হাসান হামিদ
আমাদের দেশে ফলাফল যেভাবে ঘটা করে প্রকাশ করা হয়, পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে মোটেই তেমন করে হয় না। আর এদেশে পরীক্ষার নম্বর দিয়েই কেবল শিক্ষার্থীদের যখন মূল্যায়ন করা হয়, তখন তারা ধীরে ধীরে জানার আগ্রহ হারিয়ে নম্বরার্থী হয়ে ওঠে। আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো অনেক ছাত্রছাত্রী মনে করে বা বাবা-মায়েদের বোঝায় যে, যেহেতু প্রশ্ন কমন পড়ে না, তাই এত পড়ে লাভ নেই। সৃজনশীল পদ্ধতিতে বানিয়ে লিখলেও অকৃতকার্য হওয়ার সুযোগ নেই- আর এসব ভেবে সবাই জোর দিচ্ছে নম্বর কে কত পেলো। কী শিখল, শেখা বিষয় বাস্তব প্রয়োগ কতোটা বুঝলো তা কারও মাথায় ব্যথা হয়ে আসে না। আর, মৌলিক বিষয় না জানার কারণে এখন নম্বরার্থীদের অবস্থা অনেকটা নিচের গল্পের মতো-
শিক্ষক: বল, আকবরের জীবনকাল কত সাল থেকে কত সাল পর্যন্ত? ছাত্র: পারিনা স্যার। এটা বইয়ে নেই। শিক্ষক বই খুললেন, সেখানে লেখা—আকবর (১৫৪২-১৬০৫) ছাত্র: স্যার, আমি ভেবেছিলাম ওটা আকবরের ফোন নাম্বার।
ছেলের দু’দিন পর পরীক্ষা। অথচ পড়াশোনার নাম গন্ধ নেই। সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। মা, ব্যাপারটা দেখে-
মা: হাবলু, তোর না দু’দিন পরে পরীক্ষা! পড়াশোনা করছিস্ না যে!
হাবলু: মা পরীক্ষার এত চাপ- পড়ার সময়ই পাচ্ছি না!
পড়াশোনাটাকে আমরা চাপের পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছি। সারা দুনিয়ায় অনেক শিক্ষার্থী আছে; তাদের কাজ জ্ঞানানুশীলন। আর আছেন শিক্ষক। তাদের দায়িত্ব জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাদান। কিন্তু আমাদের দেশে আছে শুধুই পরীক্ষার্থী, কোনো শিক্ষার্থী নেই। শিক্ষক আছেন, যাদের কাজ শুধু পরীক্ষা নেওয়া। এদেশে জন্মের পর থেকেই শিশুকে একের পর এক পরীক্ষা দিতে হয়। হলে পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়েই আরেক দফা পরীক্ষা দিতে হয় বাবা-মায়ের কাছে। এ পরীক্ষা হলের পরীক্ষার চেয়ে ভয়ঙ্কর। উত্তর দিতে না পারার শাস্তি তাকে ভোগ করতে হয় তাৎক্ষণিক। তখনও তার বোল ফোটেনি, কিন্তু জনসমক্ষে সে লাঞ্ছিত হয় আপন জনক-জননীর হাতে। তার শিশুমন অপমানিত হয়। লজ্জায় লাল হয়ে যায় তার চোখ, কান, মুখ। কান্নায় ভেঙে পড়ে। না পারার যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খায় সারা জীবন। সে আরও যন্ত্রণায় কাতর হয় যখন তারই পড়শি বা কোনো জ্ঞাতি ভাই-বোন সে প্রশ্নের উত্তর জানে, পরীক্ষায় সে সঠিক উত্তর দিয়েছে। তার সঙ্গে তুলনা করে সন্তানকে নাজেহাল আর অপমান করা হয়।
আমাদের দেশে সৃজনশীল শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে শিশুদের সৃজনশীলতা বাড়ানোর কথা বলে। কিন্তু সেই সৃজনশীলতা তো বাড়ছেই না বরং কমছে। কারণ শিশুরা বই পড়া কমিয়ে দিয়েছে। কারণ প্রশ্নপত্রে প্রশ্ন ও উত্তর দুটোই দেওয়া থাকে। কিন্তু এই পদ্ধতিতে যে কীভাবে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় তার কোনো সঠিক পদ্ধতি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের জানা নাই। যদিও মন্ত্রণালয় বলছে শিক্ষকদের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাঠে গিয়ে দেখা যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের হার খুবই নগণ্য। কিছুদিন আগে দৈনিক ইত্তেফাক ‘মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের একাডেমিক সুপারভিশন’-এর রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে, সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি প্রণয়নের দীর্ঘ ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও অধিকাংশ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিই বোঝেন না।
২০১০ সালে শিক্ষানীতি ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল যে, শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে পরীক্ষার চাপ কমবে। কিন্তু আদতে দেখা গেল—শিক্ষার্থীদের ওপর আরো পরীক্ষা ও বইয়ের চাপ বেড়েছে। হাসি আর আনন্দের মাধ্যমে যে শিক্ষা অর্জন করতে হয় তা শিশুরা একরকম ভুলেই গেছে। তার মধ্যে নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে গেলে শিশুদের দিতে হচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা। শিশুকে যদি শিশুশ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েই ভর্তি হতে হয় তবে সে কোথা থেকে শিক্ষা অর্জন করবে? শিশুরা কি বাসায় লেখাপড়া শিখে তারপর স্কুলে খেলাপড়া শিখতে যাবে? নাকি শিক্ষা অর্জন করার জন্য শিশু স্কুলে যাবে? আজকের শিশুকে শিখতে গিয়েই পরীক্ষা দিতে হয়। এটা কোন ধরনের শিক্ষানীতি? আবার ওপর থেকে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ থাকে যে ফলাফল ভালো দেখাতে হবে, অল্প সময়ের মধ্যে খাতা দেখা, ফলাফল দেওয়া, এত পারসেন্ট পাস দেখাতে হবে ইত্যাদি। তা না হলে প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি। তাই প্রতিষ্ঠান তথা শিক্ষকসমাজ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে। এসব নানাবিধ কারণে শিক্ষাক্ষেত্র এখন হ-য-ব-র-ল অবস্থা। তাই বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা যায়, আসলে জিপিএ-৫ পাওয়াকেই বড় করে দেখা হচ্ছে। অধিকাংশ জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীই মৌলিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা আজ শিক্ষার্থীর চেয়ে পরীক্ষার্থী হয়ে পড়ছে।
শিশু মাতৃগর্ভে আসার মুহূর্ত থেকে প্রথম পরীক্ষা দেওয়া শুরু করেন জননী নিজে। দেশের সবচেয়ে নামি, সবচেয়ে দামি স্কুলে তার গর্ভস্থ সন্তানকে ভর্তি করতে হবে। না পারলে মা হিসেবে ব্যর্থ প্রমাণিত হবেন তিনি। তাই শিশুর জন্মের পরপরই তিনি শিশুকে মহাজ্ঞানী করে তোলার সাধনায় নামেন। আহারে, বিহারে, জাগরণে, নিদ্রায় চলে শিশুর শিক্ষাদান। এ জন্য নিয়োজিত হন হরেক নামের তথাকথিত সেরা পণ্ডিতরা! পুতুল খেলার সময় ছোট্ট শিশুর সময় কাটে কোচিং নামক রৌরব নরকে। পিতা-মাতার স্বপ্নপূরণের বলি হয় শিশু। এই স্বপ্ন অহর্নিশ শিশুকে যন্ত্রণা দেয়, অপমানিত করে, হিংসাশ্রয়ী করে তোলে। এরপর শিশুর কাঁধে চাপানো হয় রাশি রাশি জ্ঞানের বোঝা, যার কেতাবি নাম পাঠ্যপুস্তক বা টেক্সট বুক। এই অপাঠ্য টেক্সট বুকের চাপে শিশুর সর্বনাশের আরেক ধাপ অবনতি ঘটে। তার সঙ্গে আরও এক পাহাড় মহাজ্ঞানের ভাণ্ডার ইংরেজি বই! তার ওপর চাপানো হয় সমাপনী পরীক্ষার হিমালয় পর্বতমালা। ফলে শিশু নিজেকেই নিজের শত্রু মনে করতে শুরু করে। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনীর তিন বছর পর জুনিয়র পরীক্ষার আরেক দৈত্য কাঁধে ভর করে। তাতে শিশু নাকি পরীক্ষা নামক উৎসবে মেতে ওঠে। অন্তত এ দেশের কেরানিরা সে অমৃতবাণীই ফেরি করে।
বাঙালি শিশুর জীবনে এক প্রাথমিক সমাপনীর যেন সমাপন নেই! কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেখানে সপ্তাহে সাত দিনই পরীক্ষা চলে। ছুটির দিন শুক্রবার শুধু কাগজে। বাস্তবে সেদিনও পরীক্ষা নিতে হয়। লেখাপড়া লাটে উঠেছে। শিক্ষকের আসল কাজ পড়ানোর দিন শেষ হয়েছে। এখন শুধু পরীক্ষা নাও, জবরদস্তি পরীক্ষা। তাহলে শিক্ষার্থী শেখে কোথায়? কার কাছে? কখন শেখে? কী শেখে? এসব প্রশ্ন করতে বারণ! দেশটা তো পরীক্ষার। যত পরীক্ষা, তত বৈভব এক শ্রেণির মানুষের। তারা সার্টিফিকেট বিক্রির ব্যবসা ফেঁদেছে। শিক্ষা, জ্ঞানচর্চা সেখানে অবান্তর।
গবেষকেরা মনে করছেন, আগে সবাই পড়াশুনা করতো শেখার জন্য, জানার জন্য। কিন্তু এখন পড়াশুনা করছে বাধ্য হয়ে কিংবা পরীক্ষায় ভালো ফল অর্জনের জন্য। যেন সবাই পরীক্ষার্থী, শিক্ষার্থী। একই অবস্থা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও। যেন শিক্ষা গ্রহণের দুবেলা পেটপুরে আহার করার মতো হয়ে গেছে শিক্ষার্থী, শিক্ষক কিংবা অভিভাবকদের কাছে। ছাত্র-ছাত্রীরা আজ শুধু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বেছে পড়ে। সম্পূর্ণ বই আর পড়ে না। পিইসি পরীক্ষা থাকার যৌক্তিকতার ক্ষেত্রে তারা মনে করছেন যে, পঞ্চম শ্রেণিতে পিইসি পরীক্ষা থাকায় এ বয়সের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জনের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তাদের দিনরাত পড়ার জন্য চাপে রাখা হচ্ছে। ফলে তারা আজ শিখতে চায়না, ভালো ফলাফল করতে চায়। যদিও এই সময়টা তাদের আনন্দের সঙ্গে শেখা উচিত।
আমাদের দেশের বর্তমান পরীক্ষার্থীরা দেশের ভবিষ্যত। এদের মধ্যে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার মানসিকতা তৈরি করা হচ্ছে, কিছু জানানো বা শেখানো হচ্ছে না। শুধু একাডেমিক পরীক্ষার প্রয়োজনীয় বিষয়েই আবদ্ধ থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। কিন্তু শিক্ষার প্রকৃত স্বার্থকতা অর্জন করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। কারণ সবাই এখন পরীক্ষার্থী হয়ে গেছে, শিক্ষার্থী নয়!
পরীক্ষার এমন সর্বনাশা পরিণাম বোধ হয় সর্বপ্রথম বিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন মহামতি সক্রেটিস। তিনিই শিক্ষার কেন্দ্রে স্থান দেন শিশুকে। কিন্তু তার শিষ্যরা তার এই শিশুপ্রেম ভালো চোখে দেখেনি। তাই শিশুদের বিপথগামী করার অভিযোগে সমাজপতিরা তাকে বিষপান করিয়ে হত্যা করে। তার এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রায় দেড় হাজার বছর পর আরেকজন জা জ্যাক রুশো শিক্ষার নামে শিশুর ওপর এই অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করেন। সেই থেকে শিশুর শিক্ষায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে দুনিয়ার জ্ঞানী মানুষরা বিরামহীন প্রতিবাদ করে চলেছেন। মন্তেসেরি, হার্বার্ট, রবীন্দ্রনাথ, শ’, বল্গুম প্রমুখ তা সমস্বরে অবিরাম বলে চলেছেন। তারা বলছেন, ভালোবাস শিশুকে। যত বেশি ভালোবাসা দেবে, তারা তোমাদের তত বেশি মঙ্গল করবে। কলকাতার সব থেকে বনেদি আর প্রতাপশালী পরিবারের শিশু রবীন্দ্রনাথ বারবার স্কুল থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন। বার্নার্ড শ’ তার কোনো রচনা শিশুপাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে দেননি এ কথা বলে যে, শিশু নির্যাতনের জন্য কিছুই তিনি রচনা করেননি। তিনি মনে করতেন, শিশুর পাঠ্য বলে যা চালানো হয় তার সবই শিশুদের ওপর চরম নির্যাতন বই আর কিছু নয়। কিন্তু আমরা একটি অস্বাভাবিক দেশ বানাচ্ছি। সেখানে রাষ্ট্র জন্মমাত্রই পরীক্ষা দিতে বসায় ছেলেমেয়েদের। আমরা কি এর থেকে পরিত্রাণ পাবো?
প্রকাশিত পত্রিকা-
শিক্ষাবার্তা ২৯/০১/২০১৮
দৈনিক দেশকাল ২৯/০১/২০১৮