সাথে লক্ষণীয়। কর্তা ব্যক্তিরা অতীতে এমনকি বর্তমানেও নানা বিষয়ে পদক্ষেপ নিলেও অতি প্রয়োজনীয় কোনো কোনো ব্যাপারে গা ছাড়া ভাব দেখান। এর অন্যতম হলো এ শহরের জলাশয় রক্ষা নিয়ে খেয়ালীপনা।
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার পরপর জলাশয় সংক্রান্ত দুটি খবর পেলাম। একটি হলো, ঢাকা মহানগরীর জলাশয় রক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করতে ৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা অনুদান দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। বুধবার (৩০ ডিসেম্বর, ২০২০) অনুদানের এ অর্থ এডিবি অনুমোদন দিয়েছে। এডিবি বলছে, তাদের এ সহযোগিতা জলাশয় রক্ষায় সরকারের নীতির দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে সহায়ক হবে। আর দ্বিতীয় খবরটি হলো, এডিবির অর্থ অনুমোদনের ঠিক পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে এ–সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মাধ্যমে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়েছে। ফলে এখন থেকেদুই সিটি করপোরেশন ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের পুরো দায়িত্ব পেল। আগে ঢাকা ওয়াসা এ দায়িত্বের বেশিরভাগ পালন করত। এই দুটি খবরই অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে দেখছি, সামান্য বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়াগায় জলাবদ্ধতা হয়। দেখলে মনে হয়, বন্যা শুরু হয়েছে। এই সমস্যা নিরসনের মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার কাঁধে। অবশ্য প্রতি বছর সিটি করপোরেশনও এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে আমরা দেখেছি। এই কাজে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের সাথে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান জড়িত। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড ও বেসরকারি আবাসন কোম্পানিগুলো। জলাবদ্ধতা নিরসনের অংশ হিসেবে ঢাকা ওয়াসা শহরের ২৬টি খাল (প্রায় ৮০ কিলোমিটার) এবং প্রায় ৩৮৫ কিলোমিটার বড় আকারের নালা ও চারটি পাম্পস্টেশন রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করে বলে জেনেছি। তার সঙ্গে প্রায় ২ হাজার ২১১ কিলোমিটার নালা দেখভাল করে দুই সিটি করপোরেশন। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে আগে ওয়াসার সাথে যুক্ত সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মাত্র তিন-চার দশক আগে একেবারেই এখনকার মতো ছিল না। ইতিহাস ঘেঁটে দেখলাম, ঢাকার অনেক মাঠ ও আবাসিক এলাকা সেসময় পুকুর ছিল। মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান মতে, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় প্রায় দুই হাজার পুকুর ছিল। এখন তা এসে ঠেকেছে মাত্র একশতে। এ সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা আছে ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের। তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৮৫ থেকে এ পর্যন্ত হারিয়ে গেছে ঢাকার ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি ও খাল। জলাশয় ভরাটের এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ ঢাকায় জলাশয় ও নিচুভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১০ শতাংশের নিচে নেমে যাবে বলে আশঙ্কা আছে। এতে বলা হয়েছে, ১৯৭৮ সালে ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় জলাভূমির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৫২ হেক্টর। একই সময়ে খাল ও নদী ছিল ২ হাজার ৯০০ হেক্টর। নগরীর বৃষ্টির পানি এসব খাল দিয়েই পড়েছে নদীতে। বিগত ৩৫ বছরে জলাশয় কমেছে ৩৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স বলছে, সারাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৪২ হাজার একর জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে। আর শুধু ঢাকা শহরের দুই সিটি করপোরেশন এলাকা থেকেই বছরে গড়ে ৫ হাজার ৭৫৭ একর জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৯ হাজার ৫৫৬ একরের মধ্যে ভরাট হয়েছে ৩ হাজার ৪৮৩ একর। পাশাপাশি ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১০-এর মধ্যে এক লাখ ৯৩৭ একরের মধ্যে ২২ হাজার ৫১৬ একর জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। এছাড়া খাল, জলাশয় থেকে শুরু করে পুকুর পর্যন্ত প্রভাবশালী দখলদারদের কারণেই বিলীন হচ্ছে বেশি। আর এভাবে পরিকল্পনা ছাড়া ভরাট হওয়ার ফলে বর্ষা মৌসুমে একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকার অধিকাংশ রাস্তাঘাট তলিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এই যে যত্রতত্র যেভাবে খুশি ভরাট হচ্ছে, এর জন্য কোনো আইন নেই? জলাশয় রক্ষায় সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। কিন্তু এদেশে আইন মানামানি হয়ে কয়টি কাজ হয় তা আমরা সাধারণরা মোটামুটি জানি। আইন না মানায় একের পর এক ভরাট হয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসন। সরকার জলাধার রক্ষায় ২০০০ সালে আলাদা আইন করলেও এর কোনো সুফল দেশ ও জাতি পায়নি। নানা ভাবে প্রভাব কাটিয়ে, আইন পাশ কাটিয়ে যার যেমন ইচ্ছা কাজ করে চলেছে। অথচ জলাধার রক্ষার আইনে বলা আছে, কোনো অবস্থায় খাল, বিল, নদী-নালা, পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের স্বাভাবিক গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। এমনকি সড়ক-মহাসড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণকালেও প্রাকৃতিক জলাশয়, জলাধার, খাল-নদী ইত্যাদির স্বাভাবিকতা নষ্ট করা যাবে না। জনস্বার্থে ও একান্ত প্রয়োজনে ভরাট করতে হলে, সেক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু জলাধার আইনের তোয়াক্কা না করেই জলাশয়গুলো দ্রুত দখল হচ্ছে। সেগুলো ভরাট করে দখলবাজরা গড়ে তুলছে বিরাট বিরাট স্থাপনা।
আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে ২০১০ সালে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান কর্তৃপক্ষ ১৫৯০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা তথা রাজধানীর ১২ শতাংশ পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল। এর মধ্যে পুকুর, খাল এবং লেকসহ অন্যান্য জলাশয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০১৭ সালে রাজউক জরিপ চালিয়ে দেখেছে, রাজধানীতে মাত্র ১৭৪৪ একর পানি সংরক্ষণ এলাকা রয়েছে। এর ফলে রাজধানী হয়ে পড়ছে অনেকটা পানিশূন্য। পানি সংরক্ষণে এত স্বল্প জলাধার বিশ্বের আর কোনো রাজধানীতে রয়েছে কিনা, আমার জানা নেই। অথচ এর সজীব এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত জলাধার অত্যন্ত জরুরি। আমাদের নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত বড় বড় ভবন গড়ে উঠছে। কিন্তু এগুলো নির্মাণের পেছনে পরিবেশবান্ধব কোনো পরিকল্পনা নেই। ঢাকার ভেতরের খাল এবং চারপাশের নদ-নদী দখলমুক্ত করার জন্য আদালতের নির্দেশসহ নগরবিদরা বহু তাগিদ দিয়েছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর খালগুলো উদ্ধারের নির্দেশও দিয়েছেন। অথচ আমরা এসব আদেশ-নির্দেশের কোনোটিই পুরোপুরি বাস্তবায়ন হতে দেখিনি।
আমরা ঢাকাকে ভালোবাসি। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে এ শহরের বাতাসেই নিঃশ্বাস নিই। আমরা মনে প্রাণে চাই এ শহর স্বাস্থ্যকর ও বসবাসের পুরোপুরি উপযোগী করে গড়ে তুলতে দরকারি সব পদক্ষেপ নেওয়া হোক। এ কাজ বাস্তবায়নে সবার আগে প্রয়োজন নির্ভরযোগ্য, উন্নত, টেকসই ও জলবায়ু সহনশীল পানির উৎস এবং সরবরাহ ব্যবস্থা। আর তাই জলাশয়গুলোকে সংরক্ষণ ও উদ্ধার করা, পানির উপরিভাগের দূষণ দূর করা এবং পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো অতি জরুরি। ঢাকা শহর শুধু দৃষ্টিনন্দন হোক তা নয়, পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর নগরীতে রূপান্তর হোক সেটিও চাই। সবশেষে জয় গোস্বামীর কয়েকটি লাইন লিখে শেষ করছি,
‘‘এই জলাশয়। এর তীরে থাকত একপায়ে ধ্যানস্থ প্রেরণা।
আজ উড়ে গেছে। শুধু পড়ে আছে গোলাকার জল।
জলে কে ঝাপট দিল? কোনও জলজন্তু? নাকি অন্ধ অবচেতনা পাগল?’’
প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক মানবকণ্ঠ, ০৬ জানুয়ারি, ২০২১