চাল নিয়ে চালবাজির নেপথ্যে কারা?

হাসান হামিদ

চালের বাজারে অস্থিরতার বিষয়টি নতুন নয়। এ দেশে দফায় দফায় চালের মূল্য বৃদ্ধি হয় সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে। একসময় চালের দাম বাড়তো কিছু নির্দিষ্ট সিজনে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ভরা মৌসুমেও চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। কারা এর সাথে জড়িত, তা সবার জানা। কিন্তু এ চক্রের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বারবার ঘোষণা দিলেও কর্তৃপক্ষ বাস্তবে নীরব। ফলে চাল নিয়ে চালবাজি চলছেই।

সূত্র বলছে, আমাদের দেশে গড়ে প্রতিদিন ৭ কোটি কেজির বেশি চাল লাগে। এখন কেজিপ্রতি চালের দাম মাত্র ১ টাকা বাড়লেও প্রতিদিন বাজার থেকে ৭ কোটি টাকা উঠিয়ে নেওয়া যায়। বাজারে যেহেতু সরকারের নিয়ন্ত্রণ অনেক সময় থাকে না, এই সুযোগ ব্যবসায়ীরা নেন। আর এর জন্য ভোগান্তি বাড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে। বাজারে চালের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণে কিছুদিন আগে সরকার আমদানির অনুমতি দেয়। যদিও আমদানিকারকরা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে আমদানি করেছেন অনেক কম পরিমাণ চাল। কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, দেশে এই মুহুর্তে খাদ্যশস্যের মজুত পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো। পাশাপাশি মাঠ থেকে আমন ধান কৃষকের গোলায় উঠতে শুরু করেছে। অথচ এই ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়েছে। কেন এমন হচ্ছে তা এ নিয়ে একে অপরকে কেবল দোষ দেন। এসবের মধ্যে বাজারে বিভিন্ন ঝটিকা অভিযানও হয়। কিন্তু চালের বাজারের অস্থিরতা আর কমে না।

সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধান-চালের বাজারে কৃষক থেকে ভোক্তাপর্যায়ে পৌঁছাতে হাতবদল হয় অন্তত পাঁচবার। আর প্রতিবার হাতবদলের সময় নতুন করে যোগ হয় খরচ আর মুনাফা। এর মধ্যে চালকলের মালিকেরা সবচেয়ে বেশি মুনাফা করছেন। গবেষণা মতে, তারা প্রতি কেজি চাল ও এর উপজাত বিক্রি করে ৮ থেকে ১৩ টাকা ৬৬ পয়সা পর্যন্ত মুনাফা করছেন। গবেষণায় প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাজারে ধান-চালের ব্যবসায় মূলত জড়িত পাঁচটি পক্ষ। প্রথমত, কৃষক নিজে; দ্বিতীয়ত, ফড়িয়ারা; তৃতীয়ত, আড়তদারেরা; চতুর্থত, চালকলমালিকেরা এবং পঞ্চমত, চালের খুচরা বিক্রেতারা। এর মধ্যে সবচেয়ে কম লাভ করেন ফড়িয়ারা। প্রতি কেজি ধানে ৫০ থেকে ৬৫ পয়সা। আর আড়তের মালিকেরা প্রতি কেজিতে ১ টাকা ৭৫ পয়সা পর্যন্ত মুনাফা করে থাকেন। তাদের খরচ বলতে দোকান ও গুদামের ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক শাহজাহান কবিরের মতে, মূলত চালকলের মালিকদের কারণে দাম দ্রুত বাড়ছে। ফলে চালকলগুলোর উচিত তারা কত দামে ধান কিনে তা কীভাবে চালে পরিণত করছে এবং ধান ও উপজাত বাবদ মোট কী পরিমাণ মুনাফা করছে, তার হিসাব দেওয়া। আর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত, চালকলের মালিকদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে চালের মিলগেট দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজার পর্যবেক্ষণে জড়িত অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের যোগসাজশ রয়েছে। ফলে পার পেয়ে যাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি চক্র। আর কর্তৃপক্ষের নামমাত্র তদারকির কারণে এই অসাধু ব্যবসায়ীরা আজকাল বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যখন তখন বাড়িয়ে দিচ্ছে দাম। ২০২৩ সালের সম্ভাব্য বিশ্বমন্দার কথা বলে তারা এখন থেকেই চালের দাম বাড়াতে শুরু করেছে।  এটা তারা করছে যাতে দীর্ঘ সময় বাড়তি মুনাফা করা যায়। এদের কেউ কেউ আবার দোষ দিচ্ছে সরকারের। অথচ বাস্তবতা হলো, এখন চালের দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণই নেই।

পত্রিকার প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে বলা যায়, চালের দাম কমাতে সরকারের সব উদ্যোগ এখন ভেস্তে যাচ্ছে। কেউ কেউ মনে করেন, স্বল্পমূল্যে ওএমএস চালু এবং আমদানি শুল্ক কমানোর পরও চালের দাম বাড়ছে মিলারদের কারসাজিতে। ভয়ানক ব্যাপার হলো, চাল নিয়ে দেশে এ ধরনের জটিলতা গত এক যুগে কখনোই তৈরি হয়নি। আবার দুই দফা শুল্ক কমিয়ে বেসরকারি খাতকে চাল আমদানির সুযোগ দিয়েও সুফল পাওয়া যায়নি। অনুমোদনের দুই মাস পর আমদানিকারকরা মাত্র কিছু পরিমাণ চাল আমদানি করেছে। এখন অনেকের প্রশ্ন, সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে চালবাজরা তাদের অনৈতিক ব্যবসা চালিয়ে যাবে আর কতদিন?

অভিযোগ রয়েছে, এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মোটা চাল কেটে সরু ও চকচকে করে তা বেশি দামে বাজারে বিক্রি করে। অথচ চালের পুষ্টিমাণ তাতে রক্ষা হচ্ছে না। কিছুদিন আগে সংবাদ মাধ্যমে এসেছে, চাল চকচকে করতে গিয়ে বছরে প্রায় ১৭ লাখ মেট্রিক টন ঘাটতি হয় বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। জনগণকে চকচকে চাল বর্জন করে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন চাল খাওয়ার জন্য এসময় আহ্বান জানান তিনি। আর মোটা চাল কেটে চিকন করে নাম দেওয়া হয়েছে মিনিকেট। অথচ বহুদিন থেকেই বলা হচ্ছে মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই। এটি অসাধু চক্রের কারসাজি। একে তারা চাল কেটে সরু করছে, এর ওপর জনগণের ব্রেইন ওয়াশ করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। 

বাজার ঘুরে দেখা যায়, নিত্যপণ্যের পাশাপাশি চালের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট নয়। অন্য বছর এমন মৌসুমে চালের দাম কিছুটা কম থাকে; কিন্তু এবার এই সময়েই ধান-চালের এমন দাম। তাতে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, সামনে কী হতে যাচ্ছে! আবার বিগত বছরের তুলনায় দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন এ বছর কম হয়েছে। এ জন্য এবার চালের ঘাটতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরাও। আর এটাই স্বাভাবিক যে, এই ঘাটতি পূরণে নির্ভর করা হবে আমদানির ওপর। চাল আমদানি করেও দাম নিয়ন্ত্রণ করা যেখানে কঠিন, সেখানে যদি বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের ইঙ্গিত দেয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো, তাহলে বলতে হবে বাংলাদেশের জন্য এটি অনেক বড় দুঃসংবাদ।

জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়াতে নতুন করে অনেক মানুষ দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়েছে। ইতিমধ্যে একবেলা খেলে আরেকবেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। কম আয় করেন এমন কয়েক কোটি মানুষ তাদের খাদ্য তালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিচ্ছেন এমন খবর প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে গণমাধ্যমে। এখন কম আয়ের মানুষ চাল কিনতেই সবচেয়ে বেশি অর্থব্যয় করে। কাজেই চালের দামের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে এসব মানুষের জীবনমান। চালের দাম কমাতে তবুও কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। কিন্তু যদি দামের লাগাম টেনে না ধরা হয় তবে দরিদ্রতার মধ্যে পড়তে পারে আরো কয়েক লাখ মানুষ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে চাল সিন্ডিকেটের অসাধু সদস্যদের চিহ্নিত করে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনলে অযৌক্তিক দাম বাড়ানো বন্ধ হবে। আর আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের সব ব্যবসায়ীকে কঠোর জবাবদিহিতায় আনা না গেলে চালের বাজারের অস্থিরতা কোনো দিনও কমবে না বলে মনে করেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। 

চাল নিয়ে চালবাজির নেপথ্যে কারা?
Scroll to top